১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের শুরু থেকেই নিশ্চিত হয়ে উঠতে শুরু করেছিল মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির বিজয়। অংশগ্রহণকারীদের জবানিতে সেসব বিজয়দিনের কাহিনি।
১ ডিসেম্বর ১৯৭১। তারায় তারায় খচিত আকাশের নিচে কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের রাত। থমথমে নৈঃশব্দ্য ভেঙে থেকে থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিপোকার ডাক। বিশাল বাঁশঝাড়ের অন্ধকারে জোনাকি পোকার রহস্যময় আনাগোনা।
স্থান, আখাউড়ার অদূরে তিতাস নদীর তীরঘেঁষা সিংগাইর বিল, মুকুন্দপুর ও আজমপুর। এই পুরো এলাকা তখন পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ পাঠান রেজিমেন্ট তথা ১২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের দখলে।
এই এলাকা শত্রুমুক্ত করার জন্য জড়ো হয়েছে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রায় ৮০০ পোড়খাওয়া মুক্তিসৈনিক। তাঁদের প্রায় সবাই ইতিমধ্যে ৯ মাস ধরে যুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। মুকুন্দপুরের উল্টো দিকে তাঁদের অবস্থান। পেছনে আগরতলা বিমানবন্দর।
একটা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে কোম্পানি অধিনায়কদের সঙ্গে আমি আক্রমণের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি পরীক্ষা করছিলাম। আমার শরীরে তখন অজানা বিপদের অনুভূতি। এই তো চার মাস আগেই ময়মনসিংহের কামালপুরে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের যুদ্ধে চোখের সামনে শহীদ হতে দেখেছি ৩৫ জন সহযোদ্ধাকে; যদিও প্রতিটি খড়িতে আঁকা (সেট পিস) যুদ্ধের আঙ্গিক ভিন্ন, ভিন্ন তার ক্ষেত্র ও পরিবেশ।
অভিজ্ঞতা থেকে জানি, এ রকম যুদ্ধে রক্তপাত, একাধিক মৃত্যু ও ক্ষয়ক্ষতি অবশ্যম্ভাবী। সহযোদ্ধাদের দিকে তাকিয়ে ভাবছিলাম, ভোর না হতেই হয়তো অনেকের মুখেই অমোঘ মৃত্যুর ছায়া পড়বে। আসলে অবচেতন মনে মৃত্যুচিন্তা যোদ্ধার নিত্যসঙ্গী। কিন্তু একজন অধিনায়ক মৃত্যুর এই ভাবনাকে ক্রমাগত পরাজিত করেন। তিনি সব ভয়কে লুকিয়ে রাখেন আশাবাদী আচরণের আড়ালে।
আগেই ঠিক করা ছিল, রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ভারতীয় গোলন্দাজরা আমাদের আক্রমণে সহায়তা করার জন্য আগরতলা বিমানবন্দরের পেছন থেকে দূরপাল্লার ভারী কামানের গোলাবর্ষণ শুরু করবে। চারদিকের নৈঃশব্দ্য ভেঙে ঠিক সময়ই তা ঘটল। ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর লক্ষ্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১২ নম্বর এফএফ রেজিমেন্ট।
আমাদের আক্রমণে সহায়তার জন্য সেদিন ভারতীয় বাহিনী গোলা নিক্ষেপে কোনো কার্পণ্য করেনি। গোলাবর্ষণের প্রচণ্ডতা ও তীব্রতা এমন ছিল যে অনেক দূরেও আমাদের পায়ের নিচের মাটি কাঁপছিল। আমার নেতৃত্বাধীন ব্যাটালিয়ন গোলাবর্ষণের সহায়তায় দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে। শত্রুদের হটিয়ে তিতাস নদীর পাড়, মুকুন্দপুর, সিংগাইর বিল আর আজমপুর মুক্ত করাই ছিল আমাদের লক্ষ্য। শত্রুবাহিনী থেকে ৪০০ মিটার দূরে থাকতেই পূর্বপরিকল্পনা অনুসারে বন্ধ হয়ে যায় দূরপাল্লার কামানের গোলাবর্ষণ। এরপর আমাদের সৈন্য এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মধ্যে শুরু হয় মেশিনগান আর রাইফেলের অবিরাম গোলাগুলি।
কুয়াশায় ঢাকা সে রাতে যুদ্ধ পরিচালনা ছিল অত্যন্ত কঠিন। ভোর না হতেই শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের তুমুল পাল্টা আক্রমণ। দূরপাল্লার ভারী কামান, মেশিনগান ও দুটি ‘এফ-৮৬ সেবর জেটের’ সাহায্যে তাদের এই পাল্টা আক্রমণ ছিল এককথায় প্রচণ্ড। ২ ডিসেম্বর সারা দিন ধরে এ যুদ্ধ চলে। শেষ অবধি আমাদের পিছু হটাতে না পেরে ৩ ডিসেম্বর ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ধরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়। ফলে সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল ও মহাসড়কের মনতলা, হরশপুর, মুকুন্দপুর থেকে শাহবাজপুর পর্যন্ত পুরো এলাকা আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
সেদিনের সেই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে হারিয়েছি অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে। এর মধ্যে মনে পড়ে ব্রাবো (বি) কোম্পানির কমান্ডার লেফটেন্যান্ট বদিউজ্জামানের নাম। যুদ্ধ চলাকালেই তাঁকে আজমপুর রেলস্টেশনের পাশে সমাহিত করা হয়।...সুবেদার আশরাফসহ আরও আটজন বীর মুক্তিযোদ্ধা আখাউড়া যুদ্ধে শহীদ হন, যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে সেদিন আমরা একটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল মুক্ত করতে সক্ষম হই।
সূত্র: এক জেনারেলের নীরব সাক্ষ্য: স্বাধীনতার প্রথম দশক, মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম, মাওলা ব্রাদার্স, ২০০০
মেজর জেনারেল (অব.) মইনুল হোসেন চৌধুরী বীর বিক্রম: প্রয়াত সেনা কর্মকর্তা; বীর মুক্তিযোদ্ধা; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা।