৩৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল নিয়ে চিন্তায় কৃষক

বান্দরবান ও কক্সবাজার এখনো বন্যার উচ্চ ঝুঁকিতে। রাঙামাটি বেশি ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিতে।

সবজিখেতে জমেছে বৃষ্টির পানি। এতে সবজি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় কৃষকেরা। বৃহস্পতিবার বগুড়ার শিঙ্গা সেতু এলাকায়

চট্টগ্রাম অঞ্চলে বৃষ্টি থামলেও এখনো পানি নামেনি। জেলার সাতকানিয়া উপজেলার ফসলের জমির বড় অংশ আট দিন ধরে ডুবে আছে। সেখানে আমন ধান, গ্রীষ্মকালীন সবজি থেকে শুরু করে মিশ্র ফলবাগান ছিল। পানির নিচে পাকা ধানের বড় অংশ নষ্ট হয়ে গেছে বলে আশঙ্কা করছেন স্থানীয় কৃষকেরা। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বাড়িঘরও।

সাতকানিয়ার কালিয়াশ ইউনিয়নের বাসিন্দা নুরুন নবী চার বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছিলেন। মাসখানেকের মধ্যে ওই ধান কাটার পরিকল্পনা ছিল তাঁর। বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলে এখন ওই ধানের বেশির ভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। নুরুন নবী বলেন, ‘আমন ধানের ওপর নির্ভর করে সারা বছরের খরচ জোগাড় করি। সারা বছর কীভাবে চলব, এখন সেই চিন্তায় আছি। আবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি মেরামত নিয়ে আছি দুশ্চিন্তায়।’

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে, উজানে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি বাড়ছে। বিশেষ করে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে।

সরকার ও সরকারের সঙ্গে কাজ করা মানবিক সহায়তাকারী আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলো যৌথভাবে ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রাথমিক হিসাব করেছে। ‘চট্টগ্রাম হিলট্র্যাকস ফ্ল্যাস ফ্ল্যাড: নিড অ্যাসেসমেন্ট রিপোর্ট’ (পার্বত্য চট্টগ্রামে আকস্মিক বন্যা: দরকার মূল্যায়ন) শীর্ষক প্রতিবেদনটি ১০ আগস্ট প্রকাশ করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, ভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢল ও হঠাৎ বন্যায় প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর বড় অংশ আউশ ও আমন ধান। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের কৃষকেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ওই দুই জেলায় প্রায় ৩০ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ধানের বাইরে গ্রীষ্মকালীন সবজি, আদা ও রসুন রয়েছে। বন্যায় মাটির তৈরি কাঁচা ও টিনের বাড়ির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।

■ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৩০ হাজার হেক্টর জমির ফসলের ক্ষতি।

■ ধান, গ্রীষ্মকালীন সবজি, আদা, রসুনের ক্ষতি।

■ যোগাযোগব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুর্গম এলাকায় ব্যাহত হচ্ছে ত্রাণ তৎপরতা। 

■ উত্তরাঞ্চলে বেড়ে চলছে নদ-নদীর পানি।

জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সরকারি প্রক্রিয়ায় ক্ষয়ক্ষতির একটি বিস্তারিত হিসাব করছি। কয়েক দিনের মধ্যে তা চূড়ান্ত হবে। তবে এরই মধ্যে আক্রান্ত এলাকায় আমরা নগদ সহায়তা ও খাদ্য পৌঁছে দিয়েছি।’ উত্তরাঞ্চলে ভারী বৃষ্টি শুরু হলেও তাতে আগের পাহাড়ি ঢলের মতো ক্ষতি হবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখন বন্যা হওয়ার মতো নদ-নদীতে পানি নেই।

প্রতিবেদনে মূলত চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, ফেনী ও লক্ষ্মীপুরের একটি তাৎক্ষণিক জরিপ চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতির ওই হিসাব তৈরি করা হয়েছে। হঠাৎ বন্যার কারণে চারটি জেলা এখনো ঝুঁকিতে আছে। এর মধ্যে কক্সবাজার ও বান্দরবান মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে আছে। রাঙামাটি উচ্চ ঝুঁকিতে ও চট্টগ্রাম মাঝারি ঝুঁকিতে আছে। 

প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, বন্যার পানি নামার সময় ওই সব জেলায় ফসলের ক্ষতি, বাড়িঘর ধ্বংস এবং রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে ওই সব এলাকার মানুষজনকে সাবধানে থাকতে বলা হয়েছে। মূলত ওই ক্ষয়ক্ষতির হিসাবের ভিত্তিতে সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করবে। 

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত আটটি জেলায় এ পর্যন্ত ১ কোটি ২০ লাখ টাকা নগদ সহায়তা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ১ হাজার ৭০০ টন চাল ও ৩১ হাজার শুকনা খাবারের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িঘর মেরামতে এখনো সহায়তা দেওয়া শুরু হয়নি।

আমরা সরকারি প্রক্রিয়ায় ক্ষয়ক্ষতির একটি বিস্তারিত হিসাব করছি। কয়েক দিনের মধ্যে তা চূড়ান্ত হবে। তবে এরই মধ্যে আক্রান্ত এলাকায় আমরা নগদ সহায়তা ও খাদ্য পৌঁছে দিয়েছি
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান

ফসলের ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপারে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের অতিরিক্ত পরিচালক আশরাফ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, হঠাৎ বন্যায় কী পরিমাণ ফসল ডুবে গেছে, তার একটি হিসাব তাঁরা তৈরি করছেন। দু-এক দিনের মধ্যে তা চূড়ান্ত হবে। ক্ষয়ক্ষতির ধরন বুঝে সহায়তার ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হবে। 

ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এখনো ৪৫ হাজার ৫০০ মানুষ ঘরবাড়িতে ফিরতে পারেনি। তারা আশপাশের উঁচু ও নিরাপদ স্থানে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছে। বাড়িঘর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং সড়কসহ যোগাযোগব্যবস্থা ঠিক না হওয়ায় অনেকে বাড়ি ফিরতে পারছে না। বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের দুর্গম এলাকায় সড়কপথ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো সেখানে যেতে পারছে না। 

এদিকে বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাবে, উজানে বৃষ্টি বেড়ে যাওয়ায় দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ নদ-নদীর পানি বাড়ছে। বিশেষ করে তিস্তা ও ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে এখনো বেশির ভাগ জায়গায় বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। আগামীকাল সোমবারের মধ্যে তিস্তা, ধরলা ও দুধকুমার নদ-নদীর পানি কোথাও কোথাও বিপৎসীমা অতিক্রম করতে পারে। সেই ক্ষেত্রে কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হতে পারে।