ডাকের সেবা নেওয়া কমছে

একদিকে ডাক বিভাগের বিভিন্ন সেবা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, অন্যদিকে ডাক সেবার মানোন্নয়নে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে আছে দেশ।

  • রাজধানীতে দিনে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার চিঠি ও পার্সেল ইস্যু হয়। এর মধ্যে ডাক বিভাগের মাত্র হাজার।

  • ২০১৮–১৯ অর্থবছরে আয় ছিল ৪০৫ কোটি টাকা। এ আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ৮৪১ কোটি টাকা।

ডাকবাক্সটি ভাঙা। চারদিকে অযত্মের ছাপ। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ডাকঘরটি প্রতিদিন খোলাও হয় না। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মধুপুরের পীরগাছায়

রাজধানীর জিগাতলা ডাকঘর। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টা থেকে বেলা ১১টা ৪০ মিনিট পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন এ প্রতিবেদক। ওই সময়ে ২৫ জনের মতো সেবাগ্রহীতা ডাকঘরটিতে আসেন। তবে তাঁদের বেশির ভাগই এসেছিলেন সঞ্চয় ব্যাংকসংক্রান্ত কাজে। ডাকঘরটির কর্মকর্তা–কর্মচারীরাও জানালেন, সঞ্চয় ব্যাংকের বাইরে অন্যান্য সেবা নেওয়া অনেক কমে গেছে। চিঠি, ইএমএস (এক্সপ্রেস মেইল সার্ভিস), অভ্যন্তরীণ পার্সেল সেবা, মানি অর্ডার ও সঞ্চয়পত্রের লেনদেনের মতো সেবা দিন দিন কমছে।

একদিকে ডাক বিভাগের বিভিন্ন সেবা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে, অন্যদিকে ডাক সেবার মানোন্নয়নে প্রতিবেশী দেশগুলোর চেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এ পটভূমিতে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব ডাক দিবস।

জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ) প্রতিবছরের ৯ অক্টোবর ডাক দিবস হিসেবে পালন করে। দেশের ডাক বিভাগ পত্রলিখন প্রতিযোগিতা ও সেরা কর্মী পুরস্কারের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করবে।

বাইরের দেশে সব ধরনের ইউটিলিটি সেবা ডাক বিভাগের মাধ্যমে হয়, যা বাংলাদেশে নেই। ডাক বিভাগকে আধুনিকায়ন করতে হলে মানসিকতারও পরিবর্তন জরুরি।
সুশান্ত কুমার মণ্ডল, সাবেক মহাপরিচালক, ডাক বিভাগ

ইউপিইউ গতকাল ৮ অক্টোবর সমন্বিত ডাক উন্নয়ন সূচক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বিশ্বের ১৭২টি দেশের ডাক উন্নয়ন পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিবেদনে আস্থা, পৌঁছানো, প্রাসঙ্গিকতা ও সহনশীলতা—এ চার সূচকের ভিত্তি করে একেকটি দেশের স্কোর ও ধাপ নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সমন্বিত ডাক উন্নয়ন সূচকে ১৩ দশমিক ৯ পেয়েছে এবং দ্বিতীয় ধাপে অবস্থান করছে। আস্থায় ১৬ দশমিক ৩, পৌঁছানোয় ১৫ দশমিক ১, প্রাসঙ্গিকতায় ১ দশমিক ৭ ও সহনশীলতায় ২০ দশমিক ৭ পেয়েছে বাংলাদেশ।

বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে প্রতিবেশী নেপাল (১৪ দশমিক ৮), মিয়ানমার (১৫ দশমিক ১), পাকিস্তান (৪৬ দশমিক ২), ভারত (৫৭ দশমিক ৩) ও শ্রীলঙ্কা (৩৩ দশমিক ৬)।

দ্বিতীয় ধাপে থাকা দেশগুলো সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এসব দেশ মূলত অপারেশনে (কার্যক্রম) বেশি মনোযোগ দেয়। কিন্তু সামনের দশকে ভালো করতে হলে তাদের ডাক পরিষেবা ও ব্যবসায়িক মডেলের উন্নতি করতে হবে।

তবে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার প্রথম আলোকে বলেন, ইউপিইউ অবনতি দেখলেও তিনি অবনতি হচ্ছে বলে মনে করেন না। তিনি বলেন, রাজস্ব কমলেও সেবা বাড়াতে তাঁরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছেন।

সেবা পরিস্থিতি

বিদেশে দ্রুত ডাক (চিঠিসহ পণ্য) পাঠানোর জন্য ডাক বিভাগের সেবা ইএমএস। ৪৩টি দেশের সঙ্গে ডাক বিভাগের এ সেবা চালু আছে। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে এ সেবার মাশুল ৮০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়। ওই বছর চিঠি ও পণ্য (পার্সেল) পাঠানোর পরিমাণ ছিল ৪৪ হাজার ৪৩টি। পরের বছরে তা ৫২ শতাংশ কমে যায়। সর্বশেষ অর্থবছরে (২০২১–২২) ইএমএসে ২৩ হাজার ৯৫৪টি চিঠি ও পার্সেল পাঠানো হয়।

এ অবস্থায় গত এপ্রিল থেকে ইএমএস মাশুল কমানো হয়েছে। তবে নির্ধারিত সময়ে পণ্য না পৌঁছানোর অনেক অভিযোগ আছে। এ ব্যাপারে ডাক বিভাগের ভাষ্য, নিজস্ব উড়োজাহাজ না থাকায় সময়মতো পণ্য পৌঁছানো সম্ভব হয় না।

ডাক বিভাগের অন্যতম একটি সেবা হচ্ছে মোবাইল মানি অর্ডার (ইএমটিএস)। ২০২০–২১ অর্থবছরে ১ লাখ ৪৬ হাজার ৫২৩টি ইএমটিএস ইস্যু হয়। গত অর্থবছরে তা কমে ৯২ হাজারে দাঁড়ায়।

ডাক বিভাগ থেকে তাদের ডিজিটাল সেবাগুলো সম্পর্কে জানতে চাইলে শুধু এমএফএস সেবা ‘নগদ’–এর বিস্তারিত তথ্য দেয়। নগদ থেকে এ পর্যন্ত চার কোটি টাকার মতো রাজস্ব পেয়েছে বলে ডাক বিভাগ জানিয়েছে।

ডাক বিভাগ থেকে জানা যায়, গত অর্থবছরে তারা প্রায় সাড়ে তিন কোটি চিঠি ও পার্সেল ইস্যু করেছে। কর্মকর্তা জানান, রাজধানীতে দিনে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার চিঠি ও পার্সেল ইস্যু হয়। এর মধ্যে ডাক বিভাগের মাত্র ২ হাজার। ডাক বিভাগে ব্যক্তিগত চিঠি একেবারেই কমে গেছে। দাপ্তরিক চিঠিই সবচেয়ে বেশি।

ডাক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো চিঠি বা পণ্য গ্রাহকের কাছ থেকে সংগ্রহ করে এবং তা পৌঁছে দেয়। কিন্তু চিঠি বা পণ্য পাঠানোর জন্য গ্রাহককে ডাক বিভাগের কাছে যেতে হয়। গ্রাহক যেখানে সুবিধা পাবেন, সেখানেই যাবেন।

ডাক বিভাগের মহাপরিচালক মো. ফয়জুল আজিম প্রথম আলোকে বলেন, গ্রাহক সন্তুষ্টির জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন। আগামী বছর থেকে ইউপিইউ প্রতিবেদনের সূচকে ডাক বিভাগের অবস্থান ভালো হবে বলে তিনি আশা করেন।

আয়ের দ্বিগুণ ব্যয়

২০১৯–২০ অর্থবছরে ডাক বিভাগের আয় ছিল ৪৫১ কোটি টাকা। ২০২০–২১ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ৩১৮ কোটি ১৫ লাখে। সর্বশেষ অর্থবছরের হিসাব পাওয়া যায়নি।

ডাক বিভাগ থেকে রাজস্ব আয় ও ব্যয়ের তথ্য চেয়েও পাওয়া যায়নি। তাদের ওয়েবসাইটেও ২০১৮–১৯ অর্থবছরের পর পূর্ণাঙ্গ কোনো বার্ষিক প্রতিবেদন নেই। সর্বশেষ প্রকাশিত ২০১৮–১৯ অর্থবছরের প্রতিবেদনে দেখা যায়, ওই অর্থবছরে তাদের আয় ছিল ৪০৫ কোটি টাকা। এ আয়ের বিপরীতে ব্যয় হয় ৮৪১ কোটি টাকা। এর মধ্যে শুধু বেতন ও ভাতাতেই ব্যয় হয় ৫০৩ কোটি টাকা। এ ছাড়া পেনশন ও আনুতোষিক ব্যয় ছিল ২৬৫ কোটি ৫১ লাখ টাকা।

ডাক বিভাগের সঞ্চয় ব্যাংকে লেনদেনও কমেছে। ২০২০–২১ অর্থবছরে সঞ্চয় ব্যাংকে লেনদেন হয় প্রায় ৩৭ হাজার টাকার বেশি। ২০২১–২২ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ২৫ হাজার কোটি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ডাক বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক সুশান্ত কুমার মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ডাক বিভাগের উন্নয়নের জন্য নিজেদের উদ্যোগ ও সরকারের সহযোগিতা লাগবে। তিনি বলেন, বাইরের দেশে সব ধরনের ইউটিলিটি সেবা ডাক বিভাগের মাধ্যমে হয়, যা বাংলাদেশে নেই। ডাক বিভাগকে আধুনিকায়ন করতে হলে মানসিকতারও পরিবর্তন জরুরি।