নারী নির্যাতন রোধে প্রকল্প

৬ বছরে এবার সবচেয়ে কম বরাদ্দ

নারী নির্যাতন
প্রতীকী ছবি

স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হয়ে ৩০ বছরের এক নারী গত ২ জুন চিকিৎসা নিতে এসেছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে। তাঁর সারা শরীরে ছিল মারধরের দাগ। জরুরি বিভাগ থেকে তাঁকে হাসপাতালে স্থাপিত ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) পাঠানো হয়। নারীর পরিবার প্রথম আলোকে জানায়, স্বামী তুচ্ছ ঘটনাতেও নিয়মিত মারধর করেন ওই নারীকে। আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার ধাপ হিসেবে তারা ওসিসিতে এসেছে।

করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতনের উদ্বেগময় চিত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে। এ পরিস্থিতির মধ্যে প্রকল্পটির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ১১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত ৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

ওসিসিতে সহিংসতার শিকার নারী ও শিশুদের চিকিৎসা, পরামর্শসেবা, সুরক্ষা ও আইনি সেবা দেওয়া হয়। ঢাকা মেডিকেলে স্থাপিত ওসিসির আটটি শয্যায় (ভর্তি থাকে প্রায় দ্বিগুণ) ধর্ষণের শিকার নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি থাকে। তবে এ সেবা নতুন অর্থবছরে করোনাকালের ব্যয় সংকোচনের মধ্যে পড়তে পারে। কারণ, যে প্রকল্পের অধীন এ কার্যক্রম চলে, সে প্রকল্পে নতুন অর্থবছরে বরাদ্দ কমিয়ে ফেলা হয়েছে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় পরিচালিত ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম’–এর ১০টি কার্যক্রমের একটি হচ্ছে ওসিসি। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের ১৩টি ওসিসি থেকে ৪ হাজার ৭৬০ নারী ও শিশু সেবা পেয়েছে। সরকার এ প্রকল্পকে ‘ফ্ল্যাগশিপ’ বা অতি গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করে থাকে।

করোনাকালে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি নারী ও শিশু নির্যাতনের উদ্বেগময় চিত্র পাওয়া যায় বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তে। এ পরিস্থিতির মধ্যে প্রকল্পটির জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরে মাত্র ১১ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা গত ৬ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

বরাদ্দ কমলে কাজের পরিধি ও পরিমাণ কমবে, গুণগত মান নামবে। এতে নারী ও শিশু নির্যাতনের যে সমস্যাগুলো রয়ে গেছে, তা আরও ঘনীভূত হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক

অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুসারে, গত ৬ বছরের মধ্যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় প্রকল্পটির জন্য ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ হয় সাড়ে ১৭ কোটি টাকার বেশি। তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে সাড়ে ১৫ কোটি টাকা করা হয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে ২৭ কোটি ৪০ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২১ কোটি ৬৫ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২১ কোটি এবং ২০১৭-১৮ অর্থবছরে সাড়ে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ডানিডার সহায়তা থাকছে না

প্রকল্পটি ২০০০ সালের জুলাই মাস থেকে বাংলাদেশ ও ডেনমার্ক সরকারের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হয়ে আসছে। এবার প্রকল্পটির চতুর্থ পর্বের মেয়াদ ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত। প্রকল্পটি ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (আরএডিপি) অনুসারে, চতুর্থ পর্বের জন্য মোট ১৩১ কোটি ৯৩ লাখ ৫৯ হাজার টাকা ব্যয় অনুমোদন করা হয়েছে।

প্রকল্পের তথ্য অনুসারে, শুরুতে পাইলট প্রকল্পে ডেনমার্কের সরকারি সংস্থা ড্যানিশ ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সিস (ডানিডা) ৮৯ শতাংশ, প্রথম পর্বে ৯০ শতাংশ, দ্বিতীয় পর্বে ৮৭ শতাংশ, তৃতীয় পর্বে ৫১ শতাংশ এবং চতুর্থ পর্বে ৪০ শতাংশ অর্থ সহায়তা দিয়েছে। এ বছরের ৩০ জুনের পর থেকে ডানিডার সহায়তা থাকছে না। এখন থেকে প্রকল্পটি সরকার একক অর্থায়নে পরিচালনা করবে। প্রকল্পসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, সরকার সক্ষমতা অর্জন করলে প্রকল্পের একপর্যায়ে দাতা সংস্থার চলে যাওয়া নতুন কিছু নয়। এ ছাড়া কোভিডের কারণেও দাতা সংস্থাগুলো ব্যয় কমাচ্ছে।

ডানিডার সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়া ও বাজেটে বরাদ্দ কম পেলেও প্রকল্পে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না বলে মন্তব্য করেছেন প্রকল্পের পরিচালক এবং যুগ্ম সচিব (পরিকল্পনা ও পরিসংখ্যান) নার্গিস খানম। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, প্রকল্পের দেড় বছরের জন্য বরাদ্দ আরও বেশি চাওয়া হয়েছিল। কোভিডের কারণে সারা বিশ্ব অর্থনৈতিক চাপে রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ব্যয় সংকোচনের নির্দেশনার কথা জানিয়ে বরাদ্দ কম রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রকল্পের জরুরি কাজগুলোর ক্ষেত্রে ব্যয় কাটছাঁট করা হবে না। যেসব খাতে ব্যয় কমানো যায়, সে খাতগুলো নির্ণয় করে সাময়িকভাবে বাদ দেওয়া হবে।

প্রকল্পটির আওতায় যা আছে

প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে ১৩টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি, জেলা সদর হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৬৭টি ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেল, ন্যাশনাল ফরেনসিক ডিএনএ প্রোফাইলিং ল্যাবরেটরি, ৭টি বিভাগীয় ডিএনএ স্ক্রিনিং ল্যাবরেটরি, ন্যাশনাল ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, ৮টি আঞ্চলিক ট্রমা কাউন্সেলিং সেন্টার, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টার ১০৯, মোবাইল অ্যাপ ‘জয়’ (কোনো নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হতে যাচ্ছে মনে করলে এ অ্যাপে ক্লিক করলে ১০৯–এ এবং অ্যাপসে দেওয়া তিনটি পরিবার ও বন্ধুদের নম্বরে জিপিএস লোকেশনসহ মেসেজ চলে যাবে), রোহিঙ্গা নারী ও শিশুদের জন্য বিশেষ কার্যক্রম এবং নির্যাতন প্রতিরোধে জনসচেতনতা কার্যক্রম।

বরাদ্দ কমলে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে

‘বাজেট ফ্রেমওয়ার্ক অ্যানালাইসিস অন চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শিরোনামে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহায়তায় সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) গত জুন মাসে একটি বিশ্লেষণধর্মী প্রতিবেদন প্রকাশ করে।

ওই প্রতিবেদনে সিপিডির কর্মসূচি সহায়ক নাদিয়া নওরিন জানান, নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধে সরকারের বড় বড় কর্মসূচি ও প্রকল্প রয়েছে। তবে সেগুলো সময় ও প্রয়োজনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমন্বিত না হওয়ায় এবং বরাদ্দ যথেষ্ট না হওয়ায় সহিংসতা কমার ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন আসছে না। এ পরিস্থিতির মধ্যে নারী নির্যাতন রোধে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পে বরাদ্দ কমেছে।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে ৩ হাজার ৫১৫, ২০২০ সালে ৪ হাজার ১০০ এবং ২০১৯ সালে ৩ হাজার ৭৯০ নারী ও শিশু ধর্ষণ, পারিবারিক সহিংসতা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক তানিয়া হক প্রথম আলোকে বলেন, বরাদ্দ কমলে কাজের পরিধি ও পরিমাণ কমবে, গুণগত মান নামবে। এতে নারী ও শিশু নির্যাতনের যে সমস্যাগুলো রয়ে গেছে, তা আরও ঘনীভূত হবে।

বাজেট কাটছাঁট হলে সহিংসতার বিরুদ্ধে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রমের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ যাওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকছে। নারী ও শিশু নির্যাতন রোধের প্রকল্পে বাজেট না কমিয়ে বরং বাড়ানো উচিত এবং বরাদ্দগুলো কার্যকরভাবে হচ্ছে কি না, তা পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার।