কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা ফিশারি ঘাটে বিক্রির জন্য রাখা ইলিশ
কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা ফিশারি ঘাটে বিক্রির জন্য রাখা ইলিশ

জলবায়ু পরিবর্তন: প্রথম আলোর অনুসন্ধান–৩

অবৈধ দাদনের জাল ঢাকা থেকে সাগরে

‘পইঠায় বসে ধোঁয়-ওঠা ভাত,

টাটকা ইলিশ-ভাজা-

ছোকানু রে, তুই আকাশের রানী,

আমি পদ্মার রাজা।’

পাঠক, মনে পড়ে বুদ্ধদেব বসুর ‘নদীর স্বপ্ন’ নামের সেই বিখ্যাত কবিতার চরণ ক’টি? কিশোর বয়সী দুই ভাই-বোন স্বপ্ন দেখে- ওদেরকে নদীভ্রমণে নিয়ে মাঝি দুপুরে টাটকা ইলিশ ভেজে খাওয়ান। সেই ইলিশের স্বাদ পেয়ে মনে মনে কিশোরটি হয়ে যায় পদ্মার রাজা; আর কিশোরীটি হয় আকাশের রানী। এমনিই রাজকীয় স্বাদ বাংলার ইলিশের। অথচ সেই ইলিশ সাধারণের নাগালের বাইরে চলে গেছে দাদনদারদের কারসাজিতে।

তিন পর্বের এই ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের দ্বিতীয়টিতে আমরা দেখিয়েছি, সর্বগ্রাসী দাদন-ব্যবস্থা কেমন করে গোটা ইলিশ-বাণিজ্যকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। আমরা দেশে প্রচলিত মাছসংক্রান্ত আইনগুলো ঘেঁটে দেখেছি, এই দাদন প্রথা মোটেও আইনসম্মত নয়। আইনের দৃষ্টিতে দাদন অবৈধ। অথচ এই অবৈধ কারবারটিই মাছেভাতে বাঙালির দেশে চলে আসছে আবহমান কাল ধরে। কেউ কখনো এই নিয়ে উচ্চবাচ্যও করেনি; প্রতিরোধের ব্যবস্থাও নেয়নি। যে কারণে মাছ–বাণিজ্যে দাদন প্রথা একটা ‘অলিখিত নিয়ম’-এ পরিণত হয়েছে।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান বলছে, এই দাদনের উৎস মূলত ঢাকা ও অন্য বড় নগরের বড় বড় আড়তদার তথা মহাজনেরা। আর তাদের রক্ষাকবচ হয়ে আছে ‘আইন থাকা সত্ত্বেও আইনের প্রয়োগ না থাকা।’

ব্রিটিশ আমলে নীলচাষিদের করায়ত্ত করতে দাদন প্রথার চল শুরু হয়েছিল। সুদের ব্যবসার মতো করে এই প্রথা চালু করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। বেশ কয়েকবার এই প্রথা চালু করে আবার রহিত করে কোম্পানি। সর্বশেষ ২০০৬ সালের এক আইন অনুসারে লাইসেন্স ও অনুমতি ছাড়া এ ধরনের লেনদেন অবৈধ করা হয়।

আইন আছে, কর্তারা হাত গুটিয়ে

২০০৬ সালে কার্যকর হওয়া ‘মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি নামের আইনে বলা হয়, যারা ক্ষুদ্রঋণ দেয় এবং সুদ নেয়, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির কাছ থেকে তাদের লাইসেন্স ও অনুমতি নিতে হবে। অনুমতি ছাড়া কেউ যদি এ ধরনের ধার বা ঋণ দেয়, তাহলে এই আইনের ৩৫ ধারা অনুযায়ী সেটা অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। কেউ এই আইন অমান্য করলে তার অন্যূন এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।

দাদনের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইলিশ আসলে কঠিন একটা চক্রে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে। দাদনের চক্র নিয়ে গবেষণা হওয়া এবং এই চক্রকে ধরা দরকার। কিছু মানুষের কারসাজিতে ইলিশের দাম বাড়ছে, যার পুরোটাই নিয়ে নিচ্ছে দাদনের চক্র; অথচ হতদরিদ্র জেলেরা সামান্যতম মূল্যও পান না।
আনিসুর রহমান, ইলিশ গবেষক ও বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা

জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আহসানুল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু ইলিশের ক্ষেত্রে ৪-৫ ধাপের ব্যবসায়ীরা একে অন্যকে দাদন দিচ্ছে এবং সেই দাদনের বিনিময় শর্ত হচ্ছে, দাদন প্রদানকারীদের কাছেই মাছ বিক্রি করতে হবে; উপরন্তু কমিশনও দিতে হবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, টাকা ধার দেওয়ার মাধ্যমে তারা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। সুতরাং এই আইনের বরখেলাপ হচ্ছে এবং এই আইন অনুযায়ী লেনদেনের (দাদন) প্রক্রিয়া অবৈধ হয়ে যাচ্ছে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান বলেন, পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের এই চক্র মৌসুমের আগেই দাদন দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে এবং এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজার নষ্ট হচ্ছে, এই দৃষ্টিকোণ থেকে প্রতিযোগিতা আইনের আওতায় প্রতিযোগিতা কমিশনও দাদনদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।

বিষয়টি নিয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রথম আলো। তাঁদের মধ্যে অথরিটির নির্বাহী পরিচালক (অর্থ ও অনসাইট সুপারভিশন) নূরে আলম মেহেদী প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক (পরিকল্পনা ও গবেষণা) মুহাম্মদ শহিদুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন। কিন্তু শহিদুল ইসলামের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়। খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।

তবে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘দাদন প্রথার বিষয়টি নিয়ে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির আইনে স্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ নেই; তাই এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।’ এর বাইরে আর কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

২০১৮ সালের কৃষি বিপণন আইনের তফসিলে কৃষিপণ্যের মধ্যে সব ধরনের মাছ (তাজা ও শুঁটকি) কৃষিপণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং এই আইনের ৪-এর (জ) ধারায় বলা হয়, ‘কৃষি বিপণন অধিদপ্তর কৃষিপণ্য ও কৃষি উপকরণের মজুত বা গুদামজাতকরণ…কার্যক্রম পরিবীক্ষণ করতে পারবে।’ এই আইনের ৪-এর (ঝ) ধারায় কৃষিপণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য ও যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করার ক্ষমতা দেওয়া হয় কৃষি বিপণন অধিদপ্তরকে।

কাজেই ইলিশ মাছও একটি কৃষিপণ্য এবং এর যৌক্তিক দাম নির্ধারণের ক্ষমতা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের আছে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় আড়তদার বা মহাজনদের একেকজন ৫০ লাখ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত দাদন দিয়ে রেখেছেন। তাঁদের টাকার উৎসের মধ্যে ব্যাংকঋণও আছে বলে স্বীকার করেছেন অনেকে।

জানতে চাইলে কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মাসুদ করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এই আইনের আওতায় ইলিশের যৌক্তিক দাম নির্ধারণের ব্যাপারে একটি কমিটি গঠন করেছি, শিগগিরই দাম নির্ধারণ করে দেব।’

এত দিনেও কেন দাম নির্ধারণ করা হয়নি জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগে কেন হয়নি, আমি জানি না। মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর আমি এই কাজ শুরু করেছি। দাম নির্ধারণের বিষয়টি যেহেতু একটা গবেষণার মতো, আমরা এই গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে আছি, এখন ডেটা কালেকশন চলছে।’

২০১২ সালের প্রতিযোগিতা আইনের ১৫ নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো পণ্য বা সেবার উৎপাদন, সরবরাহ, বিতরণ, গুদামজাতকরণ বা অধিগ্রহণসংক্রান্ত এমন কোনো চুক্তিতে বা ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আবদ্ধ হইতে পারিবে না যাহা প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে বা বিস্তারের কারণ ঘটায় কিংবা বাজারে মনোপলি অবস্থার সৃষ্টি করে।’

এই আইন প্রণয়নের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার রোধ, জোটবদ্ধতা যা দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক কর্মকাণ্ডকে নিয়ন্ত্রণ বা প্রতিরোধ করে, এসব কর্মকাণ্ডকে নির্মূল করার জন্য প্রতিযোগিতা আইন তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে প্রতিযোগিতা কমিশনের দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয়। ইলিশের বাজারে ৫ ধাপের ব্যবসায়ীদের দাদনের মাধ্যমে ইলিশের বাজার নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রতিযোগিতা আইনের খেলাপ বলে মানেন তাঁরা। তবে কমিশনের পক্ষ থেকে ইলিশের ব্যাপারে চলতি মৌসুমে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি জানিয়ে কমিশনের সচিব মাহবুবুর রহমান খান প্রথম আলোকে বলেন, কেউ অভিযোগ জানালে বা গণমাধ্যমে এ ব্যাপারে সংবাদ প্রকাশিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

‘এ পর্যন্ত কেন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি সে ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি কমিশনের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন সালমা আখতার জাহানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। সালমা আখতার জাহানের মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে তিনি ধরেননি; খুদে বার্তা পাঠানো হলেও সাড়া দেননি।

আর ২০০৯ সালের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে পণ্যের দাম প্রদর্শনের বিধান আছে। আইনের ৩৮ নম্বর ধারায় বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তি কোনো আইন বা বিধি দ্বারা আরোপিত বাধ্যবাধকতা অমান্য করিয়া তাহার দোকান বা প্রতিষ্ঠানের সহজে দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যের মূল্যের তালিকা লটকাইয়া প্রদর্শন না করিয়া থাকিলে তিনি অনূর্ধ্ব এক বৎসর কারাদণ্ড বা অনধিক পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।’

তবে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের চলতি বছরের কার্যকলাপ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ভোক্তার ইলিশ ভোগের অধিকারের বিষয়ে রাজধানীতে চালানো হয়েছে মাত্র একটি অভিযান। গত ২৫ সেপ্টেম্বর ভোরে রাজধানীর বড় দুই পাইকারি মাছবাজার যাত্রাবাড়ী ও কারওয়ান বাজারে চালানো অভিযানে কারওয়ান বাজারের ৫ ব্যবসায়ীকে মোট ৪২ হাজার টাকা জরিমানা করেন কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মণ্ডল। ইলিশ ক্রয়-বিক্রয়ের কোনো রসিদ না থাকা এবং ক্রয় মূল্য ও বিক্রয় মূল্য সম্পর্কে কোনো তথ্য না পাওয়ায় এ জরিমানা করা হয়।

তবে এ ধরনের অভিযান কোনো সমাধান নয় বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরেরই ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যদি কোনো পণ্যের মূল্য ধার্য করা থাকে, সে ক্ষেত্রে আমরা সরাসরি পদক্ষেপ নিতে পারি। কিন্তু ইলিশের মতো পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্য ধার্য করা থাকে না।’

কেন থাকে না প্রশ্ন তুললে বিকাশ চন্দ্র দাস বলেন, যেহেতু বাংলাদেশ উন্মুক্ত বাজারব্যবস্থা অনুসারে চলে এবং এখানে পূর্ণ প্রতিযোগিতামূলক বাজার বিদ্যমান; তাই শুধু অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের ক্ষেত্রে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইন অনুসারে দাম ধার্য করা থাকে এবং এই ধার্য মূল্য না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার এই অধিদপ্তরের আছে। অন্যান্য পণ্যের বেলায় যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়, তবে সেটি ফিক্সড না; বাজারে সেই দাম ওঠানামা করতে পারে।’

ইলিশের চক্র এবং দাম ওঠানামার বিষয়ে দেশের মৎস্যসম্পদ নিয়ে কাজ করা সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু করার আছে কি না’ জানতে চাইলে চাঁদপুরের ‘বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট’-এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু কাওসার দিদার বলেন, এসব বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তর বলতে পারবে। পরে মৎস্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো. আবদুর রউফ প্রথম আলোকে বলেন, দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইলিশের দাদন চক্রের বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তরের বিস্তারিত জানা নেই; তাই এ ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিস্তারিত জানতে পারলে তাঁরা অধিদপ্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করবেন।

বিক্রির জন্য টুকরিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে মাছ।

রাজধানীতেই দাদন রাজারা

১ অক্টোবর, দুপুর সাড়ে ১২টা। কারওয়ান বাজারের ১ নম্বর ডিআইটি মার্কেটের দোতলায় ছোট কক্ষগুলোতে মাছের আড়তদারেরা বিক্রিবাট্টা শেষে হিসাব কষতে বসেছেন। ইলিশের কারবার করেন এমন আড়তদারের খোঁজ করতে গেলে সবাই মোহাম্মদ জাকিরের নাম বললেন। চলতি মৌসুমে কারওয়ান বাজারে ইলিশের বড় আড়তদার হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন জাকির।

মোহাম্মদ জাকিরের সঙ্গে কয়েক দফায় যোগাযোগের পর তিনি কথা বলতে রাজি হন। জাকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমানে ইলিশের বাজার খুব খারাপ। আমি ব্যবসা করে শান্তি পাইতেছি না।’ এ বছর আমি কক্সবাজারের ইলিশ বেশি বিক্রি করছি। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও বরগুনা থেকে মাছ আসে। তবে গতবারের চেয়ে এবার মাছ কম, যা আসছে পটুয়াখালীর কলাপাড়ার মহিপুর থেকে।’

১ অক্টোবর এ মৌসুমের সবচেয়ে কম ইলিশ পেয়েছেন জাকির। ২১ কেজি ওজনের চারটি কার্টনে মাছ এসেছে তাঁর। এসব মাছ ওজনভেদে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬০০ টাকা কেজি দরে পাইকারি বিক্রি করেছেন তিনি।

কারওয়ান বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা কমিটির তথ্য বলছে, কারওয়ান বাজারে মাছের আড়তদার আছেন ৫০০ জন। তবে ইলিশের কারবার নিয়ন্ত্রণ করছেন ৫০ জনের কম। মোহাম্মদ জাকিরের মতো এঁরা বড় আড়তদার বা মহাজন। কারওয়ান বাজার থেকে ইলিশ কিনতে হলে এই ৫০ মহাজনের কাছ থেকেই কিনতে হবে।

ইলিশের বাজার নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে আড়তদারেরা মৌসুমের কয়েক মাস আগে, এমনকি কয়েক বছর আগেও স্থানীয় পর্যায়ের পাইকার ও আড়তদারদের মোটা অঙ্কের দাদন দেন। যে আড়তদার যত বেশি টাকা দাদন দিতে পারেন, তাঁর হাতেই সবচেয়ে বেশি ইলিশের নিয়ন্ত্রণ থাকে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুজন আড়ত-নেতা, চারজন আড়তদার এবং কয়েকজন খুচরা ব্যবসায়ী ও আড়তের কর্মচারীদের সঙ্গে দফায় দফায় কথা বলে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। সবার বক্তব্যের সারাংশ হলো রাজধানীসহ দেশের বড় শহরগুলোর আড়তদারেরাই ইলিশ-বলয়ে দাদনের মূল অংশীদার। তাদের টাকা চার থেকে পাঁচ হাত ঘুরে জেলেদের হাতে যায়। মোহাম্মদ জাকির তেমনই একজন আড়তদার। চলতি বছর ইলিশের বাজার খারাপ হতে পারে, এমন আশঙ্কা জেনেও ১৪ থেকে ১৫ লাখ টাকা দাদন ছড়িয়েছেন তিনি। এভাবে প্রতিবছর তাঁর দেওয়া দাদন জমে এখন সেটা কোটি টাকার ঘর পেরিয়েছে।

মাছ ব্যবসায়ীরা শুধু ইলিশ না, অন্য সব মাছের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ায় দাদন দিচ্ছেন। দাদনের বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো দিন প্রশ্ন তোলেনি।
নসরুল আলম, কারওয়ান বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি

মোহাম্মদ জাকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভোলা, মনপুরা, কক্সবাজার এবং বরগুনায় আমার দাদন দেওয়া আছে। আমার দাদনের টাকা এক মৌসুমের নয়। এগুলো কয়েক বছর ধরে ওদের হাতে আছে। প্রতিবছর এই দাদনের ওপর আরও দাদন দেওয়া হয়।’

যাত্রাবাড়ী মৎস্য আড়তের সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আড়তদারেরা কোটি কোটি টাকা দাদন দেন, কারণ আগে থেকে পুঁজি বিনিয়োগ না করলে মোকামমালিক (স্থানীয় আড়তদার) বা পাইকারেরা মৌসুমের সময় মাছ দেন না।’

তাঁর হিসাব অনুযায়ী, যাত্রাবাড়ীতে আড়তদারের সংখ্যা দুই হাজারের আশপাশে; তবে ইলিশের নিয়ন্ত্রণ ১০০-র মতো মহাজনের হাতে।

আড়ত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, ঢাকায় কোনো বাজারের আড়তে ইলিশ দরদামের মাধ্যমে বিক্রি হয়; আবার কোনো বাজারের আড়তে বিক্রির পর নির্দিষ্ট হারে কমিশন নেন আড়তদারেরা। এই কমিশন ৩ থেকে ১০ শতাংশ পর্যন্ত হয়ে থাকে। তবে খাতা–কলমে ৪ শতাংশের বেশি দেখানো হয় না। এর বাইরে প্রতি কেজি ইলিশে ১০ টাকা কয়াল (কর্মচারীদের বেতন, আড়তের ভাড়া ও অন্যান্য খরচ) রাখা হয়। এই টাকাও ইলিশের দামের সঙ্গে যুক্ত হয়।

সাগরে এখন ধরা পড়ছে বড় আকারের ইলিশ। জালে এসব ইলিশ ধরা পড়ায় খুশি জেলেরা। চট্টগ্রামের ফিশারিঘাটে

দাদনের আইনি কোনো ভিত্তি না থাকলেও যুগের পর যুগ ধরে এই প্রথা চলে আসছে—মন্তব্য কারওয়ান বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি নসরুল আলমের। প্রথম আলোকে নসরুল বলেন, ‘মাছ ব্যবসায়ীরা শুধু ইলিশ না, অন্য সব মাছের ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ায় দাদন দিচ্ছেন। দাদনের বিষয়টি নিয়ে কেউ কোনো দিন প্রশ্ন তোলেনি।’

এঁদের সবার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বড় আড়তদার বা মহাজনদের একেকজন ৫০ লাখ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত দাদন দিয়ে রেখেছেন। তাঁদের টাকার উৎসের মধ্যে ব্যাংকঋণও আছে বলে স্বীকার করেছেন অনেকে।

খুচরায় কেজিতে ২৫০ টাকাও বাড়ে

ঢাকায় মৎস্য আড়ত ও পাইকারি মাছের বাজার আছে অন্তত ১০টি। সবচেয়ে বড়টি যাত্রাবাড়ীতে। ২ অক্টোবর সকালে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, ফ্লাইওভারের নিচ থেকে শুরু করে মহাসড়কের দুই দিকে বিশাল মাছের বাজার। সকাল তখন আটটা পেরিয়েছে। বাজারের পূর্ব দিকের অংশের মাঝামাঝিতে কয়েকটি আড়তে ইলিশ বিক্রি হতে দেখা গেল। সোয়া থেকে দেড় কেজি ওজনের ইলিশের দাম হাঁকা হচ্ছে ১৬০০-১৮০০ টাকা কেজি; এক কেজি বা এর আশপাশেরটা ১৩০০-১৪০০ টাকা, ৮০০ গ্রামের নিচে ৯০০-১০০০ টাকা, ৫০০ গ্রামের নিচে ৪০০-৫০০ টাকা কেজি।

নয়ন এন্টারপ্রাইজ ও মেসার্স মেহেন্দীগঞ্জ ফিশের সাইনবোর্ড যেখানে ঝুলছে, তার পাশে দাঁড়িয়ে দেখা গেল তিনজনের একটি দল এসে ইলিশ দরদাম করছে। নয়ন এন্টারপ্রাইজ সাইনবোর্ডটা যেখানে, সেখান থেকে বিভিন্ন ওজনের এক মণ মাছ কিনলেন তাঁরা। জানা গেল, দলনেতার নাম প্রদীপ রায়। তিনি সোয়া কেজি থেকে দেড় কেজি ওজনের ১০ কেজি ইলিশ কিনলেন কেজিপ্রতি ১৭৫০ টাকা দরে। ১৪৫০ টাকা দরের এক কেজি ওজনের ইলিশ কিনলেন ১০ কেজি, ৮০০ গ্রামের কিনলেন ১০ কেজি- প্রতি কেজি ১২০০ টাকা। জানা গেল, তাঁরা শনির আখড়ার জিয়া সরণির মাছবাজারের খুচরা ব্যবসায়ী।

বেলা ১১টায় জিয়া সরণির মাছ বাজারে গিয়ে ছয়জন বিক্রেতাকে ইলিশ বেচতে দেখা গেল। তাঁদের মধ্যে প্রদীপ বাবুর দোকানও রয়েছে। তিনি যাত্রাবাড়ীতে কেনা ইলিশগুলো চার শ্রেণিতে ভাগ করে বিক্রির জন্য সাজিয়েছেন-দেড় কেজি, সোয়া কেজি, এক কেজি এবং ৮০০ গ্রাম। দেড় কেজি ওজনের ইলিশ চাইছেন ২২০০ টাকা, সোয়া কেজি ১৯০০ টাকা, এক কেজি ও এর আশপাশের ওজনের ১৭০০ টাকা এবং ৮০০ গ্রামের ইলিশ চাইছেন ১৪০০ টাকা কেজি করে। আশপাশের দোকাগুলোও একই দাম হাঁকছে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খানের মতে, যেহেতু ইলিশ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিকভাবে এবং এর উৎপাদনে কোনো খরচ নেই; তাই ইলিশ সংগ্রহ বা আহরণের ক্ষেত্রে যে খরচ হয়, সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে এই দাম নির্ধারণ করা যায়।

বেলা একটা পর্যন্ত মাছবাজারে ঘুরে প্রদীপ বাবুর দোকান থেকে কাউকে ইলিশ কিনতে দেখা গেল না। ইলিশের ক্রেতারা সন্ধ্যার দিকে আসতে পারেন বলে জানালেন মাছ ব্যবসায়ীরা। অগত্যা নিজেই ক্রেতা হয়ে ইলিশ কিনতে গেলে প্রদীপ বাবুর সহকারী মোহাম্মদ হারুন মাছ ধরে ধরে দেখালেন। পরে দেড় কেজি ওজনের ইলিশ একদাম দুই হাজার টাকা কেজি পড়বে বলে জানালেন। সোয়া কেজির পড়বে ১৮০০ আর এক কেজির ইলিশ একদাম ১৬০০ টাকা করে।

ভারতে রপ্তানি বেশি দামে

সরকারের পক্ষ থেকে কেজিপ্রতি ইলিশের রপ্তানি মূল্য ১০ ডলার (প্রায় ১২০০ টাকা) বেঁধে দেওয়া হলেও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি দামেই ভারতে ইলিশ রপ্তানি চলছে। কারওয়ান বাজার মৎস্য ব্যবসায়ী সমিতির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রপ্তানি হচ্ছে কেজিপ্রতি ১৫ থেকে ২০ ডলার করে; বাংলাদেশি টাকায় যা ১৮০০ থেকে ২৪০০ টাকা।

‘তাহলে সরকার যে ১০ ডলার দাম বেঁধে দিয়েছে?’- প্রশ্ন তুললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কারওয়ান বাজারের একজন শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী বললেন, ‘যারা ভারতে মাছ রপ্তানি করছেন তাঁদের সঙ্গে ভারতের ব্যবসায়ীদের সরাসরি যোগাযোগ হচ্ছে। তাঁরা তাঁদের বোঝাপড়া করা দামেই বেচাকেনা করছেন; কিন্তু খাতা–কলমে ১০ ডলার করেই দেখানো হচ্ছে। এই লেনদেন তো আর সরকারের পক্ষ থেকে তদারকি করা হচ্ছে না।’

দাদনের সমাধান কী

ইলিশের পাঁচ স্তরের চক্রকে আইনের আওতায় আনা এবং দাদনের জাল থেকে জেলেদের বের করে আনতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন আইনজ্ঞ এবং ইলিশ বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি ইলিশের যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করে জনগণকে সেই দামের ব্যাপারে অবহিত করা হলে মানুষ ইলিশ কেনার ক্ষেত্রে সচেতন হবে বলে মন্তব্য তাঁদের।

কৃষি বিপণন আইনের আওতায় ইলিশের একটা যৌক্তিক দাম নির্ধারণ করতে পারে অধিদপ্তর-বললেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিহাব উদ্দিন খান। তাঁর মতে, যেহেতু ইলিশ উৎপাদন হয় প্রাকৃতিকভাবে এবং এর উৎপাদনে কোনো খরচ নেই; তাই ইলিশ সংগ্রহ বা আহরণের ক্ষেত্রে যে খরচ হয়, সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে এই দাম নির্ধারণ করা যায়।

তবে সবার আগে জেলেদের দাদনের জাল থেকে বের করতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ইলিশ গবেষক আনিসুর রহমান। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের এই সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘দাদনের এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইলিশ আসলে কঠিন একটা চক্রে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা পড়ে আছে। দাদনের চক্র নিয়ে গবেষণা হওয়া এবং এই চক্রকে ধরা দরকার। কিছু মানুষের কারসাজিতে ইলিশের দাম বাড়ছে, যার পুরোটাই নিয়ে নিচ্ছে দাদনের চক্র; অথচ হতদরিদ্র জেলেরা সামান্যতম মূল্যও পান না।’

জেলেদের এই অবস্থা থেকে বের করে আনতে পারলে এ প্রথা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হওয়া সম্ভব বলে জানান আনিসুর রহমান। তিনি বলেন, জেলেদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সচেতন করে তুলতে হবে, তাঁদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বল্প সুদে ঋণ দিয়ে, অনুদান দিয়ে সরকারিভাবে জেলেদের উদ্ধার করতে হবে। জেলেরা অভাবগ্রস্ত থাকেন বলেই দাদনদারেরা সুযোগটা নেন। জেলেরা যদি সংসার চালানোর মতো সংস্থান করতে পারতেন, তাহলে তাঁরা এই চক্রের মধ্যে পড়তেন না।

* (ইলিশ নিয়ে তিন পর্বের অনুসন্ধানের শেষ পর্ব)