পাহাড়ি ঢালুতে ত্রিপলের ছাউনিতে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী ও পাঁচ ছেলেমেয়ে নিয়ে থাকেন রোহিঙ্গা সাব্বির আহমদ (৫৫)। কক্সবাজারের উখিয়ার লম্বাশিয়া আশ্রয়শিবিরে তাঁর মতো প্রায় ৪৬ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর বসবাস।
১৯ আগস্ট দুপুরে ওই আশ্রয়শিবিরে গিয়ে দেখা, ১০ ফুট–১৪ ফুট দীর্ঘ ঘরের মেঝেতে গাদাগাদি করে দুপুরের খাবার খাচ্ছেন সাব্বির ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা। তাঁরা মিয়ানমারের রাখাইনরাজ্যের সিকদারপাড়ার বাসিন্দা ছিলেন। আশ্রয়শিবিরে রাখাইন রাজ্যের চেয়ে ভালো আছেন উল্লেখ করে সাব্বির বলেন, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা (ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউএফপি ও আইওএম) এবং দেশি–বিদেশি এনজিওর মানবিক সহায়তায় বেঁচে আছেন তাঁরা। শরণার্থী হিসেবে প্রতি মাসে চাল, তেল, ডাল, জ্বালানিসহ নিত্যপণ্য পাচ্ছেন। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য সরবরাহসহ নিরাপত্তাব্যবস্থার ক্ষেত্রে রাখাইন রাজ্যের চেয়ে বাংলাদেশে ভালো আছেন।
পাহাড়ে নিচে লম্বাশিয়া বাজারে একটি চায়ের দোকানে ১২-১৫ জন রোহিঙ্গা আড্ডা দিচ্ছিলেন। তাঁদের একজন রোহিঙ্গা নেতা ছৈয়দ উল্লাহ (৫২) বলেন, আশ্রয়শিবিরে তাঁরা স্বাধীনভাবে নিজের ভাষা–সাংস্কৃতিক চর্চা ও লালন করার সুযোগ পাচ্ছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নিচ্ছেন। বাল্যবিবাহ, যৌতুক প্রথা, বহুবিবাহ ও মাদকের কুফল সম্পর্কেও ধারণা পাচ্ছেন। রোহিঙ্গা মেয়েরা প্রশিক্ষণ পেয়ে চাকরি করছেন। ব্যবসাও করছেন কেউ কেউ। যা রাখাইন রাজ্যে সম্ভব ছিল না।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর এসেছে ৮ লাখ।
আশ্রয়শিবিরে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৩৪ হাজার বলে জানিয়েছেন অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন আশ্রয়শিবিরে ৩ হাজার ৪০০ শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠ নিচ্ছে প্রায় ৪ লাখ শিশু। তাদের শেখানো হচ্ছে ইংরেজি, গণিত, বার্মিজ ভাষা। এর বাইরে থাকা আরও এক লাখ শিশুকে শিক্ষাকেন্দ্রমুখী করার চেষ্টা চলছে। শিক্ষা কার্যক্রমে সহযোগিতা দিচ্ছে ইউনিসেফসহ বিভিন্ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা।
উখিয়ার বালুখালী, লম্বাশিয়া, জুমশিয়া, কুতুপালং, হাকিমপাড়া, জামতলী, শফিউল্লাহ কাটাসহ আশপাশের ১৩টি আশ্রয়শিবিরে ১৬২টি শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করছে বেসরকারি ‘সমাজকল্যাণ উন্নয়ন সংস্থা (স্কাস)’। এসব শিক্ষাকেন্দ্রে পড়ছে ১১ হাজার ৭০০ শিশু। বইখাতা, কলম, ব্যাগসহ শিক্ষাসামগ্রী পাচ্ছে বিনা মূল্যে।
* প্রতি মাসে চাল-তেল-ডাল-জ্বালানিসহ নিত্যপণ্য পাচ্ছে রোহিঙ্গারা।*আশ্রয়শিবিরে ৩ হাজার ৪০০ শিক্ষাকেন্দ্রে পাঠ নিচ্ছে প্রায় ৪ লাখ শিশু।*আগ্রহী হচ্ছে পরিবার পরিকল্পনায়। সরে আসছে বাল্যবিবাহ থেকে।*পাঁচ বছরে শতাধিক অগ্নিকাণ্ড
জানতে চাইলে স্কাসের চেয়ারম্যান জেসমিন প্রেমা প্রথম আলোকে বলেন, বেশির ভাগ শিশু রাখাইনে চোখের সামনেই বহু শিশু স্বজনকে হারিয়েছে। আশ্রয়শিবিরে আসার পর তারা ধীরে ধীরে ভয় কাটিয়ে স্বাভাবিক হচ্ছে। লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলাসহ নানা কাজে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে তাদের।
রাখাইন রাজ্যে তাঁদের সন্তানেরা শুধু মক্তব ও মাদ্রাসায় পড়ার সুযোগ পেত বলে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা কালা মিয়া (৫৮)। তিনি বলেন, বাংলাদেশে এসে শিশুরা ইংরেজি, গণিত, বার্মিজ ভাষার পাশাপাশি ধর্মীয় শিক্ষাও পাচ্ছে। ২১ ফেব্রুয়ারি আশ্রয়শিবিরে রোহিঙ্গা শিশুরা মাতৃভাষা দিবস পালন করেছে। ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস উপলক্ষে ‘গো-হোম ক্যাম্পেইন’ করেছে, যা রাখাইন রাজ্যে সম্ভব ছিল না।
সিভিল সার্জন ও পরিবার পরিকল্পনা দপ্তরের তথ্যমতে, আশ্রয়শিবিরগুলোতে দৈনিক গড়ে ৯০ জন শিশু জন্ম নিচ্ছে। বছরে ৩২ হাজার ৪০০ জন। সে হিসাবে পাঁচ বছরে জন্ম নিয়েছে দেড় লাখ শিশু।
কক্সবাজারের সিভিল সার্জন মাহবুবুর রহমান বলেন, আশ্রয়শিবিরে ২০-২৫ বছর বয়সী কয়েক হাজার নারী ৫-৬ সন্তানের জননী। এখন গর্ভবতী মায়ের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। আগে পরিবার পরিকল্পনা গ্রহণে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনীহা ছিল। এখন তাঁরা সচেতন হয়েছেন।
বাংলাদেশে আসার আগে জন্মনিয়ন্ত্রণের পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁদের ধারণা ছিল না বলে জানিয়েছেন উখিয়ার জামতলী আশ্রয়শিবিরের রোহিঙ্গা নেতা আবুল হাশেম (৪৮)। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা এখন আগ্রহী হচ্ছেন পরিবার পরিকল্পনায়। পাশাপাশি বাল্যবিবাহ, একাধিক বিবাহ থেকে সরে আসছেন। জীবনমুখী কর্মকাণ্ডে যুক্ত হচ্ছেন নারীরা। শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন প্রকল্পে চাকরি করছেন অন্তত ১০ হাজার রোহিঙ্গা তরুণ-তরুণী। মিয়ানমারে এ সুযোগ ছিল না।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের স্বাস্থ্য সমন্বয়কারী চিকিৎসক আবু তোহা এম আর ভূঁইয়া বলেন, আগে গর্ভবতী নারীরা অদক্ষ ধাত্রীর মাধ্যমে শিশুর জন্ম দিতেন। মারা যেত অনেক শিশু। এখন ৮০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।
বনের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে রোহিঙ্গা পরিবারে সরবরাহ করা হচ্ছে তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার। কিন্তু রোহিঙ্গারা সিলিন্ডার ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়। এ কারণে আগুন লাগার ঘটনা বাড়ছে। এ ছাড়া পাহাড় কেটে এর খাঁজে আশ্রয়শিবির গড়ে তোলায় বর্ষায় বাড়ে ভূমিধসের শঙ্কা।
৩৩ আশ্রয়শিবিরে স্যাটেলাইট ফায়ার স্টেশন আছে মাত্র একটি। সেটি উখিয়ার কুতুপালং (ক্যাম্প-৪) শিবিরে। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কক্সবাজার কার্যালয়ের উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ বছরে আশ্রয়শিবিরে শতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ২৩টি। এর অন্তত ১৩টির সূত্রপাত গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে। অগ্নিকাণ্ড ও সিলিন্ডার বিস্ফোরণে মারা গেছে ১৭ জন। পুড়ে ছাই হয়েছে ১৫ হাজার বসতি।
ভূমিধসের আশঙ্কা নিয়ে বর্ষাকাল কাটে অনেক রোহিঙ্গার। অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষাকালে ভূমিধসের অতিঝুঁকিতে থাকে প্রায় ৫ হাজার পরিবার। ঝুঁকিতে রয়েছে আরও ২০ হাজার পরিবার।