রিকশাচিত্রে কল্পিত ঢাকা শহর
রিকশাচিত্রে কল্পিত ঢাকা শহর

রিকশাচিত্র: যেন চলমান জীবন্ত চিত্র প্রদর্শনী

বাংলাদেশের পঞ্চম বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে বিশ্বের স্বীকৃতি পেল ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র। আজ বুধবার বাংলাদেশ সময় বেলা ২টা ৫৪ মিনিটে ইউনেসকো এ ঘোষণা দেয়। বতসোয়ানার উত্তর-পূর্ব চোবে ডিস্ট্রিক্টের কাসান শহরে ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তসরকার কমিটির ১৮তম অধিবেশন বসেছে। ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগ সর্বশেষ ২০১৭ সালে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী শীতলপাটির বয়নকৌশলের স্বীকৃতিপ্রাপ্তির পাঁচ বছর পর এ অর্জন এল।

বিশ্বের বিভিন্ন স্পর্শাতীত শিল্প বা কীর্তিকে সুরক্ষার জন্য এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সারা বিশ্বের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুরক্ষার জন্য ইউনেসকোর ২০০৩ সালের কনভেনশনের ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশের ঐতিহ্য বিশ্বতালিকার অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিবছর ৪ থেকে ৯ ডিসেম্বর ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আন্তসরকার কমিটির সভায় চূড়ান্ত নির্বাচন হয়।

‘ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র’ বিষয়ে একটি ফাইল গত বছরের নভেম্বর মাসে ইউনেসকোর বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বিভাগে পাঠানো হয়। ইউনেসকোর নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রপক্ষ হিসেবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হয়ে বাংলা একাডেমি এ ফাইল পাঠায়। তবে এর কাজ শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক বছর আগে। ২০১৮ সালের ইউনেসকোর আন্তসরকার কমিটির ১৩তম অধিবেশনের সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে তথ্য হালনাগাদ করার উদ্দেশ্যে এ–সংক্রান্ত ফাইলটি ফিরিয়ে আনা হয়। নানা পর্যায়ে সংশোধনের পর সেটি ইউনেসকোর স্বীকৃতির জন্য আবার পাঠানো হয়। এ স্বীকৃতির মধ্যে দিয়ে রিকশাচিত্রের দেশ হিসেবে বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশের নাম উৎকীর্ণ হলো।

ঢাকা শহরের রিকশা ও রিকশাচিত্র ‘ঐতিহ্যগত কারুশিল্প’ ক্যাটাগরিতে এ স্বীকৃতি পেল। এর আগে ২০০৮ সালে বাউলগান, ২০১৩ সালে জামদানি, ২০১৬ সালে বাংলা নববর্ষের মঙ্গল শোভাযাত্রা এবং ২০১৭ সালে সিলেট অঞ্চলের শীতলপাটি এ তালিকায় যুক্ত হয়েছিল।

রিকশাচিত্র বাংলাদেশের অন্যতম নাগরিক লোকচিত্রকলা। এসব চিত্র এঁকে রিকশার প্রায় প্রতিটি অংশ আকর্ষণীয় ও মনোরম করে তোলা হয়। এর মধ্যে বিশেষভাবে লক্ষণীয় হয়ে ওঠে রিকশার পেছনের আয়তাকার টিনের পাত বা বোর্ডটি।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে বলা হয় রিকশার শহর। রিকশা এ দেশের সহজলভ্য যাত্রীপ্রিয় বাহন। চলমান রিকশাগুলো শহরকে একটি চলমান জীবন্ত চিত্র প্রদর্শনী করে তোলে। রিকশাচিত্রের শিল্পীরা এর একটি স্বকীয় শিল্পশৈলী, উপস্থাপন রীতি ও বর্ণের সমাহার গড়ে তুলেছেন। শিল্পটি বিকশিত হয়ে উঠেছে অপ্রাতিষ্ঠানিক শিল্পীদের হাতে। গুরু-শিষ্যপরম্পরায় রিকশাচিত্রের ঐতিহ্য এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে চলমান। এসব চিত্রে বহুল ব্যবহৃত বিষয়গুলো হলো পশুপাখি, ফুল-লতা-পাতা, জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা, চলচ্চিত্রের দৃশ্য, বোরাক বা মোনাজাতরত শিশুর মতো ধর্মীয় প্রসঙ্গ, তাজমহল বা সংসদ ভবনের মতো স্থাপত্য, নানা সামাজিক-রাজনৈতিক বার্তা ইত্যাদি। রিকশাচিত্র এর নিজস্ব শিল্পশৈলীর কারণে দেশি-বিদেশি শিল্পানুরাগীদের কাছে সমাদৃত হয়েছে।

ইউনেসকোর ২০০৩-এর কনভেনশনের ১১ ও ১২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত উপাদানের সুরক্ষা করা এবং এর তালিকা তৈরি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। দেশের বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপাদান সুরক্ষার উদ্দেশ্যে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে একটি অনলাইনভিত্তিক অ্যাপ তৈরি করা হয়েছে (heritagehub.gov.bd)। এতে যে কেউ নিজ জেলার বিমূর্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সুরক্ষায় অংশ নিতে পারেন।

ইউনেসকোর এ স্বীকৃতির ফলে রিকশা ও রিকশাচিত্রের সুরক্ষার পথ প্রসারিত হলো। এ ছাড়া সারা বিশ্বে রিকশাচিত্র এখন থেকে বাংলাদেশের একটি ব্র্যান্ড হিসেবেও কাজ করবে।

* আসমা ফেরদৌসি: কিপার, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর