সুখে নেই বুড়িয়ে যাওয়া সিংহী কান্তা, গয়াল, কাজলতারা হাতি

মিরপুর চিড়িয়াখানায় সিংহী কান্তা।
ছবি: আশরাফুল আলম

রাজধানীর মিরপুর চিড়িয়াখানায় বুড়িয়ে যাওয়া সিংহী কান্তার বাম পায়ের তালুতে নখ ঢুকে গেছে। চোখে কম দেখে। দাঁত ক্ষয় হয়েছে। ঠিকমতো মাংসও ছিঁড়তে পারে না। রুগ্‌ণ হওয়ায় তাকে প্রদর্শনী থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, আবদ্ধ অবস্থায় সিংহের আয়ুষ্কাল ১৫ থেকে ২০ বছর। আর কান্তার বয়স ১৮ বছর ৮ মাস।
২৫ বছর বয়সী একটি গয়ালও বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভোগার কারণে প্রদর্শনী থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছে ১৪ বছর ৮ মাস বয়সের একটি শিয়াল। সেটি প্রদর্শনীর অনুপযোগী হলেও  প্রদর্শিত হচ্ছে। শিয়ালটি বেশির ভাগ সময় লুকিয়ে থাকে।

কান্তা, গয়াল, শিয়ালের মতো অন্তত ৩৯টি প্রাণী সাধারণ আয়ুষ্কাল অতিক্রম করেছে। দেশের তিনটি চিড়িয়াখানা ও একটি সাফারি পার্কে এসব প্রাণীর মধ্যে চারটি সিংহ, একটি ভালুক, একটি গয়াল, একটি ওয়াইল্ড বিস্ট ও একটি শিয়াল বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছে, গাজীপুরের শ্রীপুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে ১৫ মার্চ একটি বাঘ মারা যায়। রাজধানীর মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় ৬ ডিসেম্বর একটি উল্লুকের মৃত্যু হয়। গত ৩০ নভেম্বর ‘রঙমালা’ নামে ৮৬ বছর বয়সী একটি হাতি মারা যায় কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কে।

মিরপুর চিড়িয়াখানায় কাজলতারা হাতি বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছে।

কোথায় কোন প্রাণী

বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিলতায় ভোগা প্রাণীগুলোর মধ্যে মিরপুর চিড়িয়াখানায় একটি সিংহ, একটি গয়াল, একটি শিয়াল, চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় একটি সিংহ ও একটি ভালুক,  রংপুর চিড়িয়াখানায় দুটি সিংহ এবং গাজীপুরের সাফারি পার্কে একটি ওয়াইল্ড বিস্ট রয়েছে।

মিরপুর চিড়িয়াখানার ৩১টি প্রাণী সাধারণ আয়ুষ্কাল অতিক্রম করলেও সেগুলো বার্ধক্যজনিত কোনো জটিলতায় ভুগছে না বলে দাবি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের।

তবে বাংলাদেশে প্রাণীর কোনো আয়ুষ্কাল তৈরি হয়নি বলছেন মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক রফিকুল ইসলাম তালুকদার। তিনি বলেন, প্রাণীর আয়ুষ্কাল একেক লেখায় একেক ধরনের দেওয়া থাকে। মূলত একেক চিড়িয়াখানা থেকে একেক ধরনের আয়ুষ্কালের প্রতিবেদন দেওয়া হয়। প্রতিটি দেশের জন্য নিজেদের আয়ুষ্কালের মান থাকা প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে তো অন্য দেশের আবহাওয়া মেলে না।
বিষয়টি নিয়ে মিরপুর চিড়িয়াখানা কাজ করছে বলেছেন রফিকুল ইসলাম। এই চিড়িয়াখানায় কোন প্রাণীর কত আয়ুষ্কাল তা গবেষণা করে বের করার চেষ্টা চলছে বলেও জানান তিনি।

বুড়িয়ে যাওয়া প্রাণীগুলো যেভাবে আছে

মিরপুর চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা বলেন বয়স্ক বা অসুস্থ হলে প্রাণীদের আড়াল বা আলাদা করার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে পর্যাপ্ত নয়।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় ১৮ বছর বয়সী একটি সিংহ খাবার খাওয়া কমিয়ে দিছে। চলাচল কম করে। প্রস্রাব-পায়খানা নিয়মিত হচ্ছে না। ভালুকেরও একই অবস্থা।

চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত কিউরেটর শাহাদাত হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সিংহ ও ভালুকটিকে এমনভাবে রেখেছি যে মানুষ দূর থেকে দেখতে পারছে। তবে এগুলো যে নানা জটিলতায় ভুগছে, তা মানুষ দূর থেকে বুঝতে পারছে না। এতে মানুষও খারাপ ধারণা নিচ্ছে না, প্রাণীও একটু নিরিবিলি থাকতে পারছে।

রংপুর বিনোদন উদ্যান ও চিড়িয়াখানার পুরুষ সিংহটি আগের মতো চলাফেরা করতে পারে না। চোখে কম দেখে। নানা জটিলতায় ভুগলেও প্রাণী দুটি প্রদর্শন করা হচ্ছে। রংপুর চিড়িয়াখানার ডেপুটি কিউরেটর আম্বার আলী তালুকদার বলেন, আর কোনো খাঁচা না থাকায় তাদের প্রদর্শনীর জন্য রাখতে বাধ্য হচ্ছেন।

আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে দুরন্ত নামে একটি জলহস্তী।

গাজীপুরের সাফারি পার্কে ওয়াইল্ড বিস্টও বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছে বলে জানা গেছে।

মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহীদ উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, দেশের প্রতিটি চিড়িয়াখানায় বয়স্ক ও অসুস্থ প্রাণী রাখার জন্য আলো-বাতাসসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাসংবলিত আলাদা অবকাঠামো থাকা প্রয়োজন। তাতে সেগুলোকে প্রদর্শন না করে আলাদা রাখা যায়। তবে এখানে সে ব্যবস্থা নেই।

চট্টগ্রাম ও রংপুর চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে সেখানে কিছু প্রাণী বার্ধক্যজনিত জটিলতায় ভুগছে। তবে তাদের আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যায়নি।

মিরপুর চিড়িয়াখানার ৩১টি আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া প্রাণীগুলোর মধ্যে আটটি বৃহৎ তৃণভোজী। তার মধ্যে রয়েছে কাজলতারা নামের একটি এশিয়ান হাতি, দুরন্ত নামের একটি জলহস্তী, চারটি ওয়াটার বাক, একটি গাধা ও একটি কমন ইল্যান্ড।
ক্ষুদ্র স্তন্যপায়ী ও সরীসৃপ প্রাণীগুলোর মধ্যে আটটির আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত হয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে অলিভ বেবুন একটি, সাদা হনুমান একটি, ঘড়িয়াল তিনটি, ডিগলেঞ্জি একটি ও ভারভেট বানর দুটি।
আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া পাখি রয়েছে ১৫টি। সেগুলো হলে উটপাখি, ইমুপাখি, কেশোয়ারি, বেঙ্গল শকুন, সিনোরাস শকুন, সারস ক্রেন, কালো গলা বক, হারগিলা, লেসার পেলিকেন, নীল ময়ূর, সাদা ময়ূর, বড় পানকৌড়ি, ছোট পানকৌড়ি ও টারকী।

মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক বলেন, পাখির আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেলেও বোঝা যায় না। তবে অন্যগুলোর ক্ষেত্রে বিষয়টি বোঝা যায়। এসব প্রাণীর বয়স অতিক্রান্ত হলেও তারা সম্পূর্ণ সুস্থ আছে।

কক্সবাজারের ডুলাহাজারা সাফারি পার্কে কোনো আয়ুষ্কাল পেরিয়ে যাওয়া প্রাণী নেই বলে কর্তৃপক্ষের দাবি। আর গাজীপুরের সাফারি পার্কে আফ্রিকা থেকে আনা প্রাণীগুলো বয়স্ক হয়ে যাচ্ছে। তবে ঠিক কতটি প্রাণী আয়ুষ্কাল পেরিয়েছে, তা জানাতে পারেননি সেখানকার প্রকল্প পরিচালক ইমরান আহমেদ।

ব্যথাহীন মৃত্যুর বিধান হচ্ছে

গত বছরের শেষের দিকে মন্ত্রিসভা চিড়িয়াখানা আইন, ২০২২–এর অনুমোদন দিয়েছে। আইনটি চূড়ান্ত করতে এখন বাকি কার্যক্রম চলমান আছে। সেই আইনে ইউথেনেশিয়া বা প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যুর বিধান রাখা হচ্ছে।

জানা গেছে, আইনের একটি ধারায় বলা হয়েছে, ‘চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণীর বয়সজনিত শারীরিক অক্ষমতা বা সংক্রমণযোগ্য রোগ হইতে অন্য কোনো প্রাণীর জীবন রক্ষার্থে বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে, উক্ত বয়সজনিত বা আক্রান্ত প্রাণীর অসহনীয় ক্লেশ নিবারণের জন্য বয়স্ক বা রোগজীবাণুবাহী প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যু ঘটানো যাইবে। যাহাই থাকুক না কেন, ভেটেরিনারি সার্জনের লিখিত নির্দেশনা বা তাহার উপস্থিতি ব্যতীত কোনো প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যু ঘটানো যাইবে না।’

দেশের বিদ্যমান আইনে কোনো প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যু নিশ্চিত করতে পারে না চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। এই ধারা বিদ্যমান রেখে আইনটি পাস হলে তখন তা পারবে তারা।

প্রাণীর ব্যথাহীন মৃত্যুর বিষয়টি আইন আকারে পাস হয়ে আসা প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহীদ উল্লাহ। তিনি বলেন, বৃদ্ধ হয়ে গেলেই কোনো প্রাণীকে ইউনেনেশিয়া দিয়ে মেরে ফেলা ঠিক হবে না। তাকে অধিকতর সেবা দিয়ে যত দিন বাঁচিয়ে রাখা যায়, রাখতে হবে। তবে অতি কষ্টে আছে, কিন্তু নিরাময়যোগ্য নয় এবং জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ প্রাণীগুলোকে ইউথেনেশিয়া দেওয়া যেতে পারে।