মধ্যবিত্ত সামান্য ত্যাগ করলে দেশটার আরও উন্নতি হতো

খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম গত সোমবার ওয়াশিংটনে মারা গেছেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি দেশের অর্থনীতির নানা দিক ও সামগ্রিক উন্নয়ন নিয়ে কথা বলেন। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সাক্ষাৎকারটি আবার প্রকাশ করা হলো।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম ( ১৯২৯—২০২৩)
প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশ আবার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ফিরে যাচ্ছে। এটি আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কতটা সহায়ক হবে বলে আপনি মনে করেন?

নুরুল ইসলাম: পঞ্চবার্ষিক, দ্বিবার্ষিক কিংবা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা—আমরা যা-ই করি না কেন, এগুলো হলো একটি দেশের উন্নয়ননীতি তৈরির কাঠামো বা ব্যবস্থা। এর ওপর দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি নির্ভর করে না, নির্ভর করে সেই নীতি বাস্তবায়নের ওপর। আপনি যত ভালো নীতিই গ্রহণ করুন না কেন, বাস্তবায়ন করতে না পারলে কাজ হবে না। সে কারণে প্রথমেই ঠিক করতে হবে একটি পরিকল্পনায় কী কী নীতি থাকা প্রয়োজন, সেসব বাস্তবায়ন সম্ভব কি না এবং নীতিগুলোর মধ্যে সামঞ্জস্য আছে কি না।

যেমন পরিকল্পনা নেওয়া হলো, ১০ শতাংশ কৃষি উৎপাদন বাড়ানো হবে। সে জন্য কী পরিমাণ সেচের সুবিধা বাড়াতে হবে, কী পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হবে, তা–ও ঠিক করতে হবে। সেই ভর্তুকি বাস্তবসম্মত কি না, তা–ও বিবেচনায় রাখতে হবে।

অনেকে পরিকল্পনাকে একটি সুন্দর বই হিসেবে দেখেন, ভাবেন ও লেখেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার থাকা প্রয়োজন, তা যদি না থাকে, তাহলে বই লিখে লাভ কী?

প্রশ্ন

প্রথম আলো: এ পরিপ্রেক্ষিতে জানতে চাইব, বর্তমান সরকার দেশবাসীকে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখিয়েছে, সেটি কতটা বাস্তবসম্মত?

নুরুল ইসলাম: সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম লক্ষ্য হলো দেশের বৃহত্তর জনগণের কাছে ইন্টারনেট-সুবিধা পৌঁছে দেওয়া। যোগাযোগের আরেকটি সহজ মাধ্যম হলো সেলফোন। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে তুলনা করলে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতা অনেক বেশি। ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব হলে ব্যবসা-বাণিজ্যেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট সার্ভিস সেন্টার হবে, কৃষক সহজেই তাঁর উৎপাদিত পণ্যের দাম জানতে পারবেন।

তবে এর সঙ্গে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে পারলে আরও ভালো হতো। ইন্টারনেট, কম্পিউটার—সবই শিক্ষার সঙ্গে জড়িত। সংখ্যার বিচারে হয়তো দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে, কিন্তু মান কমে গেছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত, এটি সত্য। বিদেশে গিয়ে যা উপলব্ধি, করেছি তা হলো, আমাদের শিক্ষার মানের অবনতি ঘটেছে।

এর জন্য অনেকাংশে দায়ী শিক্ষাঙ্গনের রাজনীতি। নির্বাচনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি পদ পূরণের যে ব্যবস্থা চালু রয়েছে, তাতে সবাই দলীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন। আমাদের সময়ে শিক্ষকেরা এত রাজনীতি করতেন না। তাঁরা আগ্রহীও ছিলেন না।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: ১৯৭৩ সালে প্রণীত বিশ্ববিদ্যালয় স্বায়ত্তশাসন অধ্যাদেশ নিয়ে নানা মহলে বিতর্ক হচ্ছে। কেউ বলছেন এটি থাকা জরুরি, কেউ বলছেন পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।

নুরুল ইসলাম: ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ হয়েছে ৩৬ থেকে ৩৭ বছর আগে। আমি মনে করি, এর পুনর্মূল্যায়ন ও সংশোধন প্রয়োজন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিক্ষাবিদ—সবাই মিলে এটি ঠিক করবেন। শিক্ষাঙ্গনে যে দলীয়করণ ও বিভক্তি চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।  আর শুধু ছাত্র-শিক্ষক কেন, এ ব্যাপারে অভিভাবকদেরও এগিয়ে আসতে হবে। মা-বাবারও দায়িত্ব আছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা বাইরে চলে যাচ্ছে, সেটি দেশের জন্য বড় ক্ষতি। আমাদের সময়ে কিছু কিছু রাজনীতিকের ছেলেমেয়েকে শিলং বা ভারতের অন্য কোনো স্থানে পাঠানো হয়েছিল। তখন বলেছিলাম, কী ব্যাপার, আপনারা সন্তানদের বাইরে পাঠাচ্ছেন কেন? এখন বিষয়টি ব্যাপক হারে হচ্ছে। অনেকের ছেলেমেয়ে ইউরোপ, আমেরিকায় পড়তে যাচ্ছে। আবার তাঁরাই রাজনীতির মঞ্চে বড় বড় কথা বলছেন। আসলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার প্রতি তাঁদের কোনো আগ্রহ নেই, আস্থাও নেই।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বিশ্ব অর্থনীতিতে সাম্প্রতিক যে মন্দা চলেছে, তা থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি?

নুরুল ইসলাম: বিশ্ব অর্থনীতিতে ওঠানামা অর্থবিজ্ঞানেরই স্বাভাবিক নিয়ম। কোনো কোনো সময়ে বেশি হয়েছে, কোনো কোনো সময়ে কম। প্রশ্ন হলো, একে মোকাবিলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি আছে কি না। মন্দা দুভাবেই আসতে পারে—এক. বন্যা, সাইক্লোন ও খরার কারণে। আমরা একে বলি প্রাকৃতিক বিপর্যয়। দুই. অর্থনীতির নিজস্ব নিয়মে। উভয় ক্ষেত্রে আমাদের প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। বিশ্ব অর্থনীতিতে গত ৮০ বছরে এ রকম মন্দা দেখা দেয়নি। প্রথমত, এই মন্দা আমেরিকায় শুরু হয়ে অন্যান্য অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ে। হিসাব করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশে মন্দার প্রভাব তুলনামূলকভাবে কম পড়েছে। এটি হয়েছে আমাদের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্যের কারণে। আমাদের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক। আমরা কম দামের পোশাক রপ্তানি করি। ফলে রপ্তানি তেমন কমেনি। আবার প্রবাসী শ্রমিকদের বেশির ভাগই কাজ করেন মধ্যপ্রাচ্যে। সেখানেও মন্দার প্রভাব কম পড়েছে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার অর্থনৈতিক সম্পর্ক কোন দিকে এগোচ্ছে? প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফর ও চুক্তি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ বিতর্ক হচ্ছে।

নুরুল ইসলাম: বাংলাদেশ ও ভারতের অর্থনৈতিক সম্পর্ক উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রথমেই যেটি দেখা প্রয়োজন, সেটি হলো ভৌগোলিক অবস্থান। বাংলাদেশের তিন দিকে ভারত। নিকট প্রতিবেশী দুটি দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বা লেনদেন বাড়লে এর সুবিধা দুই দেশের জনগণই পাবে। পৃথিবীতে ভৌগোলিক নৈকট্যের দেশগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হয়েছে, পারস্পরিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগে সহযোগিতা করেছে, এর ভূরি ভূরি উদাহরণ রয়েছে। আবার কোথাও কোথাও রাষ্ট্রীয় নীতি এই নৈকট্যের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ভারতের সঙ্গে আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ঝুঁকিও কম নয়। আমরা ভারত থেকে অনেক বেশি পণ্য আমদানি করি, রপ্তানি করি কম। কেউ কেউ মনে করেন, সেখানে রপ্তানি করার মতো যথেষ্ট পণ্য আমাদের নেই। আবার কারও মতে, ভারত দরজা বন্ধ করে রেখেছে বলেই বাণিজ্য-ঘাটতি বাড়ছে। দুই পক্ষের বক্তব্যের পেছনেই যুক্তি আছে।

প্রধানমন্ত্রীর নয়াদিল্লি সফরকালে যে চুক্তিগুলো হয়েছে, যে যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়েছে, তাতে অনেকগুলো বিষয় আছে। একবারে সব বাস্তবায়ন করা যাবে না। আমাদের অগ্রাধিকার ঠিক করতে হবে, কোনগুলো এক বছরে করব, কোনগুলো দুই বছরে, কোনগুলো দীর্ঘ মেয়াদে। আবার কিছু সমস্যা আছে বেশ পুরোনো। ১৯৭৪ সালে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি হয়েছিল। এখনো তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি; বিশেষ করে ছিটমহল বিনিময় ও দহগ্রাম-আঙ্গরপোতার সঙ্গে স্থায়ী করিডর। কেন হয়নি, তারও বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ প্রয়োজন।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বন্দর ও কানেকটিভিটি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশি পণ্য আদান-প্রদান নিয়েও রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক রয়েছে। আপনার অভিমত কী?

নুরুল ইসলাম: দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চট্টগ্রাম বন্দর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বিতর্ক আছে, তা–ও সত্য। কিন্তু বন্দর নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা, জরিপ হয়েছে বলে জানা নেই। চট্টগ্রাম বন্দর বিদেশিদের ব্যবহারের সুযোগ দিলে ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি বাড়বে বলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। তাঁরা কিসের ভিত্তিতে এ কথা বলছেন? তাঁরা কি জরিপ করেছেন? চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি পণ্য ওঠানো-নামানোর সুযোগ দেওয়ার আগে গবেষণা করতে হবে, আমরা এ থেকে কতটুকু লাভবান হব। গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কথাও বলা হচ্ছে। সেটি কীভাবে হবে, তা নিয়েও গবেষণা প্রয়োজন। ফাঁকা কথা বলে কাজ হবে না।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে যে জটিলতা, তা ব্যতিক্রম কিছু নয়। পৃথিবীর সব অঞ্চলেই ছোট ও বড় প্রতিবেশী দেশের মধ্যে একধরনের মনস্তাত্ত্বিক টানাপোড়েন থাকে। যেমন আছে যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকোর মধ্যে, আছে নাইজেরিয়ার সঙ্গে প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশের। সমস্যা আছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার মধ্যে। আলোচনার টেবিলেই এসব বিরোধ মেটাতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে আমাদের জ্ঞান ও সক্ষমতা বাড়ানোর বিকল্প নেই। ১৯৭২-৭৫ সালে ভারতের সঙ্গে আলোচনার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় উত্তম ও চৌকস কর্মকর্তাদেরই পাঠানো উচিত।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: দুই দেশের অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য রাজনৈতিক সমঝোতা কতটা জরুরি?

নুরুল ইসলাম: এ ক্ষেত্রে দুটি মন্ত্র রয়েছে। কারও কারও মতে, অর্থনৈতিক সহযোগিতা বাড়লে রাজনৈতিক সমঝোতার পথও প্রশস্ত হবে। কিন্তু আমি মনে করি, রাজনৈতিক সমঝোতা ও পারস্পরিক আস্থা ছাড়া অর্থনৈতিক সম্পর্কের উন্নয়ন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য এটি আরও বেশি সত্য।

এ কথা ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হয়েছে দুই দেশেরই স্বার্থে। আমেরিকা চীনা পণ্যের প্রধান ক্রেতা, আবার আমেরিকায় চীনের বিনিয়োগও রয়েছে প্রচুর। চীন ছাড়া আমেরিকার অর্থনীতি প্রায় অচল। অন্যদিকে, ভারত ও চীনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক সাংঘাতিক কিছু নয়। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক অরুণাচলে ঋণ দিতে চাইলে চীন আপত্তি করেছে। বলেছে, এটি তাদের ভূখণ্ড। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সে রকম কোনো বিরোধ নেই। অর্থনৈতিকভাবে ভারত অনেক এগিয়ে গেছে, আমরা পারিনি। এ কারণে ভারত তো বটেই, সবার কাছ থেকেই আমাদের শেখার আছে। শেখ হাসিনার নয়াদিল্লি সফরের মধ্য দিয়ে পারস্পরিক আস্থা ফিরে এসেছে। এখন এ সুযোগ কাজে লাগাতে হলে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে, যথাযথ গবেষণা-জরিপ করতে হবে। যেসব খাতে আমরা সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে পারি, সেসব দিকে মনোনিবেশ করতে হবে।

আরেকটি কথা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বা বৈদেশিক নীতি নিয়ে পৃথিবীর কোনো দেশে রাজনৈতিক বিভাজন দেখা যায় না, অথচ আমাদের এখানে আছে। এ ব্যাপারেও একটি মতৈক্যে আসতে হবে। অন্যান্য দেশ কীভাবে সমস্যাগুলো সমাধান করছে, সেই অভিজ্ঞতাও আমরা কাজে লাগাতে পারি। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কেন আমরা ভারতকে টেনে আনব? আমি বলব, সরকার ও বিরোধী দল থেকে ১০ জন করে প্রতিনিধি বিদেশে গিয়ে দেখুন যুক্তরাষ্ট্র ও মেক্সিকো সমস্যাটি কীভাবে সমাধান করেছে। আমরা তাদের থেকে শিক্ষা নিতে পারি। মেক্সিকোতেও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি আছে। কিন্তু এক দল অন্য দলকে যুক্তরাষ্ট্রপন্থী বা যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বলে না। আমাদের এখানে বলা হয়।

আরেকটি বিষয় হলো, ভারত এখন যে অবস্থানে গেছে, তার আগ্রহ চীন, আমেরিকা ও ইউরোপ নিয়ে। তার স্বার্থ রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যেও। বাংলাদেশের প্রতি ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করতে হলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার যাঁরা কুশীলব, যেমন শিক্ষাবিদ, অর্থনীতিবিদ, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি—সবার সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে হবে, যাতে সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত তৈরি হয়; যেটি ১৯৭১ সালে হয়েছে। কেবল ভারতে নয়, মার্কিন সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও আমরা জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ, শিল্পীসহ গণমানুষের সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়েছিলাম।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: খাদ্যনিরাপত্তা গড়ে তোলার ব্যাপারে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপকে কীভাবে দেখছেন?

নুরুল ইসলাম: বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমার ধারণা, সমস্যাটি ভালোভাবেই চিহ্নিত করা গেছে। বিশেষ করে বর্তমান সরকারের কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা সমস্যাটি বোঝেন ও জানেন—সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। এ ক্ষেত্রে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দৃঢ় অঙ্গীকার রয়েছে এবং তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলোও ভালো। যেমন কৃষকদের সহায়তা কার্ড দেওয়া হয়েছে। কথা হলো, সরকার যেসব সহায়তা দিচ্ছে, বিশেষ করে সেচের সুবিধা বাড়ানো, সারে ভর্তুকি দেওয়া—এসব থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা কীভাবে আদায় করা যায়, তা নিয়ে আরও আলোচনা হতে পারে।

তবে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, আমাদের গবেষণার দুর্বলতা রয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে যেসব গবেষণাপ্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোকে উৎসাহিত করতে হবে। যেসব মেধাবী গবেষক বিদেশে চলে যাচ্ছেন, তাঁদের ধরে রাখতে সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। গবেষকদের ওপর আমলাতন্ত্রের খবরদারিও কাম্য নয়।  

প্রশ্ন

প্রথম আলো: বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি আপনি আশাবাদী?

নুরুল ইসলাম: প্রথমেই স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে। তবে অনেকেই বলবেন, আরও হতে পারত। এ নিয়ে আক্ষেপ বা দুঃখবোধ থাকতে পারে। আমি আশাবাদী। আমরা যদি লক্ষ্যে স্থির থাকি, আমাদের নীতি যদি সঠিক হয়, তাহলে উন্নতি হবেই। স্বাধীনতার পর গত ৩৯ বছরে দারিদ্র্য তো কমেছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সফল হয়েছি। সেই সঙ্গে বৈষম্যও বেড়েছে। যেসব দেশ দ্রুত উন্নতি লাভ করছে, সেসব দেশেও বৈষম্য বেড়েছে। বৈষম্য বেড়েছে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্রেও। প্রবৃদ্ধি বাড়লে দুটি জিনিস হয়—প্রথমত, একশ্রেণির মানুষের দক্ষতা বাড়ে, অন্যরা তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারে না। এ জন্য আমাদের সর্বস্তরে সক্ষমতা বাড়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, দেশ সম্পদশালী হলে এর সুবিধাও সবাই যাতে পায়, সে ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রশ্ন

প্রথম আলো: সম্প্রতি একটি সেমিনারে আপনি উন্নয়নের বাধা হিসেবে দুর্নীতি, ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া ও দায়িত্বশীল মধ্যবিত্ত না থাকার কথা বলেছেন। বিষয়টি ব্যাখ্যা করবেন কি?

নুরুল ইসলাম: দুর্নীতি নিয়ে আমি অনেক চিন্তাভাবনা করেছি। অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার মধ্যেই এর বীজ রয়েছে। দুর্নীতিকে একেবারে নির্মূল করা যাবে না। দুর্নীতির প্রবণতা মানুষের সহজাত। তবে আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে দুর্নীতি কমানো যায়। যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ যেসব দেশ উন্নতি করেছে, সেসব দেশেও দুর্নীতি আছে। তবে সেখানে দুর্নীতির জন্য শাস্তি হয়, আমাদের এখানে হয় না। আমি মনে করি, দু-চারজনকে শাস্তি দিলেও দুর্নীতি অনেকাংশে কমে যাবে। অন্যরা ভয় পাবেন।

এখানে নাগরিকদের মধ্যে কর না দেওয়ার প্রবণতা আছে। কর ফাঁকি দিলে সরকারের আয় বাড়বে কী করে? আর আয় না বাড়লে দেশেরও উন্নতি হবে না। এ জন্য এমন পদ্ধতি বের করতে হবে, যাতে কেউ কর ফাঁকি দিতে না পারে। একই সঙ্গে যাঁরা কর ফাঁকি দিচ্ছেন, তাঁদের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
নুরুল ইসলাম: ধন্যবাদ।

(সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান।)