ছুটি কাটাতে দেশের বাইরের গন্তব্যে উড়োজাহাজযাত্রা জনপ্রিয় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে। বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন গন্তব্যে আগের চেয়ে উড়োজাহাজের সংখ্যা বেড়েছে; বেড়েছে যাত্রীসংখ্যাও। এতে টিকিটের দাম কমার কথা। কিন্তু উল্টো বাড়ছে।
বিশেষ করে ঈদের মতো উৎসবকে কেন্দ্র করে দেশের বাইরে উড়োজাহাজে করে অবকাশযাত্রায় বাড়তি বাণিজ্যের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। একই দূরত্বের গন্তব্যে কলকাতার চেয়ে ঢাকা থেকে দ্বিগুণের বেশি ভাড়া পড়ছে।
ঢাকা ও কলকাতা থেকে সিঙ্গাপুরের দূরত্ব প্রায় একই। উড়োজাহাজে সরাসরি ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুরে যেতে সময় লাগে ৪ ঘণ্টা ২০ মিনিট। কলকাতা থেকে যেতে ৪ ঘণ্টা ২৫ মিনিট লাগে।
তার মানে এই গন্তব্যে উড়োজাহাজের জ্বালানি খরচে তেমন পার্থক্য হবে না। অথচ ঢাকা থেকে সিঙ্গাপুর যেতে উড়োজাহাজের টিকিটের সর্বনিম্ন দাম ২৮ হাজার টাকা। কলকাতা থেকে তা পাওয়া যাচ্ছে টাকার হিসাবে মাত্র ১৫ হাজারে।
এবার ১০ এপ্রিল থেকে ঈদুল ফিতরের ছুটি শুরু হচ্ছে। এদিনের সিঙ্গাপুর গন্তব্যের টিকিটের দাম জানতে অনলাইন টিকিট বুকিংয়ের একাধিক ওয়েবসাইট ঘুরে এই তথ্য পাওয়া যায়।
দেশ থেকে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার আরেকটি জনপ্রিয় গন্তব্য থাইল্যান্ডের ব্যাংকক। ঢাকা ও কলকাতা থেকে উড়োজাহাজে করে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় ব্যাংকক। কলকাতা থেকে টিকিট মিলছে জনপ্রতি ১২ হাজার টাকায়। ঢাকা থেকে টিকিটের দাম ৩০ হাজার টাকা।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (টোয়াব) সদস্যরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির জন্য মানুষ চাপে আছে। তবে এর মধ্যেও উৎসবের ছুটিতে বাইরে বেড়াতে যাওয়ার আগ্রহ মানুষের আছে। তবে কম খরচে বিদেশভ্রমণের প্যাকেজ চান তাঁরা। কিন্তু উড়োজাহাজের টিকিটের চড়া দামের কারণে তা করা সম্ভব হচ্ছে না। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ডের মতো জনপ্রিয় গন্তব্যের টিকিটের চাহিদা অনেক বেশি। স্বাভাবিক সময়েই বাংলাদেশ থেকে এসব গন্তব্যের টিকিটের দাম বেশি থাকে। উৎসবের সময় তা আরও বেড়ে গেছে।
কলকাতা থেকে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর যেতে লাগে ৪ ঘণ্টা। একই গন্তব্যে ঢাকা থেকে যেতে ৩ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট লাগে। এই গন্তব্যে ঢাকা থেকে সবচেয়ে কম দামে টিকিট মিলছে ২৪ থেকে ২৫ হাজার টাকায়। কলকাতা থেকে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকায়।
উড়োজাহাজের টিকিট বিক্রি করার এজেন্সিগুলোর সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্সিজ অব বাংলাদেশ (আটাব) বলছে, উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো জ্বালানি খরচের কথা বলে টিকিটের বাড়তি দাম রাখে। উৎসবের সময় তারা দাম আরও বাড়িয়ে দেয়। দেশের ভেতরে ৪০ মিনিটের একটি ফ্লাইটের টিকিটের দাম ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা নিচ্ছে তারা। ঢাকা থেকে কলকাতা যেতে সর্বোচ্চ ৪৫ মিনিট লাগে। এখন বিমানের এই টিকিট বিক্রি হচ্ছে ১৫ হাজার টাকার বেশি দামে। এটা কোনোভাবেই যৌক্তিক হতে পারে না। এই সুযোগে অন্য সব বেসরকারি ও বিদেশি উড়োজাহাজ সংস্থা টিকিটের বাড়তি দাম নিচ্ছে।
আটাবের সভাপতি আবদুস সালাম আরেফ প্রথম আলোকে বলেন, উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর মধ্যে বাড়তি মুনাফার প্রবণতা আছে। চাহিদা বাড়লেই তারা টিকিটের দাম বাড়িয়ে দেয়। তাই সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন ভাড়ার সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত নিয়ন্ত্রক সংস্থার। একই সঙ্গে উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো ইচ্ছেমতো দামে যাতে টিকিট বিক্রি করতে না পারে, তা নজরদারিতে রাখতে হবে।
টিকিট ব্যবসায় যুক্ত এজেন্সিগুলো বলছে, করোনা মহামারিতে উড়োজাহাজ বন্ধ ছিল লম্বা সময়। এতে উড়োজাহাজ সংস্থাগুলোর লোকসান হয়। এই ঘাটতি মেটাতে করোনা-পরবর্তী সময়ে তারা টিকিটের বাড়তি দাম রাখতে শুরু করে। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান নিজেই টিকিটের বাড়তি দাম রাখে। কম দামের টিকিট আটকে রেখে বেশি দামেরটা উন্মুক্ত করে দেয়। তখন সবাই বাড়তি দামে কেনে। টিকিট নিয়ে একটি চক্র বাণিজ্য করছে।
আটাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল এইচ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, করোনা-পরবর্তী বাড়তি মুনাফা করার প্রবণতা বন্ধ হয়নি। উড়োজাহাজ সংস্থাগুলো যাত্রী বাড়ানোয় মনোযোগ দেয়নি; বরং দাম বাড়িয়ে ৫০ জন যাত্রীর কাছ থেকে ১০০ জনের ভাড়া আদায় করে নিচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বলছে, পাশের দেশে একাধিক সাশ্রয়ী উড়োজাহাজ (বাজেট এয়ারলাইনস) সেবা চালু আছে। এসব উড়োজাহাজে সব সেবা থাকে না। এগুলো কম খরচে যাত্রী পরিবহন করে। তাই এর সঙ্গে বিমানের তুলনা করা যাবে না। ৫০টির বেশি সেবা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিমানের বাধ্যবাধকতা আছে। সেটা সাশ্রয়ী উড়োজাহাজে থাকে না। তাই নিয়মিত উড়োজাহাজ সংস্থার পক্ষে বাজেট এয়ারলাইনসের দামে টিকিট বিক্রি করা সম্ভব নয়। আর বেসরকারি উড়োজাহাজের চেয়েও বেশি সেবা দেয় বিমান। যেকোনো উৎসবের সময় উড়োজাহাজের টিকিটের চাহিদা বেড়ে যায়। এবার ঈদের ছুটিতে বাড়তি যাত্রীদের স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণসুবিধা দিতে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন গন্তব্যে ফিরতিসহ ১৮টি বিশেষ ফ্লাইট দিয়েছে বিমান। ঢাকায় বিমানের নিজস্ব একাধিক টিকিট বিক্রয়কেন্দ্র আছে। অনলাইনে বিমানের ওয়েবসাইট বা মোবাইল অ্যাপলিকেশন থেকে টিকিট করা যায়। সরাসরি টিকিট করলে ১০ শতাংশ ছাড় দেওয়া হয়েছে। তাই এতে যাত্রীরা উপকৃত হবেন।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শফিউল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত মুনাফার কোনো প্রবণতা বিমানের নেই। মানুষকে সেবা দেওয়ার পাশাপাশি এটি লাভজনক রাখাই লক্ষ্য। চাহিদা বাড়লে টিকিটের দাম কিছুটা বেড়ে যায়। তবে টিকিট আটকে রাখার কোনো সুযোগ নেই কোনো এজেন্সির। যাত্রীরা আগে থেকে টিকিট কাটলে তুলনামূলক কম দাবে পাবেন। তাঁরা চাইলে অনলাইনে সরাসরি টিকিট কাটতে পারেন।
আটাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাযজারুল এইচ ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, এখানে কোনো ব্যবসায়িক নীতি নেই। কেউ কারও কথা শোনে না। এটা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখতে পারে বিমান। তারা টিকিটের দাম সহনীয় রাখলে অন্যরা রাখতে বাধ্য হবে।
টিকিটের চড়া দামের কারণে কেউ কেউ বাদ দিচ্ছেন ভ্রমণের পরিকল্পনা। এই যেমন ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা তামান্না আকতার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের ছুটিতে পরিবার নিয়ে মালয়েশিয়া বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। খরচ পোষাতে না পারায় পরিকল্পনা বাদ দিয়েছেন।