সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার তরগাঁও ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয়ে গিয়েছিলেন কৃষক মো. আক্তারুজ্জামান। এই ইউপিতে চেয়ারম্যান নেই। একজন শিক্ষা কর্মকর্তা প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। গত বৃহস্পতিবার সকালে এক বেলা বসে থেকেও তাঁর দেখা পেলেন না আক্তারুজ্জামান।
একই দিন ওই ইউপিতে নাগরিকত্বের সনদ নিতে গিয়েছিলেন নাজিম উদ্দিন। তাঁকেও সেদিন সনদ ছাড়াই ফিরতে হয়েছে। তরগাঁও ইউপিতে প্রশাসকের দায়িত্ব পাওয়া সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা এস এম ফাতেমা মুঠোফোনে প্রথম আলোকে জানালেন, স্কুল পরিদর্শনের কাজে সকাল থেকে ব্যস্ত তিনি। ইউপিতে যাওয়ার সময় পাচ্ছেন না।
নোয়াখালী, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও ফেনী জেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক। কেউ কেউ হত্যা মামলার আসামি। কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে, কেউ হামলা থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে রয়েছেন।
নাগরিক সেবা নিয়ে এমন দুর্ভোগ শুধু তরগাঁও ইউপিতেই নয়, কাপাসিয়া উপজেলার বাকি ইউনিয়নগুলোতেও প্রায় একই চিত্র। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে ওই উপজেলার ১১টি ইউপির চেয়ারম্যানরা নিজ কার্যালয়ে যাচ্ছেন না। তাঁরা সবাই পলাতক বলে জানা গেছে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, ৫ আগস্টের পর থেকে সারা দেশে ১ হাজার ৪১৬ জন ইউপি চেয়ারম্যান কার্যালয়ে অনুপস্থিত, যা মোট ইউনিয়ন পরিষদের এক-তৃতীয়াংশ। তাঁদের বেশির ভাগের নামে হত্যা মামলা হয়েছে। তাঁরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে আছেন। আবার কেউ কেউ নিজেদের ওপর হামলা হবে, এমন আশঙ্কা থেকে কার্যালয়ে যাচ্ছেন না।
চেয়ারম্যানরা বলছেন, তাঁদের অপসারণ করলে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। চুরি, ডাকাতি বেড়ে যাবে। নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের (মেম্বার) অপসারণ না করার দাবি জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, দেশে এখন ইউনিয়ন পরিষদ আছে ৪ হাজার ৫৮০টি। এর মধ্যে ৩ হাজার ১৬৪ জন চেয়ারম্যান নিয়মিত অফিস করছেন। তবে কত সংখ্যক ইউপি সদস্য বা মেম্বার অনুপস্থিত, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
এমন বাস্তবতায় শুধু দেড় হাজার নয়, সাড়ে ৪ হাজার ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারকেই অপসারণের চিন্তাভাবনা করছে সরকার। এ নিয়ে দোটানায় রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। তৃণমূলের এসব জনপ্রতিনিধিকে অপসারণ করার পর সেখানে বিপুলসংখ্যক প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। এত কর্মকর্তা কোথায় পাওয়া যাবে কিংবা সেই প্রশাসকেরা আদৌ কাজ করতে পারবেন কি না, এ নিয়ে আলোচনা চলছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।
অবশ্য স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে না দিয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে পরিষদ পরিচালনা করলে সেটি বেশি কার্যকর হবে।
প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া ঠিক হবে না জানিয়ে স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, যেসব ইউনিয়ন পরিষদে চেয়ারম্যান অনুপস্থিত, সরকারের উচিত হবে প্রথমে তাঁদের নোটিশ দেওয়া। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তাঁদের পরিষদে উপস্থিত হওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া। এ সময়ে না এলে আসন শূন্য ঘোষণা করা। তারপর সদস্যদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। অথবা প্রতিটি এলাকায় সর্বজনবিদিত কাউকে চেয়ারম্যান হিসেবে বসানো যেতে পারে।
নাগরিক সেবা ব্যাহত
নোয়াখালী, গাজীপুর, নরসিংদী, মুন্সিগঞ্জ ও ফেনী জেলার কয়েকটি ইউনিয়ন পরিষদে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ আগস্টের পর থেকে অনেক ইউপি চেয়ারম্যান পলাতক। কেউ কেউ হত্যা মামলার আসামি। কেউ গ্রেপ্তার এড়াতে, কেউ হামলা থেকে বাঁচতে আত্মগোপনে রয়েছেন। মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, চেয়ারম্যান পলাতক, এমন বেশ কিছু ইউপিতে প্যানেল চেয়ারম্যান বসানো হয়েছে। কোথাও কোথাও দেওয়া হয়েছে প্রশাসক। ৭৮৬টি ইউনিয়ন পরিষদে এরই মধ্যে প্যানেল চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।
ফেনীর ৪৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৩টি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানরা বর্তমানে কর্মরত। তাঁদের মধ্যে সোনাগাজীতে বিএনপির একজন ও দাগনভূঞার আওয়ামী লীগের দুজন কর্মরত রয়েছেন। অপর ৪০ ইউনিয়নে প্রশাসক হিসেবে হয় ইউএনও নয়তো এসি ল্যান্ড (অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার, ভূমি) দায়িত্ব পালন করছেন।
বাংলাদেশ ইউনিয়ন পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন বলছে, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিলে কিংবা চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে প্রান্তিক পর্যায়ে সরকারি সেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে। চেয়ারম্যানরা বলছেন, তাঁদের অপসারণ করলে গ্রামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হবে। চুরি, ডাকাতি বেড়ে যাবে। নির্বাচিত চেয়ারম্যান ও সদস্যদের (মেম্বার) অপসারণ না করার দাবি জানিয়েছেন অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার কুর্শা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মেয়াদ শেষ করতে চান। এর আগে অপসারণ চান না। চেয়ারম্যানদের অপসারণ করলে স্থানীয় পর্যায়ে সেবা পুরোপুরি স্থবির হয়ে যাবে। সরকার চাইলে রাষ্ট্রীয় বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের তথ্যমতে, ইউপি চেয়ারম্যানরা বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, প্রতিবন্ধী ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা বিতরণের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত থাকেন। ওয়ারিশ সনদ, চারিত্রিক সনদ, জন্মনিবন্ধন, মৃত্যুনিবন্ধনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে। গ্রামে বিভিন্ন সালিস, নতুন রাস্তা নির্মাণ, পুরোনো রাস্তা সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণ ইউনিয়ন পরিষদ থেকে হয়ে থাকে।
চেয়ারম্যান না থাকায় ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে এই মুহূর্তে সেবা কতটা ব্যাহত হচ্ছে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার একটি ইউপির প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, নাগরিক সেবার মূল কাজটা ইউপি সদস্যরা চালিয়ে নিচ্ছেন। ইউপি সদস্যরা না থাকলে চরম সংকট দেখা দেবে।
কেন অপসারণের কথা উঠল
জনপ্রতিনিধিদের অপসারণের কথা কেন উঠল, সে তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে কয়েকটি কারণ জানা গেল। প্রথমত, বিগত স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ আছে। একতরফা ওই নির্বাচনে প্রতিযোগিতা হয়নি, বিরোধীরা সুযোগ পাননি। এ কারণে অনেকে ওই নির্বাচন বাতিল করে জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ চান। দ্বিতীয়ত, বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের অপসারণে বড় ধরনের চাপ রয়েছে। তৃতীয়ত, দেড় হাজারের মতো ইউপি চেয়ারম্যান অনুপস্থিত। সেখানে কার্যক্রম স্বাভাবিক করতে সব চেয়ারম্যান, মেম্বারকেই অপসারণের চিন্তাভাবনা চলছে।
অপসারণ নিয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বলছে, ৪ হাজার ৫৮০ ইউনিয়নে ১২ জন করে ইউপি সদস্যের বিকল্প হিসেবে ৫৪ হাজার ৯৬০ জন প্রশাসক নিয়োগ দিতে হবে। সেখানে মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক কিংবা জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা এ-ও বলছেন, এভাবে সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে ইউনিয়ন পরিষদ চালানো মুশকিল হবে। তাঁদের নিজেদের কাজ রয়েছে। আদতে কাজের কাজ কিছুই হবে না। তার চেয়ে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে পরিচালনা করলে সেটি ভালো হবে।
এর আগে গত আগস্টে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের পাশাপাশি সব পৌরসভার মেয়রকে অপসারণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। ১২টি সিটি করপোরেশনের মেয়র, কাউন্সিলরদের পাশাপাশি পৌরসভার কাউন্সিলরদেরও অপসারণ করা হয়।
বিগত স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ আছে। আসলে সেসব নির্বাচনে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। একদলীয় নির্বাচন হয়েছিল। তাই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সে কারণে অনেকে ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণ চান।সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু আলম মো. শহিদ খান মনে করেন, ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত হবে না। এতে নাগরিক সেবা ব্যাহত হবে। চেয়ারম্যানদের পরিবর্তে যাঁদের দায়িত্ব দেওয়া হবে, তাঁরা নাগরিকদের সেবা দিতে পারবেন না। তিনি বলেন, যাঁরা পলাতক, সরকার চাইলে শুধু তাঁদের অপসারণ করতে পারে। যেসব ইউপিতে চেয়ারম্যানরা আসছেন না, সেখানে প্যানেল চেয়ারম্যান দিয়ে কাজ করা যেতে পারে। তবু প্রশাসক নিয়োগ নয়।
আবু আলম মো. শহিদ খান আরও বলেন, বিগত স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে অনেকের মধ্যে ক্ষোভ আছে। আসলে সেসব নির্বাচনে কোনো প্রতিযোগিতা ছিল না। একদলীয় নির্বাচন হয়েছিল। তাই নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন আছে। সে কারণে অনেকে ইউপি চেয়ারম্যানদের অপসারণ চান।
স্থানীয় সরকারবিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদও প্যানেল চেয়ারম্যান দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, ইউপিতে সরকারি কোনো কর্মকর্তাকে নিয়োগ দিলে কাজের কাজ কিছু হবে না।