পুলিশকে ‘খুশি করে’ এক্সপ্রেসওয়েতে চলছে অবৈধ বাস

  • পদ্মা সেতু দিয়ে বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া বন্ধ রেখেছে বিআরটিএ।

  • পদ্মা সেতুর সদ্ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন। 

খুলনা থেকে ছেড়ে আসা ইমাদ পরিবহনের বাসটি পদ্মা সেতুতে ওঠার আগে চালক নিয়ন্ত্রণ হারালে সেটি ছিটকে পড়ে। বাসটি দুমড়েমুচড়ে যায়

পদ্মা সেতুর এক্সপ্রেসওয়েতে ইমাদ পরিবহনের যে বাস দুর্ঘটনায় ১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে, সেই বাসের চলাচলের অনুমতি ছিল না। ছিল না ফিটনেস সনদও। তারপরও সেটি নিয়মিত ঢাকা থেকে খুলনার পথে যাত্রী পরিবহন করছিল। এমন শত শত বাস পদ্মা সেতু হয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় অবৈধভাবে চলাচল করছে। এর মধ্যে গ্রিনলাইন, হানিফ, সোহাগ, এনা, ইউনিক, গোল্ডেন লাইনসহ বড় কোম্পানির বাসও রয়েছে।

পরিবহন কোম্পানিগুলোর সূত্র বলছে, পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণের পথে যাত্রী চাহিদা বেড়ে যায়। নতুন বাস নামাতে তারা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বরাবর চলাচলের অনুমতির (রুট পারমিট) জন্য আবেদনও জমা দিয়েছে। কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আপত্তিতে তা দিচ্ছে না বিআরটিএ। এর ফলে অনুমতি ছাড়াই পুলিশকে ‘খুশি করে’ করে বাস চালানো হচ্ছে। এই সুযোগে ফিটনেসবিহীন বাসও এই এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে অবাধে চলাচল করছে। সেই সঙ্গে বেপরোয়া গতি সড়ক দুর্ঘটনা বাড়িয়ে দিচ্ছে।

রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরাই এই পথে বেশি বাস চালাচ্ছেন।নেওয়া হচ্ছে বাড়তি ভাড়াও।

এই অবস্থা চললেও এক্সপ্রেসওয়েতে যান চলাচল শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। যাদের সিদ্ধান্তে রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ রয়েছে, সেই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, এটা দেখার দায়িত্ব পুলিশ ও বিআরটিএর। অন্যদিকে বিআরটিএর একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রুট পারমিট দেওয়ার পর সড়কে বাস চলল কি না, অথবা স্থগিত করার পর আবার চলাচল করছে কি না, তা দেখার মতো লোকবল বা ব্যবস্থা বিআরটিএর নেই। পুলিশ চাইলে যেকোনো সময় ব্যবস্থা নিতে পারে। এখন পুলিশ নীরব থাকলে শাস্তি কার্যকর করা কঠিন।

বিআরটিএ সূত্র জানায়, ইমাদ পরিবহনের বাসটি এর আগে গত নভেম্বরেও গোপালগঞ্জে দুর্ঘটনায় পড়েছিল। সেই দুর্ঘটনায় তিনজন মারা যান। এর পর থেকে বাসটির চলাচলের অনুমতি স্থগিত রাখা হয়েছিল। রোববারের দুর্ঘটনায় ১৯ জনের প্রাণহানির পর সেটির নিবন্ধন বাতিল এবং মালিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

পরিবহনসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রাজনৈতিক বা ব্যবসায়িকভাবে প্রভাব আছে, এমন ব্যক্তিরাই এই পথে বেশি বাস চালাচ্ছেন। অন্যরা আগ্রহ থাকলেও বিনা অনুমতিতে বাস চালাতে সাহস পাচ্ছেন না। এতে সাধারণ যাত্রীদের সামনে বিকল্প কম থাকছে। এই সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায়ের ঘটনাও ঘটছে। এ ছাড়া বাসের রুট পারমিট থেকে সরকার যে রাজস্ব পেত, সেটি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে।

পদ্মা সেতু তো এক দিনে হয়নি। বাস বা অন্যান্য যানবাহন চললে যানজট যাতে না হয়, সেটি তো আগেই ঠিক করার দরকার ছিল। মানুষের চাহিদা আছে দেখে অবৈধভাবে বাস চালাচ্ছেন মালিকেরা।
অধ্যাপক সামছুল হক, পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক

সরকার পদ্মা সেতু চালু করেছে প্রায় ৯ মাস হয়ে গেছে। ফেরির ঝক্কি-ঝামেলা এড়িয়ে দ্রুত সেতু দিয়ে বাস যাবে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে—এটিই ছিল প্রত্যাশা। কিন্তু রাজধানীর মেয়র হানিফ উড়ালসড়কে যানজট হবে—এই অজুহাতে পদ্মা সেতু হয়ে বাসের অনুমোদন বন্ধের জন্য চিঠি দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এই চিঠি পেয়ে বিআরটিএ রুট পারমিট বন্ধ রেখেছে। প্রায় সাত মাস ধরে সিটি করপোরেশন ও বিআরটিএর মধ্যে চিঠি চালাচালি করে কোনো সুরাহা হয়নি। রোজা ও ঈদুল ফিতর আসন্ন। যাত্রীর চাপ বাড়বে। তখন বাসের সংকট তৈরি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন।

পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে মাওয়া হয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ফেরি পারাপারের মাধ্যমে ১২টি রুটে বাস চলত। গাবতলী থেকে দক্ষিণের পথে রুট ছিল ৩০টির বেশি। সেতু চালুর পর গাবতলী থেকে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার বেশির ভাগ বাস রুট পরিবর্তন করে পদ্মা সেতু দিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে শরীয়তপুর, মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, বরিশাল বিভাগ, খুলনা, সাতক্ষীরা ও যশোরের বেশির ভাগই পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করছে। এর মধ্যে লক্কড়ঝক্কড় বাসও চলাচল করছে।

পরিবহন কোম্পানি সূত্রগুলো বলছে, রুট পারমিট নেই বলে বেশির ভাগ কোম্পানি চাহিদামতো বাস নামাচ্ছে না। আগে যে ১২টি রুটে বাস চলত, সেসব কোম্পানির মালিকেরা বাড়তি বাস নামাতে চেয়ে পারছেন না।

যেভাবে জটিলতার শুরু

মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের নিচে উন্নয়ন ও যানজট নিরসন কমিটির সভাপতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর এই কমিটির সভায় ১৫টি সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী-পোস্তগোলা রুটে মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক ব্যবহার করে বাসের রুট পারমিট না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সে আলোকে ৮ সেপ্টেম্বর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে চিঠি দিয়ে মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক দিয়ে বাসের রুট পারমিট বন্ধ রাখার অনুরোধ জানান। বিআরটিএর চেয়ারম্যান পরে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবের কাছে করণীয় সম্পর্কে জানতে চান। সচিবের দপ্তর উড়ালসড়ক ব্যবহার না করে নিচ দিয়ে বাস চলাচলের অনুমতির জন্য সিটি করপোরেশনকে জানানোর পরামর্শ দেয়। বিআরটিএ গত বছরের ২ নভেম্বর ঢাকা যানবাহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) নির্বাহী পরিচালককে চিঠি দিয়ে নগর পরিবহনে বাস রুট যৌক্তিকীকরণের (র‌্যাশনালাইজেশন) দায়িত্ব পাওয়া কমিটির সভায় বিষয়টি উত্থাপনের অনুরোধ করে। এই কমিটির সভাপতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। এই চিঠি–চালাচালির মধ্যেই প্রায় সাত মাস চলে গেছে; কিন্তু সুরাহা হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মেয়র হানিফ উড়ালসড়কের পাশাপাশি এর নিচ দিয়েও বাসের অনুমোদন বন্ধ রয়েছে।

এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, রুট পারমিট চালুর বিষয়ে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এর মধ্যে কেউ অবৈধভাবে বাস নামালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেখবে। আর বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে।

বিআরটিএ সূত্র বলছে, পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর ওই সেতু দিয়ে চলাচলের জন্য ৫০০ বাসের রুট পারমিটের আবেদন জমা পড়ে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের চিঠি পাওয়ার পর তারা এসব বাসের রুট পারমিট দেওয়া বন্ধ করে দেয়। গত ৭ মাসে আরও প্রায় ৫০০ বাসের রুট পারমিটের আবেদন জমা হয়েছে। বিআরটিএ অনুমতি বন্ধ রাখলেও এসব বাস অবৈধভাবে চলাচল করছে।

আন্তজেলা পথে বাসের রুট পারমিট দিতে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনারের নেতৃত্বে একটি কমিটি রয়েছে। এই কমিটির সাচিবিক দায়িত্বে রয়েছে বিআরটিএ। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের চিঠির পর বাসের অনুমতি দেওয়ার জন্য গঠিত কমিটির বৈঠক বন্ধ আছে।

এ বিষয়ে এনা পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খোন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় লাখ লাখ অবৈধ রিকশা যানজট তৈরি করছে। সেখানে সিটি করপোরেশন এটা বন্ধ না করে যানজটের দোহাই দিয়ে বাস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে যাত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার অবৈধভাবে কিছু বাস চলায় হয়রানিতে পড়তে হচ্ছে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন যদি শহরের বাইরে টার্মিনাল তৈরি করে দেয়, তাহলে তাঁদের বাস আর শহরে ঢুকবে না।

সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর সারা দেশ থেকে যানবাহন এই পথে চলাচল শুরু করে, যা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। পুলিশের পক্ষ থেকেও চাপ কমানোর তাগিদ ছিল। এ জন্য নতুন রুট পারমিট না দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তিনি বলেন, মাস দুয়েকের মধ্যে হানিফ উড়ালসড়কের নিচের সড়কের উন্নয়নকাজ শেষ হবে। কিছু প্রস্তুতিমূলক কাজ চলছে। তখন হয়তো উড়ালসড়কের নিচ দিয়ে বাস চলাচলের অনুমতি দেওয়া যাবে। অবৈধভাবে বাস চলার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা দেখার দায়িত্ব পুলিশ ও বিআরটিএর।

এ বিষয়ে হাইওয়ে পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শাহাবুদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, অতিরিক্ত গতির কারণে সড়ক দুর্ঘটনাগুলো ঘটছে। গতি নিয়ন্ত্রণে গত বছর তাঁরা ১৪ হাজার মামলা দিয়েছেন। দুর্ঘটনা কমাতে গাড়ির ফিটনেস, গতি নিয়ন্ত্রণ, রুট পারমিটসহ ট্রাফিক আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর হবেন।

পদ্মা সেতুর সদ্ব্যবহার

সরকার প্রায় ৩২ হাজার ৮৭৫ কোটি টাকা খরচ করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। এই সেতু দিয়ে দ্রুত বাস চালিয়ে দক্ষিণের পথে যাতায়াত করা যাবে, সেটিই ছিল অন্যতম লক্ষ্য। আর রাজধানী ঢাকা থেকে দ্রুত বের হওয়া এবং প্রবেশের জন্য ২ হাজার ১০৮ কোটি টাকা খরচ করে মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতি কিলোমিটার উড়ালসড়ক নির্মাণে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১৮০ কোটি টাকা। পদ্মা সেতুর সুফল পেতে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার দ্রুতগতির চওড়া মহাসড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। এতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ৪৪ কোটি টাকা। প্রতি কিলোমিটারে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। কিন্তু এখন পদ্মা সেতুর যানবাহনের চাপ নিতে পারছে না মেয়র হানিফ উড়ালসড়ক।

২০২২ সালের জুনে যখন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করা হয়, তখন এই সেতু দিয়ে দিনে ২৩ হাজার ৯৫৪টি যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা ছিল। ২০৩০ সালে তা বেড়ে ৩৬ হাজার ৭৮৫টি হওয়ার কথা রয়েছে। চার লেনের এই সেতুতে দিনে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার যানবাহন চলাচলের সক্ষমতা আছে। বর্তমানে পদ্মা সেতু দিয়ে দৈনিক গড়ে ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করছে। দৈনিক টোল আদায় হচ্ছে সোয়া দুই কোটি টাকার মতো।

পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকায় যানবাহনের বাড়তি চাপ পড়বে, এটা আগেই ধারণা করা হয়েছিল। এ জন্য ঢাকার ২০ বছরের পরিবহন পরিকল্পনায় কিছু প্রকল্পের সুপারিশ করা হয়েছিল। এর বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হয়নি।

সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, পদ্মা সেতুর সদ্ব্যবহারের জন্য ঢাকা ঘিরে যে বিকল্প সড়কগুলো নির্মাণের কথা, সেগুলো আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চালুর সম্ভাবনা নেই।

এ বিষয়ে পরিবহনবিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পদ্মা সেতু তো এক দিনে হয়নি। বাস বা অন্যান্য যানবাহন চললে যানজট যাতে না হয়, সেটি তো আগেই ঠিক করার দরকার ছিল। মানুষের চাহিদা আছে দেখে অবৈধভাবে বাস চালাচ্ছেন মালিকেরা। এখন অবৈধভাবে কী চলছে, এর ফিটনেস আছে কি না, যাত্রীরা ঠকছেন কি না, তা দেখার দায়িত্ব কেউ নিচ্ছে না। পরিবহন খাতের বিশৃঙ্খলার পেছনে এই সমন্বয়হীনতাও অনেকটা দায়ী।