আড়াই বছর আগে পরিবহন খাতের শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করে সরকার। কিন্তু এ খাতের কোনো শ্রমিক নির্ধারিত নিম্নতম মজুরি পাচ্ছেন না। রাজধানীর অধিকাংশ বাস এখনো চুক্তি ভিত্তিতে চলছে। নির্দিষ্ট বেতন বা মজুরি না থাকায় চালক ও সহকারীরা বেশি যাত্রী ও ট্রিপের জন্য বেপরোয়াভাবে বাস চালানো বন্ধ করছেন না।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেশির দায়ী চুক্তিতে বাস চালানো। চুক্তিতে চললে চালকদের বেশি ট্রিপের তাড়া থাকে। জমার টাকা, সড়কে চাঁদা, জ্বালানি খরচ ও অন্যান্য খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও তাঁর সহকারী নিজের আয়টুকু তোলেন। ফলে বেশি যাত্রী ও ট্রিপের জন্য তাড়া থাকে তাঁদের। এতে জড়াতে হয় একই রুটে চলাচলকারী অন্য পরিবহনের সঙ্গে রেষারেষিতে।
২০১৮ সালের ২৯ জুলাই বেপরোয়া বাসের চাপায় রাজধানীর শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের দুই শিক্ষার্থী নিহত হয়। সেদিন থেকে নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। তাদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ৯ আগস্ট থেকে চুক্তিতে বাস না চালানোর ঘোষণা দেয় পরিবহন মালিক সমিতি। বাস্তবে রাজধানীতে চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো বন্ধ হয়নি।
২০১৮ সালের ৯ আগস্ট থেকে চুক্তিতে বাস না চালানোর ঘোষণা দেয় পরিবহন মালিক সমিতি। বাস্তবে রাজধানীতে চুক্তিভিত্তিক বাস চালানো বন্ধ হয়নি।
এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিমালিকানাধীন সড়ক পরিবহন খাতের শ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরি নির্ধারণে শ্রম আইন অনুযায়ী বোর্ড গঠন করা হয়। বোর্ড একাধিক সভা শেষে নিম্নতম মজুরির সুপারিশ করে। ২০২০ সালের ২১ জুলাই পরিবহনশ্রমিকদের জন্য নিম্নতম মজুরির প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। মূল বেতন, বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা ও যাতায়াত ভাতা মিলিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে মোট মজুরি।
মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী, ভারী, মাঝারি ও হালকা যান চালানোর লাইসেন্সের ভিত্তিতে চালকদের বেতন নির্ধারণ করা হয়েছে। আলাদা করা হয়েছে বিভাগীয় শহর ও সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য এলাকার ভিত্তিতে চালকদের বেতন। এ বিভাজনের ভিত্তিতে একজন চালকের বেতন সর্বোচ্চ ২০ হাজার ২০০ থেকে সর্বনিম্ন ১৪ হাজার ৪৪০ টাকা পর্যন্ত।
ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনার জন্য বেশি দায়ী চুক্তিতে বাস চালানো। চুক্তিতে চললে চালকদের বেশি ট্রিপের তাড়া থাকে। জমার টাকা, সড়কে চাঁদা, জ্বালানি খরচ ও অন্যান্য খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও তাঁর সহকারী নিজের আয়টুকু তোলেন।
বাসের কনডাক্টর (পরিচালনাকারী), সুপারভাইজার (তত্ত্বাবধায়ক), চেকার (পরীক্ষক), বুকিং ক্লার্ক, গাইড ও ক্যাশিয়ারদের দক্ষ শ্রমিক হিসেবে ধরা হয়েছে। বিভাগীয় শহরে তাঁদের নিম্নতম বেতন ১৩ হাজার টাকা ও অন্যান্য এলাকার জন্য ১২ হাজার ২০০ টাকা; আর চালকের সহকারীদের (হেলপার) নিম্নতম বেতন বিভাগীয় শহরে ১০ হাজার ৭৫০ টাকা ও অন্যান্য এলাকায় ১০ হাজার ১০০ টাকা করা হয়।
ট্রিপভিত্তিক বেতনের কারণে চালকদের মধ্যে বেপরোয়া চালানোর তাড়া থাকে। অথচ চালক-সহকারীর বেতন হিসাব করেই বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মালিকেরা নির্ধারিত বেতন দেন না—মোজাম্মেল হক চৌধুরী, মহাসচিব, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি
মজুরি বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী, কোনো মালিক পরিবহনশ্রমিককে এ নিম্নতম মজুরির কম দিতে পারবেন না। প্রতিবছর মূল বেতনের ৫ শতাংশ হারে শ্রমিকদের বেতন বাড়বে। ২০০৬ সালের শ্রম আইন ও ২০১৫ সালের শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী অন্যান্য ভাতা ও সুবিধাও পাবেন তাঁরা।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ইনসুর আলী প্রথম আলোকে বলেন, আড়াই বছরেও নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়িত না হওয়া দুঃখজনক। নিয়োগপত্র, বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো মজুরি বোর্ডের গেজেটে বলা আছে। এই নিম্নতম মজুরি মানার ক্ষেত্রে মালিকদের অনীহা রয়েছে। রাজধানীর বাসে চালু হওয়া ই-টিকিট ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে হলে শ্রমিকদের বেতন ঠিকভাবে দিতে হবে।
আড়াই বছরেও নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়িত না হওয়া দুঃখজনক। নিয়োগপত্র, বাৎসরিক বেতন বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো মজুরি বোর্ডের গেজেটে বলা আছে। এ নিম্নতম মজুরি মানার ক্ষেত্রে মালিকদের অনীহা রয়েছে—ইনসুর আলী, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগ
গত বৃহস্পতিবার ও গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বিভিন্ন পথে চলাচলকারী অন্তত ১০টি বাসের চালক ও সহকারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, তাঁদের কারও বেতন নির্ধারিত নয়। যত ট্রিপ, তত টাকা—এই চুক্তিতে তাঁরা বাস চালাচ্ছেন। মালিকের জমা, লাইন খরচ (বিভিন্ন চাঁদা ও অন্যান্য খরচ), জ্বালানি খরচ ও নিজেদের খাওয়ার খরচ বাদ দেওয়ার পর চালক ও সহকারী তাঁদের আয় বুঝে নেন।
নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নের বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, পরিবহনমালিকেরা নিম্নতম মজুরি কার্যকর করতে রাজি। কিন্তু পরিবহনশ্রমিকেরা স্থায়ীভাবে থাকতে চান না। দু–এক মাস কাজ করেই চাকরি বদলে ফেলেন। নিম্নতম মজুরির বিষয়ে শ্রমিক ফেডারেশনের সঙ্গে একাধিকবার বৈঠক হয়েছে। একটি নীতিমালা তৈরি করে মজুরি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
রাজধানীতে চলাচলকারী বাসগুলোয় দীর্ঘদিন ধরে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এ ভাড়া–নৈরাজ্য বন্ধে বাসে ই-টিকিটিং চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ১৩ নভেম্বর থেকে মিরপুর অঞ্চলের বাসে শুরু হয়েছে ই-টিকিটের মাধ্যমের যাত্রী নেওয়া।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রাজধানীতে চলাচলকারী সব বাসে ই-টিকিট চালু করা গেলে নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা অনেকটাই কমবে। তবে পরিবহনশ্রমিকদের বেতন নির্ধারিত না থাকলে এটি বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে।
নিম্নতম মজুরির পাশাপাশি পরিবহনশ্রমিকদের জন্য ওভারটাইমের (অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা) টাকাও দিতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ট্রিপভিত্তিক বেতনের কারণে চালকদের মধ্যে বেপরোয়া চালানোর তাড়া থাকে। অথচ চালক–সহকারীর বেতন হিসাব করেই বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মালিকেরা নির্ধারিত বেতন দেন না। নিম্নতম মজুরি বাস্তবায়নে মালিক ও শ্রমিক দুই পক্ষেরই উদ্যোগ প্রয়োজন।