বাংলাদেশে গত বছর প্রায় ১৮ লাখ মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাড়িছাড়া হয়েছে। মূলত দেশের উপকূলে আঘাত হানা ঘূর্ণিঝড় মোখা ও চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে ভারী বৃষ্টির কারণে পাহাড় ধসে এই বিপুলসংখ্যক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের নাম বিশ্বে পঞ্চম স্থানে উঠে এসেছে।
নরওয়েভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ডিসপ্লেসমেন্ট মনিটরিং সেন্টার (আইডিএমসি) থেকে প্রকাশ করা বৈশ্বিক অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত প্রতিবেদন-২০২৪-এ এসব তথ্য উঠে এসেছে। দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে চীন। আর সংঘাত ও দ্বন্দ্বের কারণে বাস্তুচ্যুতির শিকার হওয়া দেশের শীর্ষ তালিকায় রয়েছে সুদান, কঙ্গো প্রজাতন্ত্র ও ফিলিস্তিনের নাম।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বে ৬ কোটি ৮৩ লাখ মানুষ যুদ্ধ ও দ্বন্দ্বের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এর মধ্যে এককভাবে সুদানে ৯১ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। আর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে মোট বাস্তুচ্যুত হয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। দুর্যোগে চীনে গত বছর ৪৭ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা সর্বোচ্চ। ওই তালিকায় চীনের পরে রয়েছে তুরস্কের নাম। দেশটিতে ভূমিকম্পের কারণে ৪০ লাখ ৫৩ হাজার মানুষ, ফিলিপাইনে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে প্রায় ২৬ লাখ এবং সোমালিয়ায় ২০ লাখ ৪৩ হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। এর পরের অবস্থানেই রয়েছে বাংলাদেশ। এসব মানুষের বড় অংশ অস্থায়ীভাবে বাস্তুচ্যুত হয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে।
ওই প্রতিবেদন সম্পর্কে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে, ঘূর্ণিঝড় মোখা ও ভারী বৃষ্টির কারণে বাস্তুচ্যুত বেশির ভাগ মানুষ বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিল। দুর্যোগ থেমে যাওয়ার কয়েক দিন পর আবার তারা বাড়িঘরে ফিরে গেছে। খুব কমসংখ্যক মানুষের স্থায়ীভাবে ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। তাদের সরকার সহযোগিতা দিয়ে বাড়িঘর নির্মাণ করে দিয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত বছর এশিয়ায় সবচেয়ে যে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হানে তা ছিল ‘মোখা’। ওই ঝড়ে শুধু বাংলাদেশে ১৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। ২০২৩ সালের ১৪ মে বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানার আগে তা মিয়ানমারে আঘাত হানে। এতে ওই দেশের ৯ লাখ ১২ হাজার মানুষ তাতে বাস্তুচ্যুত হয়। একক দুর্যোগ হিসেবে ঘূর্ণিঝড় মোখা ও তুরস্কের ভূমিকম্পে সবচেয়ে বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় মোখা আঘাত হানার আগে বাংলাদেশের কক্সবাজারের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে যথেষ্ট পরিমাণে প্রস্তুতি নেওয়া হয়। ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হওয়ার পর দ্রুত আগাম পূর্বাভাস দেওয়া হয়। ফলে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে আশঙ্কা অনুযায়ী ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। একই সঙ্গে তা রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুতদের নতুন করে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ব্যাপক বৃষ্টি ও ঝোড়ো হাওয়া বয়ে যায়। শহরে পাহাড় ধস ও জলাবদ্ধতার কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টি হওয়ার কারণে পুরো শহরের জনজীবন, ব্যবসা, বাণিজ্য ও অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। শহরের দরিদ্র অধিবাসীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকার এবং উন্নয়ন সহযোগীরা যৌথভাবে কাজ করছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় ওই যৌথ উদ্যোগ বেশ সফলতা পেয়েছে। ক্ষয়ক্ষতি আগের চেয়ে বেশ কমে এসেছে। অর্থাৎ এর আগের বছরগুলোতে একই ধরনের ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগে যে ক্ষয়ক্ষতি হতো, তা ২০২৩ সালে কমে এসেছে। মূলত ঘূর্ণিঝড়ের আগাম সতর্কবার্তা প্রচার করা, প্রস্তুতি নেওয়া এবং অবকাঠামো নির্মাণের কারণে ক্ষতি কমে এসেছে।
প্রতিবেদনটি সম্পর্কে আইডিএমসি-এর পরিচালক আলেক্সজান্ডার বিলেক বলেন, বিশ্বজুড়ে যে ধরনের দ্বন্দ্ব ও সংঘাত দেখা দিয়েছে, তাতে বেশ কয়েকটি দেশে আগামী বছরগুলোতে আরও অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হতে পারে। দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার কারণেও এ ধরনের বাস্তুচ্যুত মানুষ বেড়েছে।