ক্রিকেট ব্যাট, আঁকা ছবি, ইস্তিরি করা স্কুলের পোশাক, পুতুল—সবই তো আছে। শুধু এক মশার কামড়ে চোখের সামনে থেকে সন্তানেরা হারিয়ে গেছে, হারিয়ে যাচ্ছে। ডেঙ্গুতে সন্তান হারানো মা–বাবা মেনে নিতে পারছেন না দুই দিন আগেও যে ছেলে বা মেয়ের দুরন্তপনায় ঘর মুখর ছিল, আজ সেই ঘরে শুধুই নীরবতা। প্রাণহীন ঘরে মা–বাবা টিকতে পারছেন না। স্বামী কেন সন্তানকে আরও আগে চিকিৎসকের কাছে নিলেন না বা স্ত্রী কেন মশারি টাঙাতে গাফিলতি করলেন—এমন নানা বিষয় নিয়ে সন্তানহারা মা–বাবার সম্পর্কে মনোমালিন্যও দেখা দিচ্ছে। তবে তাঁরা এটাও বুঝতে পারছেন, এই যে দোষারোপ, তা শুধুই সান্ত্বনা খোঁজার জন্য।
দেশে এ বছর ডেঙ্গুতে এরই মধ্যে ১৫ বছর ও এর কম বয়সী ১০২টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। সম্প্রতি ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া বেশ কয়েকটি শিশুর মা–বাবার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা মশা মারার দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিদের সন্তান মারা যাক, তা কখনো চান না। তবে যাঁদের দায়িত্বে অবহেলার কারণে তাঁরা সন্তান হারিয়েছেন, তাঁদের ক্ষমা করতে পারছেন না তাঁরা। হাসপাতালের নানা অব্যবস্থাপনা, আবার চিকিৎসা–সংশ্লিষ্টদের অবহেলায় সন্তান হারানোর বিষয়টি এই বাবা–মায়েরা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না। তাঁরা বলছেন, সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী, মেয়রসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা কে কী বলছেন, কী করছেন, সেগুলো সবই তাঁরা দেখছেন।
সন্তানহারা বাবা-মায়েরা জানিয়েছেন, সন্তানের জীবন বাঁচাতে তাঁদের কেউ কেউ হাসপাতালে লাখ লাখ টাকা বিল দিয়েছেন। কিন্তু সন্তান বাড়ি ফেরেনি। ঋণ বা বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা এ টাকা পরিশোধ করতেও অনেক পরিবারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। এর মধ্যে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী, দুই মেয়রসহ রাজনৈতিক নেতাদের বিভিন্ন কার্যক্রম ও কথাবার্তায় ক্ষুব্ধ সন্তান হারানো বাবা-মায়েরা।
যে ছেলে বা মেয়ে পেছন থেকে চুপিচুপি এসে মাকে চমকে দিতে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে আহ্লাদ করত, সেই সন্তান এখন আর নেই। শুধু এক এডিস মশার কামড়ে তারা এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে। সন্তানহারা বাবা–মায়েরা বলছেন, তাঁদের সারা জীবন সন্তানের জন্য বিলাপ করে কাটাতে হবে। তাঁদের এই বিলাপের অর্থ ভুক্তভোগী ছাড়া অন্যরা বুঝতে পারবেন না। আর সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তরা তো তা বুঝতেই চাচ্ছেন না। একদিকে মশা মরছে না, অন্যদিকে হাসপাতালগুলোতে নানা অব্যবস্থাপনা চলছেই।
এক মা অনেকটা আক্ষেপ করেই বললেন, মশা মারার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্তদের কোনো সন্তান মারা গেলে হয়তো পরিস্থিতির উন্নয়নে কিছু একটা করার চেষ্টা করতেন। তবে এই মা পরক্ষণেই তাঁর কথা ফিরিয়ে নিয়ে বললেন, কোনো শত্রু, তার আর যা–ই হোক, সন্তানহারা যাতে না হতে হয়।
অনেক মা–বাবা নিজেদের মনকে শান্ত করার জন্য বলছেন, সৃষ্টিকর্তা সন্তানের হায়াত এটুকু দিয়েই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু হাসপাতালগুলোর অব্যবস্থাপনার জন্য সন্তান যে কষ্টের মধ্য দিয়ে মারা গেল, তা তো মেনে নেওয়া যায় না।
সন্তান হারানো বাবা–মায়েদের মনের ক্ষতকে আরও উসকে দিচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ অন্যদের বক্তব্য। ৪ সেপ্টেম্বর এক অনুষ্ঠানে মশা না কমলে ডেঙ্গু কমবে না বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ৩০ জুলাই অন্য এক অনুষ্ঠানে দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের প্রয়োজনীয় সব ধরনের প্রস্তুতি আছে বলে দাবি করেছিলেন তিনি।
ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব নিয়ে মাঠ গরম করার জন্য রাজনৈতিক বক্তব্যও দিচ্ছেন নেতারা। ৬ সেপ্টেম্বর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতায় ঢাকার দুই মেয়রের পদত্যাগ করা উচিত। অন্যদিকে ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিতে গিয়ে ডেঙ্গু নিয়ে ব্যর্থতা ও সফলতা বিচারের ভার জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেছেন, জনগণ দেখছে ডিএনসিসি সক্রিয় অবস্থানে আছে। মেয়র বলেছেন, তিনি বিভিন্ন এলাকায় ছুটে যাচ্ছেন।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মায়ামি শহরের ডেড কাউন্টি থেকে মশা নিধন বিষয়ে তালিম নিয়ে এসেছিলেন আতিকুল ইসলাম। তখন তাঁর উপলব্ধি হয়েছিল, ঢাকা শহরে মশা নিধনে যে প্রক্রিয়ায় কাজ করা হয়, তা ভুল পদ্ধতি। এতে মশা ধ্বংস হয়নি। বরং অর্থের অপচয় হয়েছে। সন্তানহারা একাধিক মা–বাবা মেয়র যুক্তরাষ্ট্র থেকে মশা মারার যে জ্ঞান নিয়ে ফিরলেন, পরে তা কোন কাজে লাগালেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির মধ্যেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ১৪ থেকে ৩০ জুলাই ১৭ দিনের জন্য সপরিবার বিদেশ সফরে গেছেন। গত ২৩ আগস্ট তিনি বলেছেন, ডেঙ্গু রোগের ভরা মৌসুমেও ঢাকা শহরে ডেঙ্গু রোগ এখন স্থিতিশীল।
সন্তানহারা বাবা–মায়েদের প্রশ্ন, ভারত, সিঙ্গাপুর ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল, এমন খবর গণমাধ্যমেই প্রকাশিত হয়েছে। তাহলে বাংলাদেশে কেন মশা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এই বাবা–মায়েরা রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাঁরা বলছেন, তাঁদের তো কথা বলার কোনো জায়গা নেই, তাই তাঁদের এ প্রশ্নগুলোও নীতিনির্ধারকদের কানে পৌঁছাবে না। শুধু একের পর এক মা–বাবার বুক খালি হতে থাকবে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ‘মশার কামড় ক্ষতিকর’ নামে শিশুদের জন্য একটি কার্টুনের বই বের করেছে। এতে বলা হয়েছে, সুস্থ থাকার সেরা উপায় মশার কামড় না খাওয়া। শিশুদের নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষা পেতে সুপারহিরো হতে বলা হয়েছে।
বাইটের (কামড়) সঙ্গে শিশুদের ফাইট করতে বলা হয়েছে। আর এ জন্য সব সময় ফুলহাতা শার্ট বা গেঞ্জি ও ফুলপ্যান্ট পরতে হবে। জুতা, কেডস বা শু দিয়ে পা ঢেকে রাখতে হবে। মুখ ও হাতের কবজি পর্যন্ত মশা নিয়ন্ত্রণের ক্রিম মাখতে বলা হয়েছে। ঘরের দরজা–জানালা বন্ধ রাখতে হবে। ঘর পরিষ্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। তবে দেশে পথশিশু আছে, দরিদ্র শিশু আছে, তাদের কথা হয়তো ভুলে গেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। পথশিশুর ফুলহাতা শার্ট, প্যান্ট নেই, তাদের ঘরই নেই, দরজা–জানালা বন্ধ করবে কেমনে? আর এই গরমে যে শিশুর বাসা বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র নেই, তাদের পক্ষে ফুলহাতা শার্ট, ফুল প্যান্ট পরে থাকাও অসম্ভব। সে যা–ই হোক, মশার কামড় থেকে বাঁচার কাজটিও শিশুদের ঘাড়েই চাপানো হয়েছে।
আর সব থেকে বড় কথা হলো, মশা নিয়ন্ত্রণ বা মশা না মেরে এসব নির্দেশনা দিয়ে আসলে কতটুকু লাভ হবে? সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোনো মা–বাবার হাহাকারে পরিবেশ ভারী হয়ে উঠছে। তাঁরা পোস্টে জানাচ্ছেন, কেউ সন্তানের জন্য রক্ত পাচ্ছেন না, কেউ শিশুর জন্য পিআইসিইউ পাচ্ছেন না আবার কেউ হাসপাতালে শয্যা না থাকায় সন্তানকে ভর্তিই করতে পারছেন না।
অন্যদিকে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার চার মাস পর ২৩ আগস্ট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টি, প্রতিকার ও প্রতিরোধের জন্য কমিটি করার উদ্যোগ নেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। মাউশির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধে শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও অভিভাবকদের করণীয় কী হবে, শিক্ষার্থীদের স্কুল ও নিজ বাসার আঙিনা পরিষ্কার করার পদ্ধতি শেখানো হবে। এসব কার্যক্রম মূল্যায়ন হিসেবে ধার্য হবে এবং নম্বর দেবেন শিক্ষকেরা। এ নম্বর পরে মূল নম্বরের সঙ্গে যোগ হবে।
গত ২২ আগস্ট অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল মশার ভয়ে কাবু হয়ে গণমাধ্যমে খবরের শিরোনাম হয়েছিলেন। এনবিআর ভবনে ভ্যাট আদায়ের ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেমের (ইএফডিএমএস) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রধান অতিথি ছিলেন। এ অনুষ্ঠানে একজনকে মশা মারার ব্যাট হাতে মঞ্চে উপবিষ্ট অতিথিদের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। তারপরও মশার ভয়ে বক্তব্যের একাংশ বলতে ভুলে গিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। এর আগে ২০১৯ সালে তিনি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তবে শিশুরা নিশ্চয়ই অর্থমন্ত্রীর মতো এত বিবেচক হবে না, এটাই তো স্বাভাবিক।
জুলাই মাসে ডেঙ্গুতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় ১০ মাস বয়সী রাজশ্রী ধর। যে শিশু মাকে জড়িয়ে ধরে হাসতে হাসতে মায়ের বুকের দুধ খেত, সেই মা বীথি ধর কীভাবে মানবেন যে তাঁর সন্তানটি আর নেই।
ডেঙ্গুতে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মারা গেছে ঢাকার মধ্যপাইকপাড়ার দুই ভাই–বোন আরাফাত হোসেন রাউফ (৯) আর ইসনাত জাহান রাইদা (৬)। ১৮ আগস্ট আরাফাত এবং ২৫ আগস্ট রাইদার মৃত্যু হয়। তাদের বাসায় গিয়ে দেখা গেল, আরাফাত ও রাইদার সব জিনিস ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে। এই দুই ছেলেমেয়েকে হারিয়েছেন মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও রাবেয়া আক্তার দম্পতি। ডেঙ্গুতে এক সন্তান হারিয়েছেন এমন এক বাবা ফোন করে বললেন, দুই ছেলেমেয়ে হারানো মা–বাবা কীভাবে বাঁচবেন?
ঢাকার বি এ এফ শাহীন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী আয়েশা তাবাসসুম তাকওয়া ছিল প্লাটিনাম গ্রুপে কর্মরত মো. আকতার হোসেন ও অনলাইন উদ্যোক্তা রোখসানা ইসলামের একমাত্র মেয়ে। আয়েশা ২০ আগস্ট রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছে। আকতার হোসেন বারবার বলছিলেন, শুধু একবার বাবা বলে চিৎকার করে মেয়েটা লাইফ সাপোর্টে চলে গেল। এই ‘বাবা’ ডাক তিনি এই জীবনে তো আর ভুলতে পারবেন না। মেয়ের মৃত্যুর এক মাস পর এই মা ফেসবুকে লিখেছেন, ‘এক মাস ধরে মেয়ের মুখে আম্মু ডাক শুনি না’।
সেতারা রহমান রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল। ২৫ জুলাই দিবাগত রাত ১টার দিকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় সে মারা যায়। সেতারার বাবা একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক গোলাম রহমান এখনো বিশ্বাস করতে পারেন না, মেয়েটা আর এই পৃথিবীতে নেই।
নানির বাসায় ঈদ করতে আহনাফ রাফান ২৩ জুন ঢাকায় এসেছিল। ২৯ জুন বৃহস্পতিবার ঈদুল আজহার রাতে তার জ্বর আসে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহনাফ মুঠোফোন দেখছে এমন একটি ছবি এখন শুধুই স্মৃতি। আহনাফের বাবা মো. মনিরুজ্জামান ৭ জুলাই ছেলের লাশ নিয়ে টাঙ্গাইলে বাড়িতে ফেরেন। মনিরুজ্জামান ও তানজিদা মুমু দম্পতির একমাত্র ছেলে ছিল আহনাফ।
৯ বছর বয়সী আফিয়া জাহিন তার ডায়েরিতে ইংরেজিতে নিজের স্বপ্নের কথা (মাই ড্রিম) লিখেছিল, ‘ট্রাভেল’ (ভ্রমণ)। সেখানে সে ছবিও এঁকেছে। এতে দেখা যায়, ছোট একটি মেয়ে ব্যাগ নিয়ে ভ্রমণে বেরিয়েছে। ছবিতে উড়োজাহাজও আছে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১৪ আগস্ট আফিয়া এক অজানা ভ্রমণে বের হয়, যেখান থেকে সে আর ফিরবে না। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের বনশ্রী শাখার (ইংরেজি সংস্করণ) তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল আফিয়া। আফিয়ার মা নুসরাত জাহান, বাবা মাহবুবুর রহমান ফেসবুকে তাঁদের অসহায়ত্বের কথা লিখে নিজেদের হালকা করার চেষ্টা করছেন। মাহবুবুর রহমান ফেসবুকে লিখেছেন, বাবা হয়ে সন্তানের লাশ কাঁধে নেওয়া কতটা কষ্টের, তা শুধু বাবাই জানেন।
রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণির বিজ্ঞানের ছাত্রী ইলমা জাহান চেয়েছিল এইচএসসির পর হয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে, না হয় প্রকৌশলে পড়বে। ইলমার মা মাকসুদা আক্তার জাহান ও বাবা মো. ইকবাল কবিরের স্বপ্ন ছিল, মেয়ে চিকিৎসক হবে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে ৩ জুলাই মারা যায় ইলমা।
পাঁচ বছর বয়সী শিশু ফারওয়াহ মান্নান মোহাম্মদী (মধু) ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ২০২২ সালের ৬ নভেম্বর রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে মারা যায়। তার মা ফারহানা মান্নান রাজধানীর মোহাম্মদপুরে শৈশব প্লে অ্যান্ড লার্নিং সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা। মেয়ের মৃত্যুর শোককে শক্তিতে পরিণত করে বছরটির ১১ নভেম্বর থেকে তিনি আবার সেন্টারে শিশুদের ক্লাস নেওয়া শুরু করেছিলেন।
হাসপাতালের বিছানায় শেষবারের মতো মেয়েকে স্পর্শ করা, মেয়ের হাতে চুমু খাওয়া, মেয়ের লাশ কাঁধে নেওয়ার ছবি ফারহানা ফেসবুকে শেয়ার দিয়ে নিজের আবেগ প্রকাশ করেছিলেন। এ নিয়ে ফেসবুকে তখন অনেক আলোচনা সমালোচনাও হয়েছিল।
ফারহানা মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ‘পৃথিবীতে যত বেদনা আছে সন্তান হারানোর বেদনা সম্পূর্ণ অন্য রকম। এটি শূন্যতা তৈরি করে। ঘুরে ফিরে সন্তানের স্মৃতি আসবেই। অন্যদিকে আমরা যাঁরা বেঁচে আছি তাঁদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কাজ করতে হবে। কাজের মাধ্যমে স্বস্তি পেতে আমার পরিবার আমাকে সাহায্য করেছে। সন্তান হারানো বাবা–মায়েদের বলব, সন্তানের স্মৃতি ধারণ করে নিজেদের ব্যস্ত রেখে সামনে এগিয়ে যেতে হবে।’
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সন্তান বা নিকটজন হারানোর পর মৃত্যুশোক একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু আকস্মিক মৃত্যু, সড়ক দুর্ঘটনা, ডেঙ্গু বা করোনায় সন্তানের মৃত্যু হলে কেউ মেনে নিতে চান না। তখন মৃত্যুশোক দীর্ঘমেয়াদি হয়। দীর্ঘমেয়াদি মৃত্যুশোকে মা–বাবা তীব্র বিষণ্নতায় নিজেদের কাজ থেকে গুটিয়ে নিতে পারেন। পৃথিবীর সব দেশেই হাসপাতালে এই শোক কাটিয়ে ওঠার জন্য পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। স্বজনদের সংবেদনশীলভাবে মৃত্যুর বিষয়টি জানানো হয়, যাতে স্বজনেরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারেন। সন্তান হারানো মা–বাবার জন্য এই পরামর্শ জরুরি। এটার জন্য কোনো সংস্থা বা মানসিক বিশেষজ্ঞরাও এগিয়ে আসতে পারেন।