মাত্র চার বছরের ব্যবধানে এসব যন্ত্রের পেছনে আরও হাজার কোটি টাকা খরচ করার প্রয়োজন কেন দেখা দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে ২০১৮ সালে দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিল নির্বাচন কমিশন।
ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুন মাসে শেষ হবে।
নির্বাচন কমিশন ২০১৮ সালে দেড় লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনেছিল। এসব ইভিএমের মধ্যে এখন প্রায় ৪০ হাজার যন্ত্র নষ্ট। বাকি ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএমেরও মেরামত প্রয়োজন বলে মনে করছে নির্বাচন কমিশনকে এই যন্ত্র সরবরাহ করা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি লিমিটেড (বিএমটিএফ)। এসব যন্ত্র মেরামতে ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
ইসি সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিএমটিএফের প্রতিনিধিদের বৈঠকে এসব বিষয় জানানো হয়। আজ সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি বৈঠকে ইভিএম মেরামতের জন্য ১ হাজার ২৬০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়ার বিষয়টি ইসি সচিবালয় তুলবে বলে জানা গেছে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের অধীনে দেড় লাখ ইভিএম কিনেছিল। ওই প্রকল্পের মেয়াদ চলতি বছরের জুনে শেষ হবে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে এসব যন্ত্রের পেছনে আরও হাজার কোটি টাকা খরচ করার প্রয়োজন কেন দেখা দিল, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হয়েছিল। বাকি আসনগুলোতে ভোট হয়েছিল কাগজের ব্যালটে। সে নির্বাচনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৭০০ কোটি টাকা। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন বর্তমান কমিশন আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএমে ভোট করার সিদ্ধান্ত নেয়। ইসি এত দিন বলে আসছিল, তাদের কাছে থাকা দেড় লাখ ইভিএমে ৬০ থেকে ৭০টি আসনে ভোট করা সম্ভব। ১৫০ আসনে ভোট করতে আরও দুই লাখ ইভিএম প্রয়োজন হবে।
এ জন্য ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠিয়েছিল ইসি। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্পটি স্থগিত করা হয়। এরপর ইসি বলেছিল, আগামী জাতীয় নির্বাচনে হাতে থাকা ইভিএমের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে চায় তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসি ভবন, ইসির ১০টি অঞ্চল এবং বিএমটিএফের কাছে ইভিএম সংরক্ষণ করা হয়। ইভিএমগুলোর কী অবস্থা, তা গত বছরের নভেম্বর থেকে তা যাচাই করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত পাঁচটি অঞ্চলের ইভিএমের গুণগত মান যাচাই (কোয়ালিটি চেকিং) কার্যক্রম শেষ হয়েছে। এসব অঞ্চলে ৬২ শতাংশের বেশি ইভিএমে সমস্যা (কোয়ালিটি ফেইল) দেখা গেছে। তবে বিএমটিএফ মনে করছে, সবগুলো যন্ত্রেরই মেরামত প্রয়োজন। গত বৃহস্পতিবার বিএমটিএফের প্রতিনিধির সঙ্গে নির্বাচন ভবনে নির্বাচন কমিশনের বৈঠকে বিষয়টি তুলে ধরা হয়।
ওই বৈঠকে উপস্থিত একাধিক সূত্র প্রথম আলোকে জানায়, বিএমটিএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ১ লাখ ১০ হাজার ইভিএমের মেরামত প্রয়োজন। এসব ইভিএমের সব কটির ব্যাটারি পরিবর্তন করতে হবে। ইভিএমের ভেতর যে ঘড়ি থাকে, সেটিও পরিবর্তন করা প্রয়োজন। বাকি ৪০ হাজার ইভিএম মেরামত অযোগ্য বলে বিএমটিএফ মনে করছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রথম আলোকে বলেন, ১ লাখ ৫০ হাজার ইভিএম দিয়ে ২০১৮ সাল থেকে মোট ১ হাজার ১৪৩টি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। প্রতিটি ইভিএম গত প্রায় পাঁচ বছরে তিন-চারবার ব্যবহার করা হয়েছে। আগামী জুন মাসে ইভিএম প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। যেহেতু প্রতিটি ইভিএম বিভিন্ন নির্বাচনে একাধিকবার ব্যবহৃত হয়েছে এবং এর ওয়ারেন্টি ও সার্ভিস সাপোর্টের মেয়াদও জুন মাসে শেষ হবে।
ফলে জাতীয় নির্বাচন এসব ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রতিটি ইভিএমের যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ জরুরি ও আবশ্যক। এ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিএমটিএফের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। একমাত্র উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা সব ইভিএমের রিফারবিশমেন্টের (মেরামত) প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছে। কমিশন তাদের প্রস্তাব বিবেচনা করছে। আর্থিক সংগতি সাপেক্ষে কমিশন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।
ইসি সূত্র জানায়, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কতটি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা হবে, তা এখন মূলত নির্ভর করছে অর্থসংস্থানের ওপর। এসব যন্ত্র মেরামতে যে বড় অঙ্কের টাকা প্রয়োজন, তা ইসির কাছে নেই। সরকার অর্থ বরাদ্দ দিলে এ বিষয়ে পরবর্তী করণীয় ঠিক করবে ইসি।
ইসি সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে টাকা চাইবেন। আজ সোমবার অর্থ মন্ত্রণালয়ে বাজেট-সংক্রান্ত বৈঠক আছে। সেখানে বিষয়টি তুলে ধরা হবে।
নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে বিতর্ক আছে। ইসির সঙ্গে সংলাপে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এ যন্ত্র নিয়ে সংশয় ও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল। পাশাপাশি বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট পরিস্থিতিতে এ যন্ত্রের পেছনে বিপুল ব্যয় করা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ইভিএম প্রকল্প একটি শ্বেতহস্তী প্রকল্প। এ প্রকল্প নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। রাজনৈতিক বিতর্কের বাইরেও ইভিএমে প্রযুক্তিগত দুর্বলতা আছে। ইভিএম সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দেশের আবহাওয়াগত সমস্যা আছে, রক্ষণাবেক্ষণেও সমস্যা আছে। সব মিলিয়ে ইভিএম থেকে সরে আসাই হবে শ্রেয়।