সমুদ্রে মাছ ধরার সরকারি নিষেধাজ্ঞার সময় ৭৫ শতাংশ মৎস্যশ্রমিক আর্থিক কষ্টে থাকেন। নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্যশ্রমিকদের দেওয়া খাদ্যসহায়তা একেবারেই অপ্রতুল। বরাদ্দ করা সরকারি চাল তাঁরা সঠিক পরিমাণে পান না। নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্যশ্রমিকদের খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দেওয়া জরুরি। আজ মঙ্গলবার ‘জেলে কার্ড পাওয়া বিষয়ে মাঠপর্যায়ের বাস্তবতা ও কিছু সুপারিশ’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন তার সহযোগী সংগঠন বিলস ও কোস্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত একটি গবেষণা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। এ প্রকল্পের অধীন প্রান্তিক মৎস্যশ্রমিকদের জেলে কার্ড পাওয়ার বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। জরিপের তথ্য সংবাদ সম্মেলনে তুলে ধরেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শেখ গিয়াস উদ্দিন আহমেদ।
বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়ন ও কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নে এ জরিপ পরিচালিত হয়। জরিপে ৮ হাজার ৬৪৪টি পরিবারের তথ্য সংগ্রহ করা হয়। এসব পরিবারের মোট সদস্যসংখ্যা ৪২ হাজার ৮৯৬।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, ৮০ শতাংশ পরিবারই একজনমাত্র উপার্জনকারীর আয়ের ওপর নির্ভরশীল। এসব পরিবারের মোট ১০ হাজার ৮২ জন মৎস্যকেন্দ্রিক পেশায় জড়িত। মৎস্যশ্রমিক পরিবারগুলোর প্রায় সবার প্রধান পেশা মৎস্য আহরণ।
জরিপে অংশ নেওয়া মৎস্যশ্রমিকদের মধ্যে সাড়ে ৪২ শতাংশ জেলে কার্ডধারী। এলাকাভেদে এ হারের ক্ষেত্রে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন পাথরঘাটা সদর ইউনিয়নে সাড়ে ৬৬ শতাংশ মৎস্যশ্রমিক জেলে কার্ডধারী। কুতুবজোম ইউনিয়নে তা ৩০ শতাংশ।
জরিপে উঠে এসেছে, জেলে কার্ডের তালিকা হালনাগাদ করার সময় অনেক মৎস্যশ্রমিক সাগরে মাছ ধরার কাজে নিয়োজিত থাকেন। ফলে তাঁদের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আবার জেলা ও উপজেলা মৎস্য কার্যালয়ের লোকবলসংকট থাকায় তাঁদের এ হালনাগাদ করার প্রক্রিয়ায় ইউনিয়ন পরিষদের সহায়তা নিতে হয়। এতে স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে অনেকের নাম জেলেদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পাশাপাশি ব্যক্তিগত শত্রুতা ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অনেক প্রকৃত মৎস্যশ্রমিক তালিকা থেকে বাদ পড়েন।
জরিপের তথ্যানুযায়ী, সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্যশ্রমিকদের একটা বড় অংশ (৪৫ শতাংশ) দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করার চেষ্টা করেন। পাশাপাশি জাল বোনা ও মেরামত (১৬ শতাংশ), কৃষিকাজ (১১ শতাংশ), লুকিয়ে মাছ ধরা (৫ শতাংশ), শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ (২ শতাংশ), রিকশা-অটোরিকশা চালানো (২ শতাংশ), ক্ষুদ্র ব্যবসা (২ শতাংশ) ইত্যাদি মাধ্যমে সংসারের ব্যয় মেটানোর চেষ্টা করেন।
অন্যদিকে জরিপে অংশ নেওয়া ১৫ শতাংশ মৎস্যশ্রমিক জানিয়েছেন, সমুদ্রে মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় তাঁরা কোনো কাজ করেন না বা করার মতো কোনো কাজ পান না।
২০২১ সালের ৪ থেকে ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন মা ইলিশ সংরক্ষণের জন্য মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। এ সময় জরিপে অংশ নেওয়া মৎস্যশ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৪০ শতাংশ সরকারি বরাদ্দের চাল পেয়েছিলেন। আর ২০২১ সালের ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্যশ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ৪৬ শতাংশ সরকারি চাল পেয়েছিলেন।
জরিপে দেখা যায়, মাছ ধরার বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্যশ্রমিকেরা একদিকে সরকারের বরাদ্দ করা চাল সঠিক পরিমাণে পান না, আবার খাদ্যসহায়তাও প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট নয়।
জরিপে অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ মৎস্যশ্রমিক জানান, তাঁরা বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সময় আর্থিক সংকটে দিন পার করেন। আর্থিক সংকট মোকাবিলায় অর্ধেকের বেশি—প্রায় ৫৩ শতাংশ মৎস্যশ্রমিক উচ্চ সুদে ঋণ নেন।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সরকারের জেলে তালিকা হালনাগাদ করার প্রক্রিয়া এখনো সম্পূর্ণ হয়নি। বিপুলসংখ্যক মৎস্যশ্রমিক জেলে কার্ড পাননি। ফলে এই মৎস্যশ্রমিকেরা সরকারের নানা সুরক্ষাসেবা থেকে বঞ্চিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।
সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকৃত ‘জেলে’ নির্ধারণের জন্য তার যথাযথ সংজ্ঞা নির্ধারণ, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তত্ত্বাবধানে দক্ষ জনবল দিয়ে গ্রহণযোগ্য-নির্ভুল জেলে তালিকা প্রণয়ন, দুই বছর অন্তর অন্তর জেলে তালিকা হালনাগাদ করা, প্রকৃত মৎস্যশ্রমিকদের পরিচয়পত্র দেওয়া, মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময় মৎস্যশ্রমিকের জন্য বরাদ্দ করা খাদ্যসহায়তার সঠিক প্রাপ্তি নিশ্চিত করা, খাদ্যসহায়তার পাশাপাশি আর্থিক সহায়তা দেওয়া, নিষেধাজ্ঞা চলার সময় মৎস্যশ্রমিকদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা, মৎস্যশ্রমিকদের জন্য সহজ শর্তে ও নামমাত্র সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি পরিচালক বনশ্রী মিত্র, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সমাজকল্যাণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসেন ও কক্সবাজার জেলা ফিসিং বোট শ্রমিক ইউনিয়নের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান।