সরকারি সেবা সম্পর্কে শহরের মানুষ কম জানেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামের মানুষের যোগাযোগ বেশি, শহরের মানুষ আত্মকেন্দ্রিক।
রাজধানীর খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া এলাকার বাসিন্দা পাখি আক্তার (৩৮)। এক আত্মীয়ের সহায়তায় ভিন্ন এলাকা থেকে তিনি মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির আওতায় অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার পর থেকে মোট তিন বছর ভাতা পেয়েছেন। তাঁর গ্রামেও এই ভাতা চালু আছে। তিনি নন্দীপাড়ায় অনেক দরিদ্র অন্তঃসত্ত্বা নারীকে এই ভাতার বিষয়টি জানাতে গিয়ে দেখেন, বেশির ভাগই এই ভাতা সম্পর্কে জানেন না। তিনি নিজেও জানেন না, নন্দীপাড়ার অন্তঃসত্ত্বা নারী এই ভাতা পেতে চাইলে কোথায় কার কাছে যাবেন বা জানতে চাইবেন।
গত ২৮ নভেম্বর নন্দীপাড়ায় কথা হয় পাখি আক্তারের সঙ্গে। কথা হয় একই এলাকার ক্যানসারে আক্রান্ত এক নারীর সঙ্গেও। তিনি বললেন, সমাজসেবা অধিদপ্তর ক্যানসারে আক্রান্ত রোগীদের যে এককালীন সহায়তা দেয়, সেটি তাঁর জানা ছিল না। জানার পর কয়েক মাস আগে তিনি স্থানীয় সমাজসেবা কার্যালয়ে আবেদন করেন। তবে এখনো সাড়া পাননি।
জেন্ডার সংবেদনশীল জনসেবার বিষয়ে উন্নয়ন সংস্থা একশনএইড বাংলাদেশ শহর ও গ্রাম এলাকায় দুটি সামাজিক নিরীক্ষা করেছে। এ জন্য তারা বেছে নিয়েছে রাজধানীর খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া এবং গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার কাটাবাড়ী ইউনিয়ন। এতে উঠে এসেছে—কোথায় কী ধরনের সরকারি সেবা পাওয়া যায়, সে সম্পর্কে এলাকার অনেকেই জানেন না। আবার গ্রামের চেয়ে শহরের দরিদ্র মানুষ এই সেবা সম্পর্কে কম জানেন।
গত ২৬ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত রাজধানীর নন্দীপাড়ায় জরিপে অংশ নেন ৩২১ জন। এর মধ্যে ২৪৬ জন নারী। কাটাবাড়ী ইউনিয়নে গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ অক্টোবর পর্যন্ত জরিপে ২৮টি গ্রামের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার ২০০ জন অংশ নেন। এর মধ্যে ১২৩ জন নারী।
জরিপে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে শহরে ১৮ শতাংশ ও গ্রামে ১১ শতাংশ মানুষ সরকারি সেবার বিষয়ে কিছু জানেন না। কোথায় কোন ধরনের সেবা পাওয়া যাবে, সে সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানাতে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও জনপ্রতিনিধিদের উদ্যোগও কম।
এ ব্যাপারে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) চেয়ারম্যান অধ্যাপক বজলুল হক খন্দকার প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে দেশে গ্রামভিত্তিক সেবা–কাঠামো গড়ে তোলা হয়। এখন গ্রামের অনেক দরিদ্র মানুষ শহরমুখী। কিন্তু সেবা–কাঠামো সেভাবে শহরকেন্দ্রিক হয়নি। সামাজিক সুরক্ষা ও সরকারি সেবা কম থাকায় শহরের মানুষ এ সম্পর্কে জানেন কম।
এ ছাড়া গ্রামে একের সঙ্গে অন্যের যোগাযোগ অনেক বেশি। একজন একটি সেবার কথা জানলে তা মুখে মুখে ছড়ায়। শহরের মানুষ আত্মকেন্দ্রিক, মেলামেশা কম। তাঁদের মধ্যে তথ্য বিনিময় হয় খুব কম।
শহরে সরকারি সেবা সম্পর্কে মানুষকে বেশি করে জানাতে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলে মনে করেন সানেম চেয়ারম্যান।
নিরীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেকে সরকারি সেবা পাওয়ার চেষ্টা করেও পাননি। আবার যাঁরা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও অসন্তোষ রয়েছে। অতিরিক্ত ভিড়, দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ইত্যাদি কারণে অনেক নারী সেবা নিতে গিয়ে নিরাপদ বোধ করেন না। সেবাগুলোর মধ্যে শহরে ও গ্রামে বৈষম্য রয়েছে। অন্তঃসত্ত্বা নারীদের গর্ভাবস্থায় ও প্রসবের আগে-পরে সেবা, জন্মনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা, নবজাতক, শিশু–কিশোরীদের টিকার মতো সেবা গ্রামের মানুষ বিনা মূল্যে পেলেও শহরের মানুষ পাচ্ছেন না।
নন্দীপাড়ার নিরীক্ষায় বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে সেবাগুলোর মধ্য রয়েছে এলাকায় শিশুসুরক্ষা, পরিচ্ছন্নতা, নিরাপদ পানি সরবরাহ, সবজিবাগান, স্যানিটেশন, সামাজিক ভাতা (বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, হিজড়া, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী), পরিবার পরিকল্পনা, টিকা, মানসিক স্বাস্থ্য, কিশোর-কিশোরী স্বাস্থ্যসেবা। তবে জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৭৮ শতাংশ যেকোনো একটি সরকারি সেবা সম্পর্কে জানেন।
সেবা সম্পর্কে জানেন, এমন ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৯ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা ও ৪০ শতাংশ বিভিন্ন ভাতার বিষয়ে জানেন। রেশন, সরকারি বৃত্তি ও যুব প্রশিক্ষণের বিষয়ে জানেন সবচেয়ে কম মানুষ, এ হার মাত্র ৩ শতাংশ। তুলনামূলক গ্রামের চিত্র ভালো। গ্রামে সরকারি সেবার সংখ্যাও বেশি। জরিপে অংশ নেওয়া কাটাবাড়ীর ৮২ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা, ৬৩ শতাংশ সামাজিক ভাতা সম্পর্কে জানেন।
নন্দীপাড়ার তরুণী খাদিজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের নারীদের জন্য আয়বর্ধক (আইজিএ) প্রশিক্ষণ প্রকল্প থেকে হ্যান্ড প্রিন্টিংয়ের কাজ শিখেছেন। এখন ব্যবসা করতে চান। কিন্তু সরকারি ঋণ পেতে কী করতে হবে, তা জানেন না।
আবার যাঁরা সেবা সম্পর্কে জানেন, তাঁদের বেশির ভাগই প্রতিবেশীর কাছ থেকে জেনেছেন। তবে শহরের তুলনায় গ্রামে জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার হার বেশি। শহরে ১৭ শতাংশ এবং গ্রামে ৫১ শতাংশ মানুষ জনপ্রতিনিধিদের কাছ থেকে তথ্য পেয়েছেন।
নন্দীপাড়ায় একশনএইড বাংলাদেশের পক্ষে জরিপ চালায় বেসরকারি সংস্থা স্পৃহা বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন। শহরের মানুষ সেবা সম্পর্কে কম জানা প্রসঙ্গে এই সংস্থার প্রকল্প সমন্বয়কারী স্বপন দেবনাথের ভাষ্য, নন্দীপাড়া দুই বছর ধরে সিটি করপোরেশনের আওতায়। এর আগে ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে ছিল। এখন এলাকায় তাঁদের জন্য কী কী সেবা আছে, সে সম্পর্কে তাঁরা পুরোপুরি জানেন না। সরকারি সেবা প্রতিষ্ঠানও এ নিয়ে কোনো প্রচার চালায় না। তথ্য না জানায় অনেকে সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
খিলগাঁওয়ের নন্দীপাড়া এলাকার কণিকা রানী মণ্ডল কাউন্সিলর কার্যালয়ের মাধ্যমে তাঁর সন্তানের জন্মনিবন্ধন করেন। এ জন্য তাঁকে গুনতে হয়েছে ৮০০ টাকা। অথচ ৫ বছরের নিচে ও ৫ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্মনিবন্ধনে সরকারি ফি যথাক্রমে ২৫ ও ৫০ টাকা। জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করলে কোনো ফি লাগে না।
একই এলাকার রুবিনা আক্তার মনে করেন, পরিবার পরিকল্পনার সেবা আগে বাড়ি বাড়ি এসে দেওয়া হতো। এখন তা বন্ধ। তাঁর সঙ্গে যোগ করে চন্দনা রানী সরকার বললেন, এখন তো খাওয়ার বড়ি, কনডম কিনতে হয়। তিন মাস পরপর সুই (স্বল্পমেয়াদি ইনজেকটেবল জন্মনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা) দিতেও টাকা লাগে। এগুলো আগে বিনা মূল্যে পাওয়া গেছে।
নন্দীপাড়ায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে কিশোরীদের বিনা মূল্যের ধনুষ্টঙ্কার (টিটি) টিকার কার্ড করতে ১০০ টাকা করে দিতে হয়। চার ডোজের প্রতি ডোজ টিকার জন্য ৫০ টাকা নেওয়া হয়। শিশুদের টিকা নিতেও ৫০ টাকা করে দিতে হয়। শহরে সিটি করপোরেশনের সঙ্গে অংশীদারির ভিত্তিতে টিকা দানের কাজ করে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। সংস্থাগুলো জন্মনিয়ন্ত্রণসেবাও দিয়ে থাকে। এসব সেবা বিনা মূল্যের হলেও টাকা নেয় বেসরকারি সংস্থাগুলো।
নন্দীপাড়ায় (বর্তমান ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৪ নম্বর ওয়ার্ড) কাজ করা বেসরকারি সংস্থা সীমান্তিকের খিলগাঁও অঞ্চলের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমুন নাহার টাকা নেওয়ার অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেন, বিনা মূল্যের সেবায় কোনো টাকা নেওয়া হয় না। টিকা দিতে এলে অতিরিক্ত কিছু সেবা দেওয়া হয়, যার জন্য ‘সার্ভিস চার্জ’নেওয়া হয়।
এ ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির প্রথম আলোকে বলেন, কিশোরী ও শিশুদের ইপিআইভুক্ত টিকার জন্য টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। কোনো সংস্থা টাকা নিলে অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিরীক্ষা প্রতিবেদন ধরে সরকারি সেবা নিয়ে গ্রামের অবস্থা জানতে কাটাবাড়ী ইউনিয়নে যোগাযোগ করে দেখা যায়, সেখানে গর্ভকালীন সেবা, শিশু–কিশোরীদের টিকা এবং জন্মনিয়ন্ত্রণের প্রতিটি সেবা বিনা মূল্যের। তবে সামাজিক ভাতা, জন্মনিবন্ধন ইত্যাদির জন্য বাড়তি টাকা গুনতে হয়।
জন্মনিয়ন্ত্রণসামগ্রী সম্পর্কে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ফিল্ড সার্ভিসেস ডেলিভারি ইউনিটের (মাঠপর্যায়ে সেবা ও সরবরাহ ইউনিট) লাইন পরিচালক মো. নিয়াজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামে অধিদপ্তর বিনা মূল্যে এই সেবা দেয়। নগরে এই সেবা নিয়ে বৈষম্য আছে। এর সমাধান হওয়া দরকার।
কাটাবাড়ী ইউনিয়নের হেলালিপাড়া গ্রামের কৃষক শ্যামা রানী পাহাড়ি (৩০) মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর স্বামী রিপন পাহাড়ি ভ্যান চালান। তাঁদের দুটি মেয়ে। একটির বয়স ৭ বছর, অন্যটির দেড় মাস। দ্বিতীয় সন্তান গর্ভে থাকাকালে স্থানীয় সরকারি সেবা কেন্দ্রে বিনা মূল্যে স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেছেন। দুই মেয়ের টিকাও বিনা মূল্যে পেয়েছেন। তবে ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় থেকে বড় মেয়ের জন্মনিবন্ধন করতে ৩০০ টাকা খরচ হয়েছে।
মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হতে কখনো আবেদন করেননি। শ্যামার ভাষ্য, ‘গরিব মানুষ। আবেদন করতে টাকা লাগে। তাই করিনি।’ তাঁর শাশুড়ি গৌরী রানী পাহাড়ি বয়স্ক ও বিধবা। তিনিও কোনো ভাতা পান না।
জরিপে অংশ নেওয়া কাটাবাড়ী ইউনিয়নের প্রায় ২৪ শতাংশ বলেন, তাঁরা কখনো সরকারি সেবা পাননি। তাঁরা মনে করেন, সেবাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের পরিচিত লোক বা আত্মীয়স্বজন না থাকায় তাঁরা সেবা পাননি। সেবা পেতে গেলে টাকা দিতে হয়।
নন্দীপাড়ার পাখি আক্তার মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির বিষয়ে এলাকার মানুষের কম জানার কথা বলেছিলেন। তাঁর কথার সূত্র ধরে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, গ্রামীণ এলাকায় ‘মাতৃত্বকালীন ভাতা’ (২০০৭) এবং শহরে ‘কর্মজীবী মায়েদের জন্য ল্যাকটেটিং ভাতা’ (২০১০) কর্মসূচিকে সমন্বিত করে ২০১৯ সালে ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি’ চালু হয়। গ্রামে এই কর্মসূচি ব্যাপক হারে চালু থাকলেও শহরে কম। দক্ষিণগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের অধীনে থাকার সময় নন্দীপাড়ার দরিদ্র মায়েরা ‘মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচির’ আওতায় ছিলেন। এলাকাটি সিটি করপোরেশনে আসার পর এই সেবা তাঁরা পান না।
এ ব্যাপারে মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মসূচি পরিচালক (মা ও শিশু সহায়তা কর্মসূচি) রুবিনা গনি প্রথম আলোকে বলেন, শহরে এই কর্মসূচি কম ছিল। চলতি ডিসেম্বরে কর্মসূচিটি নতুন করে সিটি করপোরেশনসহ সারা দেশে চালু হবে। অনলাইনে মায়েরা আবেদন করতে পারবেন। এখন থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি এবং উত্তর সিটির ৫৪টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে মাসে পাঁচজন করে অন্তঃসত্ত্বা মা বরাদ্দ পাবেন। সারা দেশে ১২ লাখ ৫৪ হাজার মা এই কর্মসূচির আওতায় আসবেন।
একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, বিনা মূল্যের সরকারি সেবা টাকা দিয়ে কেন কিনতে হচ্ছে, এখানে কোথায় ফাঁক আছে, তা সরকারি কর্মকর্তাদের দেখা উচিত। কী কী সরকারি সেবা আছে, কোনগুলো বিনা মূল্যের—সে সম্পর্কিত তথ্য সরকারি সব কার্যালয়ে টাঙিয়ে রাখতে হবে। প্রচার আরও বাড়াতে হবে। এ জন্য সরকারি সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থা ও গণমাধ্যমকে কাজ করতে হবে। তথ্য না জানলে যাঁদের সেবা প্রয়োজন, তাঁরা সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন।