মা ছেড়ে গেছেন, বাবা মৃত, সৌদিফেরত চার ভাইবোন আর বিচ্ছেদ চায় না

চার ভাইবোন একসঙ্গে থাকতে চায়। শিশু পরিবারে বালক–বালিকাদের প্রতিষ্ঠান ভিন্ন। ভাইটির বিষয়ে কী করা যায়, ভাবছেন কর্মকর্তারা।

  • ইন্দোনেশীয় মা ফিরে গেছেন।

  • বাংলাদেশি বাবা মৃত।

বিছানায় ১৩ বছর বয়সী বড় বোনের পাশে গায়ে গা লাগিয়ে গুটিসুটি মেরে বসে ছিল ছোট দুই বোন। পাশের বিছানায় ভাই ছিল আধশোয়া অবস্থায়। কদিন আগে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে এসেছে তারা। সৌদি আরবে জন্ম, বেড়ে ওঠা।

ইন্দোনেশীয় মা ছেড়ে যাওয়ায় আর বাংলাদেশি বাবার মৃত্যুর পর চেনা দেশ থেকে একদম অচেনা জায়গায়, অচেনা মানুষের মধ্যে। বড় বোনের চেহারায় অনিশ্চয়তার ছাপ ছিল স্পষ্ট। পারিবারিক বিপর্যয় আর তিন ভাইবোনের দায়িত্ব তাকে মানসিকভাবে বড় করে ফেলেছে। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে তিনটায় ওই চার শিশুর সঙ্গে দেখা হয় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে সমাজসেবা অধিদপ্তর পরিচালিত সরকারি শিশু পরিবারে (বালিকা)।

সরকারি শিশু পরিবারের (বালিকা) উপতত্ত্বাবধায়ক ঝর্ণা জাহিন প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি শিশু পরিবারে ছেলে ও মেয়েদের থাকার জায়গা আলাদা। কিন্তু চার ভাইবোন কিছুতেই আলাদা থাকতে চাইছে না। ছেলেটিকে অল্প কিছুদিনের জন্য এখানে রাখা সম্ভব হবে।

৭ জানুয়ারি প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় ওই চার শিশুকে দেশে ফিরিয়ে আনে। ওই শিশুদের রাখা হয়েছে সরকারি শিশু পরিবারে। শিশুরা বাংলা ও আরবি ভাষা জানে।

শিশুদের বাবার নাম জাহাঙ্গীর আলম (৫৪), মায়ের নাম সাইদাহ বিনতে মুনাওয়ার (৪১)। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাবা মারা যান। চার ভাইবোনকে আপাতত দোতলার ছয় আসনসংখ্যার একটি কক্ষে রাখা হয়েছে। ওই কক্ষে বসে কথা হয় বড় বোন জামিলা জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। বাকি তিন ভাইবোনের নাম মুজাহিদ জাহাঙ্গীর (১০), জেসমিন জাহাঙ্গীর (৭) এবং সামিয়া জাহাঙ্গীর (৬)।

জামিলা বারবারই বলছিল, ‘ভাইরে ছাড়া কোথাও যাব না। আমরা একসঙ্গে থাকতে চাই।’ শিশুদের সঙ্গে ঘণ্টাখানেক সময় কাটানোর এক ফাঁকে ভাই মুজাহিদও বলল, ‘আমি আফার (জামিলা) সঙ্গে থাকতে চাই।’ শিশু পরিবারটিতে ৬ থেকে ১৮ বছর (কয়েকজন ১৮ বছরের বেশি) ১৩৮টি মেয়ে রয়েছে।

যা জানা গেল

শিশু পরিবারের কর্মকর্তা ও জামিলার কাছ থেকে জানা গেল, শিশুরা পরিবারের সঙ্গে থাকত সৌদি আরবের জেদ্দায়। মা ও বাবার কোনো স্বজনকে চেনে না শিশুরা। বাবা একসময় টাইলসমিস্ত্রি ছিলেন, পরে সবজির দোকান দেন। পরিবারটিতে বিপর্যয় শুরু হয় ছয় বছর আগে মা কাউকে কিছু না বলে চলে যাওয়ার পর।

জামিলার ভাষায়, একদিন বিকেলে সে বাবার সবজির দোকান থেকে বাসায় ফিরে দেখে, মায়ের কোনো জিনিস নেই। মা ফোনও ধরেনি। মা কখনো আর যোগাযোগ করেনি।

জামিলা জানাল, সে একটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছে, ভাই পড়েছে প্রথম শ্রেণি পর্যন্ত। বাকি দুই বোন স্কুলে যায়নি। মা চলে যাওয়ার দু–এক মাস পর বাবা অসুস্থ হতে শুরু করে। পরে চোখ নষ্ট হয়ে যায়, কিডনিতেও সমস্যা ছিল। দোকান দেখাশোনার দায়িত্ব দেওয়া হয় বাবার এক বন্ধুকে। দোকান থেকে তারা তেমন অর্থকড়ি পেত না। মৃত্যুর আগে বাবা দুই বছর হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। ওই সময় এক সৌদি নারী তাদের খাবার ও থাকার জায়গা দেন।

বাবার মৃত্যুর খবর ওই নারী বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানান। তবে বাবার কাগজপত্রে ত্রুটি থাকায় তাঁর মরদেহ ৯ মাস হিমঘরে রাখার পর দাফন হয়। ওই সময় তাদের চার ভাইবোনের থাকার ব্যবস্থা হয় দূতাবাসের জিম্মায়।

জামিলা বলে, ‘আমরা সৌদি আরবেই থাকতে চেয়েছিলাম। বাংলাদেশে নিয়ে আসা হবে, জানতাম না। এখন অনেক ভয় লাগছে। ভাই ছাড়া থাকতে চাই না।’ সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) কামরুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাজধানীর শ্যামলীতে অবস্থিত এসওএস শিশুপল্লীতে ছেলে ও মেয়েদের পরিবারের আদলে রাখা হয়। ভাইবোনদের সেখানে রাখা যায় কি না, দেখছি আমরা।’

পাসপোর্টের তথ্য ধরে ফোন

শিশুদের মা–বাবার পাসপোর্টে তাঁদের নাম, বয়স ও ঠিকানা রয়েছে। জাহাঙ্গীর আলমের বাবার নাম আলী আকবর খান। মায়ের নাম সমুদা খাতুন। স্থায়ী ঠিকানা কক্সবাজারের নবগঠিত ঈদগাঁও উপজেলার জাগিরপাড়া। স্ত্রীর নামের জায়গায় সুফিয়া নামের এক নারীর নাম লেখা। জরুরি যোগাযোগের ঠিকানায় সুফিয়ার নাম, একই স্থায়ী ঠিকানা ও একটি মুঠোফোন নম্বর।

ওই নম্বরে এই প্রতিবেদক ফোন করলে একজন পুরুষ ধরেন। তিনি জানান, সুফিয়া, জাহাঙ্গীর বা জাগিরপাড়ার কাউকে তিনি চেনেন না। ২০০৯ সাল থেকে নম্বরটি ব্যবহার করছেন। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের পরিচালক (প্রশাসন ও উন্নয়ন) মুশাররাত জেবীন প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিশুদের কোনো নিকটাত্মীয়ের খবর পাওয়া যায়নি। সৌদি আরবে ওই শিশুদের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই বলে ফিরিয়ে আনতে হয়েছে।’