‘বাবারে, অনেক ধোঁয়া, আগুন বাড়ছে...তুই এখন কোথায়’

ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পরও আহাজারি করছিলেন আলেয়া বেগম
ছবি: আসাদুজ্জামান

আলেয়া বেগমের বয়স যখন ১০ কী ১২ বছর। পদ্মার ভাঙনে আলেয়াদের ভিটেমাটি বিলীন হয়ে যায়। তখন বাবার হাত ধরে মুন্সিগঞ্জ থেকে ঢাকায় আসেন তিনি। বাবা আবদুস সামাদ ঢালী আলেয়াদের নিয়ে জুরাইনে থিতু হন। কাজ নেন সেখানকার একটি মিষ্টির দোকানে। সীমিত আয়ের সংসারে আলেয়াসহ সাত ভাইবোনকে বড় করেন।

আলেয়া লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। অল্প বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কোলজুড়ে আসে দুই ছেলে। বড় ছেলে হারুনুর রশীদ ওরফে রাশেদ। আর ছোট ছেলে আশিক হোসেন। ছোট ছেলের বয়স যখন এক বছর, তখন স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়।

দুই ছেলেকে নিয়ে তখন অথই সাগরে পড়ে যান তিনি। নিরুপায় আলেয়া গৃহকর্মীর কাজ করে দুই সন্তানকে বড় করে তোলেন। একপর্যায়ে নিজের সঞ্চয় আর আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে ধার করে বড় ছেলে হারুনকে পাঠান সিঙ্গাপুরে।

আগুন লাগার পর ব্যবসায়ীরা অল্প কিছু মালপত্র বের করে আনেন

প্রবাসে ১১ বছর কাটিয়ে বছর তিনেক আগে ঢাকায় ফেরেন হারুন। বিদেশের কষ্টার্জিত আয় দিয়ে ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটে একটি দোকান ভাড়া করেন। নাম দেন সুলতান ফ্যাশন। দোকানটিতে শুধু প্যান্ট বিক্রি করতেন। ঈদের আগে বেচাকেনা বেশি হয়। এ জন্য তাঁর কাছে যা পুঁজি ছিল, তা দিয়ে তিনি প্যান্ট তুলেছিলেন। এ ছাড়া পরিচিতজনদের কাছ থেকেও ধার করেছিলেন কয়েক লাখ টাকা। সব মিলিয়ে তাঁর দোকানে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার মালপত্র ছিল।

ছুটির দিন হওয়ায় গত শুক্রবার রাতে বেচাকেনা ভালো হয়। রাত তিনটার দিকে দোকান বন্ধ করেন হারুন। বাসায় ফিরে সাহ্‌রি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। ভোর ছয়টার দিকে হারুনের মুঠোফোন বেজে ওঠে। খবর পান ঢাকার নিউ সুপার মার্কেটে আগুন লেগেছে। পুরান ঢাকার রায়সাহেব বাজার থেকে দ্রুত রিকশা নিয়ে চলে আসেন নিউ সুপার মার্কেটে। তখন আগুনের লেলিহান শিখা আর ধোঁয়ার কুণ্ডলী মার্কেটের তৃতীয় তলায়।

কিছুক্ষণ পর আলেয়া বেগমও ছুটে আসেন ঘটনাস্থলে। চোখের সামনে ছেলের দোকান আগুনে পুড়ছে। এই দৃশ্য দেখে আহাজারি করতে থাকেন। এক স্বজনকে মুঠোফোনে বলতে থাকেন, ‘আমাদের দোকান পুড়ে গেছেরে…।’

একপর্যায়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজের দোকানে চলে যান হারুন। সেখান থেকে অল্প কিছু প্যান্ট বের করে আনেন। তবে প্রচণ্ড ধোঁয়া আর আগুনের তাপে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। এর পর আর নিজের দোকানে ঢুকতে করতে পারেননি।

ছেলে প্যান্ট আনতে ভেতরে যাওয়ার পর আলেয়া মুঠোফোনে কিছুক্ষণ পরপর হারুনকে বলছিলেন, ‘বাবারে, অনেক ধোঁয়া। আগুন বাড়ছে। আর তুই এখন কোথায়? আর দোকানের ভেতর ঢুকিস না…।’

শনিবার সকাল সাড়ে সাতটা থেকে বেলা সাড়ে তিনটা পর্যন্ত আলেয়া বেগম নিউ সুপার মার্কেটের পদচারী–সেতুতে চুপ করে বসে থাকেন। কিছুক্ষণ পরপর বিলাপ করে একটা কথাই বলছিলেন, ‘আমার জীবনটা অনেক দুঃখের...।’

আসলেই আলেয়ার জীবনসংগ্রাম অন্যদের থেকে আলাদা। স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর একটা সময় তিনি ভাত বিক্রি শুরু করেন। রায়সাহেব বাজার এলাকায় ভাড়া বাসায় থেকে ভাত বিক্রির টাকায় দুই ছেলেকে বড় করেন।

যোগাযোগ করা হলে রোববার আলেয়া বেগম মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে দুই ছেলেকে বড় করেছি। দোকান করায় ভালোই ছিলাম। কিন্তু ঈদের আগে বড় ছেলের দোকান পুড়ে গেল। অনেক টাকার ঋণ আছে। এখন কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।’

কষ্টের দোকান আগুনে পুড়ে যাওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েছেন হারুন। রোববার তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ঋণ আছে ১১ লাখ টাকার। আবার দোকানের মালপত্র পুড়েছে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকার। এখন কীভাবে আবার ঘুরে দাঁড়াব?’

শনিবার ভোরের ভয়াবহ আগুনে ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় হারুনের মতো আরও কমপক্ষে ২৫০টি দোকান পুড়ে গেছে। বেশির ভাগই কাপড়ের দোকান। অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতির পরিমাণ ২৫০ কোটি টাকার মতো হবে বলে প্রাথমিকভাবে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।