পাঠ্যবইয়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক পাঠ অংশের উপস্থাপনায় কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকলে এবং বিশেষজ্ঞরা মনে করলে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে বলে জানিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। তবে তিনি এটাও স্মরণ করিয়েছেন, দেশে একটি গোষ্ঠীর মাধ্যমে নানা বিষয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে বা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে নানা সময়ে অরাজকতা করার বা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রবণতা আছে।
আজ মঙ্গলবার সচিবালয়ে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারপর মন্ত্রী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওই সব কথা বলেন।
নতুন শিক্ষাক্রমের আলোকে গত বছর থেকে চালু করা সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান বইয়ের একটি অধ্যায়ে হিজড়া জনগোষ্ঠী সম্পর্কে জনসচেতনতামূলক একটি পাঠ রয়েছে। গত বছরও এ নিয়ে বিতর্ক উঠেছিল। এবারও এটা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। নতুন করে বিষয়টি সামনে এসেছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন খণ্ডকালীন শিক্ষক একটি অনুষ্ঠানে এ নিয়ে বইয়ের পাতা ছিঁড়ে ফেলার ঘটনার পর। বিষয়টি নিয়ে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেশে একটি গোষ্ঠী নানা বিষয়ে ধর্মকে ব্যবহার করে হোক বা ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করে হোক, নানা সময়ে অরাজকতা করার বা পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার প্রবণতা তাদের মধ্যে আছে। গত বছরও ছিল। একটি সংগঠন কিছু সুপারিশ করেছিল। তারা দাবি করেছে, এখানে (বইয়ে) ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, যেটি বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে। সেই বিষয়টি তারা নজরে এনেছিল। তবে বিষয়টি নিয়ে যখন আমরা আলোচনা করেছি, তখন দেখেছি, শব্দটি ট্রান্সজেন্ডার নয়, থার্ড জেন্ডার। সেটি আইনত স্বীকৃত, যারা বায়োলজিক্যাল কারণে তৃতীয় লিঙ্গ বা সামগ্রিকভাবে সমাজে হিজড়া নামে পরিচিত। তারা এ দেশের নাগরিক। অবশ্যই তাদের নাগরিক সুবিধা আছে।’
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তবে গল্পটি উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যদি এমনভাবে উপস্থাপনা করা হয়ে থাকে, যেখানে এই ধরনের বিভ্রান্তি বা বিতর্ক সৃষ্টির প্রয়াস থাকে, তাহলে গল্পের উপস্থাপনার পদ্ধতি পরিবর্তন করা যায় কি না, এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। মূল লক্ষ্য একটি জনগোষ্ঠীর প্রতি সহমর্মিতা, তাদের নাগরিক অধিকার আছে, তার প্রতি সবার সম্মান প্রদর্শন সেই বিষয়টিকে সঠিকভাবে ধরে রেখে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে যদি ভিন্নভাবে উপস্থাপনের সুযোগ থাকে, তা বিশেষজ্ঞরা আলোচনা করে মতামত দেবেন। এটি বিশেষায়িত বিষয়। এ বিষয়ে নীতিনির্ধারণী জায়গায় থেকে তিনি (মন্ত্রী) মন্তব্য করতে চান না।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, মূল বিষয় তৃতীয় লিঙ্গ, যেটি রাষ্ট্রীয়ভাবেও স্বীকৃত এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গীকারেরও অংশ। তবে উপস্থাপনায় যদি কোনো বিতর্ক বা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে কিছুটা পরিবর্তন আনা যেতে পারে, যদি বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজন মনে করেন।
নতুন শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন আনা হবে কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘শিক্ষাক্রম পরিবর্তন আমার একার বিষয় না। শিক্ষাক্রমের সঙ্গে জড়িত আছেন অনেক বিশেষজ্ঞ, শিখনবিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিজ্ঞানী, কনটেন্ট যাঁরা তৈরি করেছেন, তাঁরা। সে ক্ষেত্রে আমি চাইলেই বা অন্য কেউ চাইলেই পরিবর্তন করা এত সহজ নয়। শিক্ষাক্রম একটি রূপরেখা। এটির প্রতিফলন হয় পাঠ্যবইয়ের মাধ্যমে। পাঠ্যবইয়ে যদি সমস্যা থেকে থাকে, আর মূল্যায়ন পর্যায়ে যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে, তাহলে সেগুলো অবশ্যই পরিবর্তনযোগ্য। প্রতিবছরই কিন্তু পাঠ্যবইয়ে কিছু পরিবর্তন আসে। শিক্ষাক্রমের পরিবর্তন আর পাঠ্যবইয়ের পরিবর্তনের মধ্যে কিন্তু পার্থক্য আছে। পাঠ্যবইয়ের উপস্থাপনায় যদি বিভ্রান্তি, সংবেদনশীল বিষয় থেকে থাকে, অবশ্যই তাতে পরিবর্তন আসতে পারে। কিন্তু শিক্ষাক্রমে পরিবর্তন রাতারাতি আনা যায় না।’
মহিবুল হাসান চৌধুরী বলেন, আরেকটি বিষয় হলো মূল্যায়ন। শিক্ষাবর্ষ মাত্র শুরু হয়েছে। বর্তমান পদ্ধতির মূল্যায়ন যেটি পাঠ্যবইয়ে দেওয়া আছে, সেটির মধ্যে যদি কোনো দুর্বলতা ও চ্যালেঞ্জ থেকে থাকে, তাহলে সেটি সামনের দিনে দেখা যাবে। এখনো শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাসই অতিক্রম হয়নি। বিশেষজ্ঞ ও শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা–পরামর্শ করে যেটা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটিতে দেখতে হবে দুর্বলতাগুলো কী। শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাসেই যদি এ নিয়ে অতিমাত্রায় সমালোচনা হয়, তাহলে বুঝতে হবে এখানে অন্য উদ্দেশ্য থাকতে পারে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বলছি না যে কোনো কিছুই পরিবর্তন হবে না, অবশ্যই পরিবর্তন আসতে পারে। পাঠ্যবইয়ে পরিবর্তন আসছে, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে আসতে পারে। পরিবর্তনটি একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে প্রক্রিয়াটি যখন চালু হবে, তখন বোঝা যাবে। ইতিমধ্যে যা পরীক্ষামূলকভাবে করা হয়েছে, সেখানে কিন্তু সেই ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জ দেখা যায়নি বলেই এই কাজটি হয়েছে। সেটি কিন্তু রাতারাতি আসেনি। ২০১৭ সাল থেকে দেশি ও বিদেশি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করেই প্রক্রিয়াটি নির্ধারণ করা হয়েছে।’