এফএওর প্রতিবেদন

খাদ্য উৎপাদন বাড়বে ৮ লাখ টন, তবু খাদ্য নিরাপত্তাহীন সোয়া কোটি মানুষ

গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের সেপ্টেম্বরে মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২.৪% বেড়েছে, যা ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে মানুষের খাবার কেনার সামর্থ্য কমেছে।

মাঠ থেকে বোরো ধান নিয়ে বাড়ি যাচ্ছেন কৃষকেরা। সম্প্রতি নওগাঁর বোয়ালিয়া এলাকায়
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশে এ বছর রেকর্ড পরিমাণ ধানসহ দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও)। তবে দাম বেশি থাকায় মানুষের কেনার সামর্থ্য কমে যাচ্ছে।

গ্লোবাল ইনফরমেশন অ্যান্ড আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম অন ফুড অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার শীর্ষক প্রতিবেদনে এমন পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। প্রতিবেদনটি ১০ নভেম্বর প্রকাশ করা হয়েছে।

এফএও মনে করছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর ৭ লাখ ৯৩ হাজার টন বেশি খাদ্যশস্য উৎপাদন হতে পারে। এর মধ্যে বোরো ধান উৎপাদনে নতুন রেকর্ড হতে পারে, ৩ কোটি ১০ লাখ টন। ফলে এবার সামগ্রিকভাবে খাদ্যশস্য কম আমদানি করতে হবে। তবে খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যপণ্য কেনার সক্ষমতা কমছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খাদ্যনিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে এফএও প্রতি দুই–এক বছরে প্রতিটি দেশের খাদ্যশস্যের উৎপাদন নিয়ে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাকে।

এফএওর প্রতিবেদনে সর্বশেষ সমন্বিত খাদ্য নিরাপত্তাসংক্রান্ত গবেষণার (ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন বা আইপিসি) তথ্য উল্লেখ করে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া নিয়েও তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খাদ্যপণ্যের দাম বেশি থাকায় বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের খাদ্যপণ্য কেনার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। এ বছরের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে করা জরিপে দেখা গেছে, দেশের ১ কোটি ১৯ লাখ মানুষ তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছে। এর আগের তিন মাস মার্চ থেকে এপ্রিলে এমন মানুষের সংখ্যা ছিল ৮৯ লাখ। অর্থাৎ এ দুই জরিপের মধ্যবর্তী সময়ে খাদ্যসংকটে থাকা মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ৩০ লাখ।

জানতে চাইলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বছর দেশে চালের যথেষ্ট পরিমাণে ভালো উৎপাদন হয়েছে। আশা করি, আমাদের কোনো চাল আমদানি করতে হবে না। কৃষকদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণে লাভ ধরে সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করায় দেশের ভেতর থেকে আমরা সরকারি গুদামের জন্য প্রয়োজনীয় মজুত সংগ্রহ করতে পারব। আর খাদ্য মজুত ভালো থাকায় আমরা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে চাল–গমের বণ্টন বাড়িয়েছি। ফলে দেশের কোনো গরিব মানুষ খাদ্যসহায়তার বাইরে নেই।’
   
তবে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরির ভাষ্য, ‘কোভিডের পর থেকে বাংলাদেশের খাদ্যপরিস্থিতি সংকটে আছে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণেও চাপ তৈরি হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে ডলারসংকট এই সমস্যাকে তীব্র করে তুলেছে।’ তাঁর মতে, শুধু খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি যথেষ্ট হবে না।

খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে কেন

খাদ্য উৎপাদন বাড়ার পরও কেন খাদ্য নিরাপত্তাহীন মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তার কিছু কারণ এফওএর প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হিসেবে খাদ্য মূল্যস্ফীতিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০২২ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণে উৎপাদন খাদ্যের সহজপ্রাপ্যতা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিয়েছে। কিন্তু দাম বেড়ে যাওয়ায় দরিদ্র ও বিপদাপন্ন পরিবারগুলোর খাবার কেনার সক্ষমতা কমে গেছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে গত বছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় এ বছরের সেপ্টেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ দশমিক ৪ শতাংশ বেড়েছে, যা গত ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। মূল্যস্ফীতির ফলে দেশের ভেতরেও খাদ্যের উৎপাদন ও পরিবহন খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

এফওএর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে ডলারের দাম প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে। এতে করে খাদ্যসহ নিত্যপণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে গেছে। ডলারসংকট ও ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের জেরে প্রয়োজনীয় আমদানি অব্যাহত রাখা সরকারের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এ বছর ১১ লাখ টন গম উৎপাদন হবে বলে আশা। দেশের গমের চাহিদার ৮০ শতাংশ আমদানি করে মেটানো হয়। এরই মধ্যে দেশবাসীর দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য গমের আমদানি সবচেয়ে বেশি কমেছে। সাধারণভাবে দেশে ৮৬ লাখ টন গমের আমদানি চাহিদা থাকলেও এ বছর তা কমে ৬১ লাখ টন হতে পারে। আর দেশে ভুট্টার আমদানি হতে পারে ২১ লাখ টন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের হিসেবে সরকারি গুদামে বর্তমানে ১৪ লাখ ৪০ হাজার টনের মতো চাল রয়েছে। আর ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে প্রতি কেজি চাল এখন ৪৪ থেকে ৪৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর খোলা আটা বিক্রি হচ্ছে ৪৪ থেকে ৪৬ টাকায়। এ দুটি পণ্যের দাম গত এক মাসে যথাক্রমে ২ ও সাড়ে ৩ শতাংশ বেড়েছে।

‘শুধু খাদ্যসহায়তা দিয়ে বিপদ কাটানো যাবে না’

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের মোট উৎপাদিত চালের ৫৫ শতাংশ বোরো, ৩৫ শতাংশ আমন ও ১০ শতাংশ আউশ থেকে আসে। চলতি বছর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে সামগ্রিকভাবে আমনের উৎপাদন ভালো হয়েছে। চট্টগ্রামে ভারি বৃষ্টি ও বন্যার কারণে আমনের ক্ষতি হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলে উৎপাদন ভালো হয়েছে। ফলে সামগ্রিকভাবে এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করবে। তবে আউশে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম উৎপাদন হয়েছে। সব মিলিয়ে এবার ৫ কোটি ৮৫ লাখ টন ধান উৎপাদিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

ভালো আবহাওয়া থাকায় ভুট্টার উৎপাদন ভালো হয়েছে। এবার মোট ৪৭ লাখ টন ভুট্টা উৎপাদন হবে বলে সংস্থাটি মনে করছে। মাছ ও মুরগির খাবার উৎপাদনকারী কারখানা বা ফিড মিলগুলোতে ভুট্টার চাহিদা বেশি ছিল। দামও ছিল ভালো। ফলে কৃষকও বেশি উৎপাদন করেছে। উন্নত মানের ও উচ্চ ফলনশীল ভুট্টার জাত এনে চাষাবাদ করার কারণেও উৎপাদন বেড়েছে বলে এফএও মনে করছে।

বিআইডিএসের সাবেক মহাপরিচালক মোস্তফা কে মুজেরি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদ্যমান এই পুঞ্জীভূত সংকটের মধ্যে থাকা দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে শুধু খাদ্যসহায়তা দিয়ে বিপদ থেকে বাঁচানো যাবে না। কারণ, আলু, গম ছাড়াও সবজি, তেল, পেঁয়াজ এগুলোর দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ফলে বিপুলসংখ্যক দরিদ্র মানুষ এসব খাবার কিনে খেতে পারছে না।’

মোস্তফা কে মুজেরি আরও বলেন, ‘এতে করে এসব দরিদ্র মানুষের পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। খাদ্যপণ্যের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণে থাকে, সে ব্যাপারে গুরুত্ব দিতে হবে। এসব পণ্যের আমদানি ও সরবরাহ নিশ্চিত করাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আর দরিদ্র মানুষের আয় বাড়াতে পারে, এমন উদ্যোগ সরকারকে নিতে হবে। নয়তো এই এক কোটির বেশি দরিদ্র মানুষ দীর্ঘমেয়াদি পুষ্টিহীনতার কবলে পড়বে।’