হেমন্ত হলো হলুদের ঋতু। ঋতুকন্যা হেমন্ত এ দেশে নিয়ে আসে হলুদ আর সোনালি রঙের সম্ভার। মাঠে মাঠে সোনালি পাকা ধান কাটার উৎসব। ওই সোনার কৌটায় যেন লুকিয়ে রয়েছে আমাদের প্রাণভোমরা, আমাদের খাদ্যের আশ্বাস। ধান কাটার পর কার্তিকের কুয়াশায় ভিজে মাটি সিক্ত হয়, মাঠের পর মাঠ তখন ছড়াতে শুরু করে শর্ষের হলুদ রং।
কবি জীবনানন্দ দাশের ভাষায়, ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে,—/ হেমন্তের মাঠে–মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল;/ অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/ বাঁশ–পাতা—মরা ঘাস—আকাশের তারা!/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা!’ হেমন্তের সেই হিমাবেশ আর ফিনফিনে কুয়াশা নামা শিশিরে ভেজা দূর্বাদল শুধু কবিদেরই মন ভরায় না, প্রকৃতিরসিক সবাইকে মুগ্ধ করে। এমনই এক হেমন্তদিনে মুগ্ধতা ছড়াল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের সামনে সবুজ ঘাসের গালিচার কিনারে থাকা একটি গাছের ঝোপে ফুটে থাকা হলুদ কাঞ্চন ফুলগুলো।
এ দেশে কাঞ্চন কোনো বিরল ফুল নয়, এখানে-ওখানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে কাঞ্চন ফুলের গাছ। এ দেশে কাঞ্চনের ১৭টি প্রজাতি থাকলেও অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা তাঁর শ্যামলী নিসর্গ বইয়ে ঢাকা শহরে তিন প্রজাতির কাঞ্চন রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন। এ তিন প্রজাতির কাঞ্চনগাছের বাংলা নাম হলো রক্তকাঞ্চন (Bauhinia variegata), দেবকাঞ্চন (Bauhinia purpurea) ও শ্বেতকাঞ্চন (Bauhinia acuminata)। তিনটি প্রজাতিই ফ্যাবেসি গোত্রের, অর্থাৎ তারা একই পরিবারের তিন সহোদর। রক্তকাঞ্চনের ইংরেজি নাম হংকং অর্কিড ট্রি, দেবকাঞ্চনের ইংরেজি নাম অর্কিড ট্রি বা বাটারফ্লাই ট্রি এবং শ্বেতকাঞ্চনের ইংরেজি নাম স্নো অর্কিড ট্রি। এদের প্রজাতিগত নামাংশ বাউহিনিয়া রাখা হয়েছে দুজন যমজ ভাই যোহান বুহিন ও গ্যাসপার্ড বুহিনের নামের সম্মানে। তাঁরা দুজন ছিলেন ষোড়শ শতাব্দীর দুজন বিখ্যাত সুইস উদ্ভিদবিজ্ঞানী। এই তিন কাঞ্চনেরই আদি নিবাস ভারতীয় উপমহাদেশ ও মিয়ানমার। বিশেষ করে ভারতের শুষ্ক অঞ্চলের অরণ্যভূমি এদের জন্মভূমি।
বহুদিন ধরে এ তথ্যই জানতাম। কিন্তু ঢাকা শহরে যে হলুদ কাঞ্চন (Bauhinia tomentosa) নামের আরেক প্রজাতির কাঞ্চনগাছ আছে, তা সেভাবে খুঁজে দেখা হয়নি। কয়েক বছর আগে সাভারে মাশরুম সেন্টারের আঙিনায় একটি হলুদ কাঞ্চনের দেখা পেয়েছিলাম, কিন্তু ঢাকায় একে প্রথম পেলাম। ছড়ানো ডালপালার সে গাছটির ডালে ডালে ফুটে আছে অনেকগুলো ফুল, ফুলে ফুলে চলছে খুদে মৌমাছিদের আনাগোনা। হলুদ কাঞ্চনগাছ দুর্লভ না হলেও খুব একটা চোখে পড়ে না। হলুদ কাঞ্চনের অন্য নাম বনচাঁপা, কাছানর ও লোম কাঞ্চন। হলুদ কাঞ্চন একটি ছোট বৃক্ষজাতীয় গাছ, লম্বায় বড়জোর ৪ মিটার হয়, প্রধান কাণ্ড থেকে জন্মানো সরু ডালপালা নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। পাতা অন্য কাঞ্চনগাছের পাতার মতোই দুটি ফলকবিশিষ্ট, তবে আকারে ছোট। ফুল ঘণ্টাকৃতি, পাপড়ি হলুদ।
যেকোনো বাগানে বৈচিত্র্য আনার জন্য গাছটি নির্বাচন করা যেতে পারে। এ দেশে লাল কাঞ্চন ও লতা কাঞ্চনগাছও দেখার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এখনো দেখা পাইনি খুদি কাঞ্চন, বনকাঞ্চন, বিলাতি কাঞ্চন ও নাগপাত কাঞ্চনের। জমিদার নরেন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর মতো যদি একালেও কেউ বলধা উদ্যানের মতো কোনো উদ্যান রচনায় এগিয়ে আসেন, তবে হয়তো তার কোনো একটা অংশ তিনি সাজানোর পরিকল্পনা নিতে পারেন সব কাঞ্চন-কন্যাদের দিয়ে, নামটাও হতে পারে ‘কাঞ্চনবাগ’। এখন যেভাবে মানুষ প্রকৃতিযাপনের প্রয়াস করছেন, আগ্রহী হচ্ছেন গাছপালা লাগাতে, তাতে হয়তো সে রকম কাউকে শিগগিরই আমরা পেয়ে যাব। বিশেষ করে এখন যেসব শৌখিন রিসোর্ট-মোটেল ও ব্যক্তিগত উদ্যান গড়ে উঠছে, সেসব জায়গাতেও কাঞ্চন-কন্যাদের ঠাঁই হতে পারে।
প্রকৃতির কী রহস্য! কাঞ্চন-কন্যারা সব এক পরিবারের হলেও এদের ফুলের রং ও ফুল ফোটার সময়গুলো আলাদা। রক্তকাঞ্চনের ফুলের রং ঘন ম্যাজেন্টা, ফোটে শীতকালে, বসন্তেও কিছু ফুল দেখা যায়। দেবকাঞ্চনের ফুল গোলাপি বা হালকা বেগুনি, ফোটে বসন্তে। শ্বেতকাঞ্চনের ফুলের রং দুধের মতো ধবধবে সাদা, ফোটে বসন্ত থেকে শরতে। আর হলুদ কাঞ্চন ফুলের রং শর্ষে হলুদ, ফুলের মাঝখানে কেন্দ্রস্থল মেরুন খয়েরি, ফোটে হেমন্তে। বিরল এই হলুদ কাঞ্চন ছড়িয়ে পড়ুক বাগানে বাগানে।