একাত্তরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেন মঈদুল হাসান। পরবর্তী সময়ে তিনি লিখেছেন মূলধারা ’৭১ এবং উপধারা একাত্তর: মার্চ-এপ্রিল নামে দুটি বই। বিভিন্ন দেশে অবমুক্ত হওয়া মুক্তিযুদ্ধের দলিলপত্র ঘেঁটে ও তাঁর নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি লিখছেন আরও একটি বই। তাঁর প্রকাশিতব্য সেই বইয়ের চতুর্দশ অধ্যায়ের তৃতীয় কিস্তি প্রকাশিত হলো আজ।
মুক্তিযুদ্ধকালে জুলাইয়ে মাকি৴ন প্রেসিডেন্টের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের ভারত-পাকিস্তান-চীন সফরের একটি তাৎপর্য রয়েছে। যে মুখ৵ উদ্দেশ্য নিয়ে কিসিঞ্জারের এতটা পথ আসা—অর্থাৎ দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে বন্ধ থাকার পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরায় চালু করার বিষয়টি গোপন রাখার যে প্রয়োজন চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের উভয়েরই ছিল, পাকিস্তান তা ঠিকভাবেই সম্পন্ন করে। গুরুতর পেটের অসুখ দেখা দেওয়ায় চিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য কিসিঞ্জারকে শৈলাবাস/নাইয়াগলিতে পাঠানো হয়েছে, এমন কথা প্রচার করে তাঁকে ৯ জুলাই সকালে বিশেষ বিমানে করে পাঠানো হয় চীনের রাজধানী পিকিংয়ে। সেখানে উদ্দেশ্য ছিল, চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাইয়ের সঙ্গে আলোচনা করে প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের চীন সফরের সময়সূচি এবং আলোচ্য বিষয় নির্ধারণ করা। যাতে পরবর্তী তিন থেকে চার মাসের মধ্যে নিক্সন চীন সফরে যেতে পারেন।
পরবর্তী দুই দিন পিকিংয়ে কিসিঞ্জার ও চৌ এনলাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন দুই দেশের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রধান বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার কাজে। এর মধ্যে কিছুটা খণ্ড খণ্ডভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান সংকট মোকাবিলার বিষয়টি উত্থাপিত হয়। ১০ জুলাই উভয় পক্ষকেই একমত হতে দেখা যায় যে পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ উৎসাহিত করার ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায৵–সহযোগিতার পেছনে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে, যার প্রতিবিধান আবশ্যক। (সূত্র: FRUS ভলিউম XVI, দলিল ৯৯)।
কিসিঞ্জার চৌকে জানান, ‘পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের জন্য আমরা কোনো রকম সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিপক্ষে এবং ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, আমরা তা জোরালো এবং প্রকাশ্যভাবেই বিরোধিতা করব।’ জবাবে চৌ এনলাই জানান, ‘তারা (ভারত) যদি এমন পরিস্থিতি সৃষ্টির মতো উসকানি দেয়, তবে আমরাও অলসভাবে বসে থাকব না।’ (FRUS, XVI, দলিল ১৪০)।
এসব কথার মধে৵ কোনো নির্দিষ্ট পদক্ষেপ অথবা কর্মসূচির উল্লেখ ছিল না। পরদিন ১১ জুলাই সকালে পাকিস্তানে ফেরত যাওয়ার আগমুহূর্তে প্রসঙ্গটি চৌ এনলাই আবার তোলেন এই বলে যে ৯ জুলাই অর্থাৎ কিসিঞ্জার যেদিন পিকিং আসেন, সেদিন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথমবারের মতো আর্টিলারির ব্যাপক গোলা বিনিময় হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানের উত্তর সীমান্তে (ভারত, ভুটান ও সিকিমের সংযোগস্থল)। চৌ জানান, ভারতের পক্ষ থেকে তিন শতাধিক আর্টিলারি গোলা নিক্ষিপ্ত হয়। পাকিস্তানের পক্ষ থেকেও তিন শতাধিক গোলা নিক্ষিপ্ত হয় এবং সন্ধ্যা নাগাদ এই আটি৴লারির আঘাত ও প্রত্যাঘাত বন্ধ হয়ে যায়। (সূত্র: অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত এবং এফ এস আইয়াজুদ্দিন সম্পাদিত: দ্য হোয়াইট হাউস অ্যান্ড পাকিস্তান, পৃ: ২০৫)।
চৌ এনলাই ও কিসিঞ্জারের মধ্যে পরের বাক্যালাপ আরও কিছুটা অর্থপূর্ণ।
প্রধানমন্ত্রী চৌ: প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে জানাতে পারেন, ভারত যদি এমনভাবে আক্রমণ চালায়, আমরা পাকিস্তানকে সমর্থন করব। আপনারাও এমন আক্রমণের বিরুদ্ধে।
কিসিঞ্জার: আমরাও তার বিরোধিতা করব, কিন্তু কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা অপারগ।
চৌ: আপনাদের অবস্থান অনেক দূরে। তবে আপনাদের সক্ষমতা যা রয়েছে, তা দিয়ে আপনারা ভারতকে এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারেন। বস্তুত আপনারা দুই পক্ষকেই সম্মত করাতে সক্ষম।
কিসিঞ্জার: আমাদের সাধে৵র সবটুকু আমরা করব। (সূত্র: প্রাগুক্ত এবং FRUS ভলিউম ১৭, দলিল ১৪৩)
এমন বাক্যালাপের অর্থ কিসিঞ্জারের জন্য খুব দুর্বোধ্য ছিল না। পাকিস্তানে চীনের দূতাবাসের মাধ্যমেই চীন সরকার তাদের অভিপ্রায়ের কথা সরাসরি পাকিস্তান সরকারকে জানাতে পারত। আত্মজীবনীমূলক হোয়াইট হাউস ইয়ার্স গ্রন্থেও কিসিঞ্জার উল্লেখ করেছেন, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিলে চীনের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে যুক্তরাষ্ট্রও অনুরূপ কোনো ব্যবস্থা নেয়, সেটাই সম্ভবত ছিল চৌ এনলাইয়ের অনুক্ত প্রত্যাশা। কিন্তু এর ওপরেই চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মীয়মাণ সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে, তেমন জিজ্ঞাসার উদয় তাঁর মনে ঘটেছিল কি না, সেটার কোনো উল্লেখ নেই।
১১ জুলাই কিসিঞ্জার চীন থেকে পাকিস্তান পৌঁছান। সেখানে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে পুনরায় আলাপ-আলোচনার পর ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি প্যারিস রওনা হন ওয়াশিংটন ফিরে যাওয়ার পথে। অল্প সময়ে তিনটি দেশের তিনজন সরকারপ্রধানের সঙ্গে অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়ে আলোচনার এমন বিরল উদ্যোগের প্রধান উদ্দেশ্য মার্কিন দৃষ্টিকোণ থেকে মুখ্যত একটিই। তা ছিল দীর্ঘ বিরতির পর চীনের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সময়সূচি ও আলোচ্য বিষয়টি নির্ধারণ করা। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফরের আগে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্রুত বেড়ে চলা সংঘাতের আবহাওয়া যথাসম্ভব প্রশমিত করা এবং পরিস্থিতি সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত না হয়।
দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা তাঁর একক সিদ্ধান্তে উত্তেজিত জনমতকে প্রশমিত করার উদ্দেশে শরণার্থী স্রোত কমাতে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সহায়তা চান। সেই অনুসারে কিসিঞ্জার ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে সম্মত করার চেষ্টা করেন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানে একজন বাঙালি গভর্নর নিয়োগ করেন, সেনাবাহিনীর হত্যা ও নিপীড়নের মাত্রা হ্রাস করে এবং সীমান্ত এলাকায় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করে একযোগে সংঘাত ও শরণার্থীর স্রোত কমানোর পরামর্শ পাকিস্তানকে দিতে শুরু করেন। পিকিংয়ে চৌ এনলাইয়ের কূটনীতির ভাষার সঠিক অর্থ তখনো সুস্পষ্ট নয়। কিন্তু উত্তেজনা কমানোর ক্ষেত্রে শক্তিশালী বাধাটি আসে অন্য এক মহল থেকে, যা নির্বিবাদেই কিসিঞ্জারকে মেনে নিতে হয়।