পশু স্বাস্থ্যসেবা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এমএলএএফ) চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন
পশু স্বাস্থ্যসেবা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এমএলএএফ) চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন

সরাসরি বা অনলাইনে গরু কিনতে যে ভুলগুলো করা যাবে না

পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে গরু কেনা শুরু হয়েছে। কেউ হাটে গিয়ে কিনছেন। কেউ অনলাইনে কিনছেন। কেউ গরু কিনে খামারেই রেখে দিয়েছেন। ঈদ উপলক্ষে বছরে একবার গরু কিনতে গিয়ে অনভিজ্ঞ ক্রেতারা অনেক সময়ই পছন্দমতো গরু কিনতে পারেন না। অনেকে ঠকেও যান। সরাসরি বা অনলাইনে গরু কিনতে গিয়ে যেসব বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত এবং কেনার পর কীভাবে গরুর যত্ন নেওয়া উচিত, সে বিষয়ে ক্রেতাদের পরামর্শ দিয়েছেন দেশের শিক্ষা, গবেষণা ও পশু স্বাস্থ্যসেবা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা মডেল লাইভস্টক অ্যাডভান্সমেন্ট ফাউন্ডেশনের (এমএলএএফ) চেয়ারম্যান সালমা সুলতানা। তিনি বোরলগ ফিল্ড অ্যাওয়ার্ড ২০২০ পেয়েছেন। সিঙ্গাপুরভিত্তিক সাময়িকী এশিয়ান সায়েন্টিস্ট ২০২১ সালের ২৬ এপ্রিল সংখ্যায় এশিয়ার শীর্ষ বিজ্ঞানীদের যে তালিকা প্রকাশ করে, সেখানে তিনিও ছিলেন। সালমা সুলতানা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া স্টেট ইউনিভার্সিটিতে স্নাতক গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

প্রশ্ন

কোরবানির ঈদের জন্য গরু কেনার সময় ক্রেতারা কী কী ভুল করেন?

সালমা সুলতানা: গরুর জাত, স্বাস্থ্য ও কোরবানির উপযোগিতা সম্পর্কে যথেষ্ট তথ্য না জেনে গরু কিনতে চলে যান অনেক ক্রেতা। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তাঁরা গরুর ভেটেরিনারি পরীক্ষা করান না। গরুর আচরণ, স্বাস্থ্য ও শারীরিক অবস্থার ওপর নজর দেওয়া হয় না। ফলে গরুটি সুস্থ কি না, সে তথ্য তাঁদের জানা থাকে না। বয়স নির্ধারণ না করার কারণে শারীরিকভাবে পূর্ণবয়স্ক গরু কিনতেও ব্যর্থ হন। অজানা বা অনির্ভরযোগ্য বিক্রেতার কাছ থেকে কেনা এবং গরুর খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য সম্পর্কে না জেনে কেনার প্রবণতাও দেখা যায়।

প্রশ্ন

পূর্ণবয়স্ক গরু চেনা যায় কীভাবে?

সালমা সুলতানা: গরুর বয়স জানার সবচেয়ে ভালো উপায় হলো, এর দাঁত পর্যবেক্ষণ করা। গরুর দাঁতের সংখ্যা এবং সেই দাঁতের ক্ষয়ের পরিমাণ দেখে নির্ণয় করা যায় তার বয়স। একটা পূর্ণবয়স্ক গরুর মুখের ভেতর ৩২টি দাঁত থাকে। চার থেকে পাঁচ বছর বয়সের মধ্যে সামনের আটটা স্থায়ী দাঁতই উঠে যায়। পাঁচ বছর বয়সের পর থেকে গরুর দাঁতে ক্ষয়ের চিহ্ন দেখা দিতে শুরু করে।

প্রশ্ন

অনলাইনে গরু কেনার ক্ষেত্রে কী ধরনের সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?

সালমা সুলতানা: গরু কেনার ক্ষেত্রে গরুকে সামনাসামনি ছুঁয়ে দেখা জরুরি। অনলাইনে গরু কিনলে সেই সুযোগ থাকে না। এ ক্ষেত্রে নিজে ওই খামারে যেতে না পারলে স্থানীয় কোনো প্রাণিচিকিৎসক দিয়ে পরীক্ষা করিয়ে গরুর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জেনে নিতে হবে। বিক্রেতার সঙ্গে ভিডিও কলের মাধ্যমে গরুটি পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে গরু পাওয়ার পর আকৃতি–ওজন নিয়ে প্রতারিত না হতে হয়। গরুর ভেটেরিনারি স্বাস্থ্য রেকর্ড এবং টিকাকরণের কাগজপত্র যাচাই করা দরকার। বিশ্বস্ত ও রেটিং ভালো, এমন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে কেনাকাটা করা উচিত। বিক্রেতার রিটার্ন (ফিরিয়ে নেওয়া) নীতিমালা সম্পর্কেও জানা প্রয়োজন। আর অনলাইনে অর্থ পরিশোধের সময় প্রতারণা এড়াতে বিশ্বস্ত ও সুরক্ষিত পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করতে হবে। অর্থ পরিশোধের পর সব প্রমাণপত্র সংরক্ষণ করতে হবে। প্রথমে আংশিক এবং গরু পৌঁছানোর পর পুরো অর্থ পরিশোধ করা উচিত।

প্রশ্ন

কেউ কেউ বেশ আগে থেকে গরু কিনে খামারে রেখে দেন। এসব ক্ষেত্রে কী কী বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে?

সালমা সুলতানা: খামারটি ভালো মানের কি না, খামারটিতে পশুর স্বাস্থ্য ও খাবারের মান বজায় রাখা যায় কি না, তা নিশ্চিত হতে হবে। খামারে গরু রেখে দিলে গরুর স্বাস্থ্য সম্পর্কে নিয়মিত তথ্য নিতে হবে। আমাদের দেশে বিক্রয় ও যত্নের শর্তাদি উল্লেখ করে লিখিত চুক্তিপত্র করার বিষয়ে অনেকে সচেতন নন। এই চর্চা শুরু করা দরকার। বিক্রেতা গরুর স্বাস্থ্য ও উপযুক্ততার ওপর বিমা বা গ্যারান্টি (নিশ্চয়তা) দেয় কি না, তা নিয়েও খোঁজ করা দরকার।

প্রশ্ন

সুস্থ গরু চেনার উপায় কী?

সালমা সুলতানা: সুস্থ গরুর চোখ পরিষ্কার ও উজ্জ্বল থাকবে এবং চোখ থেকে কোনো ধরনের নিঃসরণ থাকবে না। চামড়া চকচকে ও মসৃণ থাকবে, চুলকানি থাকবে না। গরুর গায়ের তাপমাত্রা, হৃৎস্পন্দন এবং শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়মিত ও স্বাভাবিক থাকবে। দ্রুত মাথা, কান ও লেজ নেড়ে মশা-মাছি তাড়াবে। স্বাভাবিকভাবে খাবে ও জাবর কাটবে। মুখ ও চোখে শ্লেষ্মা ঝিল্লি গোলাপি ও আর্দ্র থাকবে। গরুর দেহে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে চাপ দিয়ে আঙুল সরিয়ে নিলে জায়গাটি যদি দেবে যায় এবং জায়গাটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে সময় নেয়, তাহলে বুঝতে হবে, গরুটিকে স্টেরয়েড দিয়ে অস্বাস্থ্যকর উপায়ে মোটা করা হয়েছে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে মোটা করা গরুর দেহে বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে চাপ দিয়ে আঙুল সরিয়ে নিলে জায়গাটিতে দেবে যাওয়ার কোনো চিহ্ন পাওয়া যায় না।

প্রশ্ন

সদ্য কাটা নেপিয়ার ঘাস খেয়ে এই সপ্তাহে একটি খামারে ২৭টি গরু মারা গেছে। গরুর সুস্থতার জন্য কী ধরনের খাবার খাওয়ানো উচিত?

সালমা সুলতানা: নেপিয়ার ঘাস সাধারণত গরুর জন্য পুষ্টিকর খাদ্য হিসেবে পরিচিত। বর্ষাকালে বাতাসে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বেশি থাকে এবং পানির সঙ্গে দ্রবীভূত হয়ে ঘাসে পড়ে। ফলে ঘাস প্রচুর বৃদ্ধি পায়। সদ্য কাটা নেপিয়ার ঘাসে অতিরিক্ত নাইট্রেট জমা হতে পারে, যা বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। এ অবস্থায় গরুর রক্তের হিমোগ্লোবিন নাইট্রেটের সঙ্গে বিক্রিয়া করে মেথিমোগ্লোবিনে রূপান্তরিত হয়, যা অক্সিজেন বহন করতে অক্ষম। ফলে অক্সিজেনের অভাব দেখা দেয় এবং গরু মারা যেতে পারে। সদ্য কাটা নেপিয়ার ঘাস না দিয়ে তা কিছুদিন শুকিয়ে তারপর খাওয়ানো উচিত।

ফাইল ছবি
প্রশ্ন

যে খাবার গরুর জন্য ক্ষতিকর, সেই খাবার খাওয়া গরুর মাংস মানুষের জন্যও কি ক্ষতিকর?

সালমা সুলতানা: হ্যাঁ, সেই গরুর মাংস মানুষের জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে। পচা বা ছত্রাকযুক্ত খাদ্য খেলে গরু বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগতে পারে, যেমন লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, শ্বাসকষ্ট, হজমের সমস্যা। এ ধরনের খাবার খাওয়ার কারণে গরুর মাংসে বিষাক্ত উপাদান ও ছত্রাকের অবশিষ্টাংশ জমা হতে পারে, যা মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে বিষক্রিয়া ঘটাতে পারে। কিছু গাছপালা যেমন ওলিয়ান্ডার, নাইটশেড ইত্যাদি গরুর জন্য বিষাক্ত। মুরগির মতো নন-রুমিন্যান্ট প্রাণীদের জন্য তৈরি খাবার গরুর জন্য উপযুক্ত নয়। মুরগির খাবারে থাকা অতিরিক্ত প্রোটিন বা নির্দিষ্ট ভিটামিন গরুর শরীরে বিষাক্ত উপাদান হিসেবে কাজ করতে পারে। মুরগির খাবারে প্রায়ই অ্যান্টিবায়োটিক থাকে, যা গরুর শরীরে জমা হতে পারে। এ ধরনের খাবার খাওয়া গরুর মাংস খেলে মানুষের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া তৈরি হতে পারে। ঝুঁকি এড়াতে পরিচ্ছন্নভাবে গরুর মাংস উচ্চ তাপমাত্রায় রান্না করা উচিত।

প্রশ্ন

কেনার পর এই গরমে গরুর কী ধরনের যত্ন নেওয়া উচিত?

সালমা সুলতানা: গরুর জন্য ছায়াযুক্ত ও বায়ু চলাচল হয়, এমন একটি স্থান নির্বাচন করা উচিত। রাস্তায় বা গ্যারেজে গরু রাখার পরিবর্তে একটি পরিষ্কার ও সুরক্ষিত জায়গা নিশ্চিত করা দরকার। গরুর থাকার জায়গা নিয়মিত পরিষ্কার ও জীবাণুমুক্ত রাখতে হবে। যথেষ্ট সবুজ ঘাস, শাকসবজিসহ পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি গরুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করাতে হবে। গরমে গরুকে শীতল রাখার জন্য মাঝেমধ্যে পানি ছিটানো যেতে পারে। ভেজা তোয়ালে দিয়ে গরুর গা মুছে দেওয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন

আপনাকে ধন্যবাদ।

সালমা সুলতানা: আপনাকেও ধন্যবাদ।