‘২৫ বছর ধরে অনেক কষ্টে সংসার করেছে আমার মেয়ে। একটুও সুখের দেখা পায়নি। এখন সংসারে সুখ ফিরতেই মেয়েটা মারা গেল।’ পাহাড়ধসে পরিবারের দুই শিশুসহ নিহত গৃহবধূ মমতাজ বেগমের (৪৫) ঘরের সামনে বসে কথাগুলো বলছিলেন তাঁর মা রাসু বেগম (৬৮)। আজ রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়া এলাকার সেগুনবাগিচা এলাকায় গিয়ে কথা হয় রাসু বেগমের সঙ্গে।
এর আগে ভোর পাঁচটার দিকে মমতাজ বেগমের আধা পাকা বসতঘরে পাহাড় ধসে পড়ে। এতে ঘরের দেয়ালে চাপা পড়ে মৃত্যু হয় গৃহবধূ মমতাজ বেগম, তাঁর মেয়ে ময়না আকতার (১২) ও নাতি মো. তোহার (৮)। পাহাড়ধসের সময় তিনজনই বসতঘরটির ভেতরে ঘুমিয়ে ছিলেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, শিলখালী ইউনিয়নের জারুলবনিয়া স্টেশন থেকে পাহাড়ি পথ ধরে এক কিলোমিটার গেলে সেগুনবাগিচা গ্রাম। সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে গৃহবধূ মমতাজের আধা পাকা বসতঘরটি। এর মাত্র ২০ ফুট দূরত্বে পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত আরেকটি ঘরে থাকেন মমতাজ বেগমের মা রাসু বেগম।
সরেজমিনে স্থানীয় একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা জানান, মমতাজের স্বামী সরওয়ার কামাল একসময় ওমানে থাকতেন। তবে সুবিধা করতে না পেরে সেখান থেকে দেশে ফিরে দিনমজুরি করে সংসার চালাতেন। অনেক দুঃখে-কষ্টে সংসার চালাতে হতো। তবে দুই বছর আগে সংযুক্ত আরব আমিরাতে শ্রমিক হিসেবে যাওয়ার সুযোগ হয় সরওয়ারের। সেখানে যাওয়ার পর থেকে সংসারের দুঃখকষ্ট ঘুচতে শুরু করে। স্বামীর আয়ের টাকায় এক বছর আগে দুই কক্ষের সেমিপাকা ঘরটি নির্মাণ করেছেন মমতাজ বেগম।
মমতাজের দুই মেয়ে, এক ছেলে। ছেলে মুবিনুল ইসলাম চট্টগ্রামে থেকে (১৮) টিউবওয়েল বসানোর কাজ করেন। বড় মেয়ে রিফা আকতারের বিয়ে হয়েছে। মমতাজ বেগম তাঁর ছোট মেয়ে ময়না আকতার এবং রিফার ছেলে মো. তোহাকে নিয়ে বসতঘরটিতে থাকেন।
মমতাজ বেগমের মা রাসু বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাতে ঘরে মমতাজ বেগম ও দুই শিশু ঘুমিয়ে ছিল। ভোর ছয়টার দিকে উঠে প্রথমে দেখি, মমতাজের মুরগির খাঁচার ওপর পাহাড় ধসে পড়েছে। দৌড়ে গিয়ে মমতাজকে ডাকি এবং মুরগির খাঁচা থেকে মাটি সরানোর চেষ্টা করি। একটু পরই ঘরের জানালা দিয়ে দেখি আমার মেয়ের পুরো শরীর মাটির স্তূপের নিচে, কেবল চেহারাটা দেখা যাচ্ছে। ময়না ও তোহাকে দেখা যাচ্ছে না। আমার চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে স্থানীয় লোকজন এগিয়ে এসে কোদাল দিয়ে মাটি ও ভাঙা দেয়াল সরিয়ে তিনজনের লাশ উদ্ধার করেন।’ মেয়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে রাসু বেগম বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার অসুখ হলে মেয়েটা ছুটে এসে সেবা করত। এখন আমাকে কে দেখবে!’
দুই কক্ষের বসতঘরটিতে গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষ পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। তিনজনের লাশ উদ্ধার করা হলেও ওই কক্ষে থাকা খাটসহ আসবাব মাটি ও ইটের দেয়ালের নিচে চাপা পড়া রয়েছে।
মমতাজের প্রতিবেশী হাসিনা বেগম (৫০) বলেন, গতকাল শনিবার দুপুরের দিকে মমতাজের রান্নাঘরের পাকা দেয়ালের ওপর পাহাড়ের একটি অংশ ধসে পড়ে। মমতাজ মাটি সরিয়ে ইটগুলো ওখানেই স্তূপ করে রাখে। পরে রাতে ঘুমিয়ে পড়লে বসতঘরের আরেকটি অংশে পাহাড় ধসে পড়ে মমতাজসহ তিনজনের মৃত্যু হয়।
স্থানীয় লোকজন জানান, মমতাজ তিন বছর আগে পাহাড়ের চূড়ায় আরেকটি ঘর করেছিলেন। পাহাড়ধসে ওই ঘরও ভেঙে গিয়েছিল। এরপর আধা পাকা বসতঘরটি নির্মাণ করা হয়।
মমতাজের ছেলে মুবিনুল ইসলাম বলেন, তিনি চট্টগ্রামের কর্ণফুলী এলাকায় নলকূপ বসানোর কাজ করেন। কর্মসূত্রে সেখানেই ছিলেন। এর মধ্যেই সকালে মা, বোন ও ভাগনের মৃত্যুর খবর শুনেছেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সংসারের জন্য অনেক কষ্ট করেছে আমার মা। এখন আমি আয় করছি, বাবাও আয় করছে। সুখ পাওয়ার সময়ে আমার মা আমাকে ছেড়ে চলে গেল।’
শিলখালী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি নির্মাণের কারণে তিনটি প্রাণ হারাতে হলো। এলাকায় আরও অনেক ঝুঁকিপূর্ণ বসতি রয়েছে। এসব বসতির বাসিন্দাদের সরিয়ে না নিলে আরও প্রাণহানির শঙ্কা রয়েছে।
পেকুয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাইফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, যাঁদের বসবাস পাহাড়ের পাদদেশে কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে, তাঁদের দ্রুত সরে যেতে বলা হয়েছে। ভারী বৃষ্টিতে আরও পাহাড়ধস হতে পারে।