কাউন্সিলরই পাহাড় কাটেন, সহায়তা দেন অন্যদেরও 

পাহাড় কাটার অভিযোগে উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলমের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। 

পাহাড় কেটে করা হয়েছে প্লট। গড়ে উঠেছে ঘর। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের লেকসিটি এলাকায়

চট্টগ্রাম নগরের আকবর শাহ এলাকার উত্তর পাহাড়তলী মৌজার খতিয়ানে ১৭৮ নম্বর দাগে তিনটি পাহাড়ের কথা উল্লেখ আছে। সেখানে ১২ শতক জমির মালিক ওই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহুরুল আলম ওরফে জসিম এবং তাঁর স্ত্রী তাছলিমা বেগম। এই সুযোগই কাজে লাগিয়েছেন জহুরুল। পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, তিনটি পাহাড়েই কোপ পড়েছে কাউন্সিলরের লোকজনের। পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করে বিক্রি করছেন তিনি। সেখানে রয়েছে তাঁর গরুর খামারও।

পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, ৮ দশমিক ৬০ একরের তিনটি পাহাড়ের মাত্র ২০ ভাগ এখন অবশিষ্ট আছে। পাহাড়ি ভূমির মধ্যে এক একরের মতো ব্যক্তিমালিকানাধীন, বাকি পাহাড় সরকারি বিভিন্ন সংস্থার। 

একইভাবে পাশের বেলতলীঘোনা নামের আরেকটি এলাকায় রয়েছে তিন একরের একটি পাহাড়। সেই পাহাড় কেটে জহুরুল তাঁর বাবা আবিউল হকের নামে একটি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় করেছেন। সেখানে ৫০ শতাংশ পাহাড় কাটা শেষ। এর আধা কিলোমিটার দূরত্বে
সরকারি পাহাড় কেটে (১৭৭ দাগ) ও কালিরছড়া ভরাট করে গড়ে তুলেছেন ব্যক্তিগত কার্যালয় ও আরেকটি গরুর খামার।

এ তিন এলাকায় পাহাড় কাটার অভিযোগে জহুরুল ও তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় তিনটি মামলা করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। সর্বশেষ মামলাটি হয় গত বছরের আগস্টে। কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। 

আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটা বন্ধের বিষয়ে আগেই হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। কাউন্সিলরই মূলত এর হোতা। আমরা বিষয়টি আবার আদালতের নজরে এনেছি। কাউন্সিলর একটি বাহিনী গড়ে তুলে সেখানে পাহাড় ও ছড়া ধ্বংস করে ফেলেছেন।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, প্রধান নির্বাহী, বেলা

এ বিষয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক হিল্লোল বিশ্বাস বলেন, আগের ঘটনায় বেশ কয়েকটি মামলা হয়েছে। নতুন করে পাহাড় কাটার অভিযোগ পাওয়ার পর সিডিএ, সিটি করপোরেশনের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়েছে। তারা পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দেবে।

এভাবে আকবর শাহ এলাকায় প্রতিদিন পাহাড় কেটে নতুন নতুন প্লট তৈরির কাজ চলছে। বাইরের কেউ ওই এলাকায় ঢুকলেই বাধার মুখে পড়েন। সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকেন এক দল যুবক। পাহাড় কাটা ও ছড়া ভরাটের স্থান পরিদর্শনে গিয়ে গত বৃহস্পতিবার দুপুরে কাউন্সিলর ও তাঁর লোকজনের বাধার মুখে পড়েন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ বেলার একটি দল। এ সময় রিজওয়ানা হাসানের গাড়িতে ঢিল ছুড়ে মারমুখী আচরণ করা হয়। এ ঘটনায় আকবর শাহ থানায় কাউন্সিলর জহুরুল আলমকে প্রধান আসামি করে মামলা হয়েছে। 

স্থানীয় লোকজন জহুরুলের বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক ও পরিবেশ অধিদপ্তরে পাহাড় কাটার অভিযোগ দিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবেশকর্মী মো. শফিকুল ইসলাম খান গত ২৮ ডিসেম্বর লিখিত অভিযোগে বলেন, ২০১৪ সাল থেকে পাহাড় কাটা শুরু করেন জহুরুল আলম। এলাকার পাহাড় কাটার নিয়ন্ত্রণ মূলত তাঁর সহযোগীদের হাতে। এলাকাভিত্তিক অন্তত ১২ জনের একটি গ্রুপ রয়েছে তাঁর। তিনি নিজে কাটার পাশাপাশি ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় কাটার ঠিকাদারি করেন তাঁর অনুসারীরা। 

পরিবেশকর্মী ও স্থানীয় সূত্র জানায়, পাহাড় কেটে তৈরি হওয়া প্রতিটি তিন ও পাঁচ কাঠার প্লট ৩ থেকে ১০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। ১০০-এর মতো প্লট বিক্রি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে জহুরুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পাহাড় কে কাটছে, কারা কাটছে আমি জানি না। আমার ওয়ার্ডের অর্ধেক লোক থাকে পাহাড়ে। পাহাড় কেটে তারা হয়তো বাড়িঘর করে। এখন সবাই পরিচয় দেয় কাউন্সিলরের লোক।’ পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার বিষয়টি তুললে তিনি এড়িয়ে যান।

নগরের এ কে খান এলাকা থেকে বিশ্বকলোনি হয়ে আকবর শাহ থানাধীন লেকসিটি আবাসিক এলাকায় যেতে হয়। এর পাশেই উত্তর পাহাড়তলী মৌজার পাহাড়। লেকসিটি আবাসিকে যাওয়ার জন্য পাহাড় কেটে গড়া সড়কটি অপর প্রান্তে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ সংযোগ সড়কের সঙ্গে মিশেছে। ফলে যোগাযোগসুবিধা বাড়ায় এ এলাকার জায়গার চাহিদাও বেড়েছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, লেকসিটি এলাকায় এখন পাহাড় কেটে সমতল করে ফেলা হয়েছে। এর পাশে রয়েছে আরও অনেক প্লট। এসব প্লটে দেওয়া আছে সীমানাদেয়াল। কয়েকটি প্লটে ঘরবাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে।

জহুরুল আলম আবার আওয়ামী লীগের উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের যুগ্ম আহ্বায়ক। দলীয় লোকজনের পাহাড় কাটার বিষয়টি স্বীকার করেছেন উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সরোয়ার মোরশেদও। 

লেকসিটি এলাকায় অব্যাহত পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে হাইকোর্টে রিট করে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)। এতে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসকের পাশাপাশি স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরকে বিবাদী করা হয়। রিটে আকবর শাহ থানা এলাকার উত্তর পাহাড়তলী মৌজার সাড়ে ১০ একর পাহাড় কাটা হয় বলে অভিযোগ করা হয়েছিল। পরে ২০২০ সালে ওই এলাকার পাহাড় রক্ষার বিষয়ে আদালত রুল জারি করেছিলেন।

 বেলার প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘আকবর শাহ এলাকায় পাহাড় কাটা বন্ধের বিষয়ে আগেই হাইকোর্টের নির্দেশনা ছিল। কিন্তু পাহাড় কাটা বন্ধ হয়নি। কাউন্সিলরই মূলত এর হোতা। আমরা বিষয়টি আবার আদালতের নজরে এনেছি। কাউন্সিলর একটি বাহিনী গড়ে তুলে সেখানে পাহাড় ও ছড়া ধ্বংস করে ফেলেছেন।’