মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কর্নার। বাঁ থেকে শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত পাঞ্জাবি। পাশে দেয়ালজুড়ে বিশালাকার আলোকচিত্রে রায়েরবাজার ইটখোলার বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদের পাঞ্জাবি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছবি। তরুণ প্রজন্মের দর্শক দুই বোন দেখছেন নিদর্শনগুলো। গত বুধবার
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কর্নার। বাঁ থেকে শহীদ ডা. আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত পাঞ্জাবি। পাশে দেয়ালজুড়ে বিশালাকার আলোকচিত্রে রায়েরবাজার ইটখোলার বধ্যভূমিতে পড়ে থাকা বুদ্ধিজীবীদের ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদের পাঞ্জাবি, সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনের ছবি। তরুণ প্রজন্মের দর্শক দুই বোন দেখছেন নিদর্শনগুলো। গত বুধবার

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর: শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতিময় নিদর্শন

রাজধানীতে জেঁকে বসেছে শীত। কুয়াশায় ঘোর হয়ে আছে আকাশ। এমনই শীতের দিনে, ৫৩ বছর আগে, ১৯৭১ সালের এই দিনে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল খ্যাতনামা নাট্যকার ও অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীকে। তাঁর মতো দেশের সেরা আরও বুদ্ধিজীবীদের ঘর থেকে তুলে নিয়ে হানাদার পাকিস্তানি সেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের স্মৃতি জাগিয়ে রাখতে তাঁদের বেশ কিছু নিদর্শন সাজিয়ে রাখা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে।

স্বাধীনতার পরে রাজধানীর রায়েরবাজার ইটখোলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গণকবরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ পাওয়া যায়। এতেই প্রকাশিত হয় পরিকল্পিতভাবে বুদ্ধিজীবী হত্যার ষড়যন্ত্র। স্বাধীনতার পর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৪ ডিসেম্বর দিনটি শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।

শহীদ এই বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন অত্যন্ত মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ, দেশের সম্পদ। তাঁদের হত্যার পেছনে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশটাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে দরিদ্র করা, যাতে দেশ স্বাধীন হলেও উঠে দাঁড়াতে না পারে।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক

জাদুঘরে সাজিয়ে রাখা নিদর্শনের জায়গাটিতে রাখা আছে মুনীর চৌধুরীর একটি প্রতিকৃতি। একাত্তরে শহীদ অনেক বুদ্ধিজীবীর সন্তানই তখন ছিলেন শিশু বা কিশোর। সেই সন্তানেরা কীভাবে দেখছেন এই দিবসটি? মুনীর চৌধুরীর ছেলে আসিফ মুনীর প্রথম আলোকে বললেন, বাবার স্মৃতি তাঁর খুব একটা মনে নেই। তখন তাঁর বয়স মাত্র চার বছর। বাবা কোনো কোনো রাতে তাঁকে কোলে নিয়ে হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়াতেন, আবছা আবছা তা মনে পড়ে। পরে মা লিলি চৌধুরী ও মেজ ভাই মিশুক মুনীরের কাছে শুনেছেন, তাঁর বাবাকে ১৪ ডিসেম্বর দুপুরে হাতিরপুল সেন্ট্রাল রোডের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এটি ছিল তাঁর দাদার বাড়ি। বাবাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পরে তাঁর মা দোতলার ছাদ থেকে দেখেছিলেন বাড়ির সামনে থেমে থাকা একটি গাড়িতে তাঁকে তোলা হয়েছিল। সেই গাড়িটিতে কাদা মাখা ছিল।

বাবার স্নেহ পাইনি, তবে দেশের স্বাধীনতার জন্য বাবা যে জীবন উৎসর্গ করেছেন, এটা আমাদের জন্য বিপুল গর্বের বিষয়। স্বাধীনতার ইতিহাসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদান জাতিগঠনের প্রেরণার উৎস।
আসিফ মুনীর, শহীদ মুনীর চৌধুরীর ছেলে

আসিফ মুনীর বলেন, ‘বাবার স্নেহ পাইনি, তবে দেশের স্বাধীনতার জন্য বাবা যে জীবন উৎসর্গ করেছেন, এটা আমাদের জন্য বিপুল গর্বের বিষয়। স্বাধীনতার ইতিহাসে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মদান জাতিগঠনের প্রেরণার উৎস।’ দিনটি ভবিষ্যতেও তরুণ প্রজন্মকে একইভাবে দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও মুক্তির পথে অবদান রাখতে অনুপ্রাণিত করেছে বলে তিনি বিশ্বাস করেন।

মুনীর চৌধুরী শিক্ষকতা ও সাহিত্যে অবদান রাখার পাশাপাশি বাংলা টাইপরাইটারের উন্নয়নেও ভূমিকা রেখেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের গ্যালারিতে ‘মুনির অপটিমা’ নামের টাইপরাইটারও সংরক্ষিত আছে।

এখানে দুটি গ্যালারিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিদর্শন রাখা হয়েছে। বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু হয়েছিল প্রধানত দুটি পর্যায়ে। রাজধানীতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অপারেশন সার্চলাইট নামে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও আশপাশের এলাকায় শিক্ষক, চিকিৎসকসহ অনেককে হত্যা করে। এরপর সারা দেশেই বিভিন্ন স্থানে শিক্ষক, সাংবাদিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, গবেষক, আইনজীবী, সাহিত্যিক, শিল্পী, সংস্কৃতিসেবীসহ মেধা–মনন সৃজনশীলতায় যুক্ত বহুজনকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সুপরিকল্পিতভাবে হানাদাররা তালিকা করে রাজধানীতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল।

এখনকার তরুণদেরও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহ্যে শামিল হতে হবে। সেই ঐতিহ্য হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্বের, চিন্তাশীলতার, দেশের ইতিহাস ও কৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং মানবিকতার।
সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, ইমেরিটাস অধ্যাপক

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দুই নম্বর গ্যালারির একাংশে রয়েছে ২৫ মার্চ রাত ও এরপরে যে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের প্রতিকৃতি, পরিচিতি ও বিভিন্ন নিদর্শন। এর মধ্যে আছে কবি মেহেরুন্নেসার প্রতিকৃতি, তাঁর লেখা কবিতার খাতা, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার নোটবুক, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ডায়েরি, চিকিৎসক জিকরুল হকের ব্যবহৃত কোটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেক স্মারক।

জাদুঘরের চার নম্বর গ্যালারির একটি বড় অংশে মূলত ডিসেম্বরের শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে নিয়ে করা হয়েছে একটি কর্নার। এখানেই আছে শহীদ মুনীর চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, আনোয়ার পাশা, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরীসহ অনেকের প্রতিকৃতি ও স্মৃতিময় নিদর্শন। শহীদ সেলিনা পারভিনের প্রতিকৃতির পাশেই আছে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা শিলালিপির একটি কপি। এর পাশে আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমির ইটখোলায় পড়ে থাকা তাঁর হাত বাঁধা মরদেহের ছবি। ডা. আলীম চৌধুরীর ব্যবহৃত পাঞ্জাবি, সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হোসেনের লেখা ইতিহাস কথা কও বইয়ের পাণ্ডুলিপি। ড. রাশীদুল হাসানের কলম। বিজ্ঞানী ড. আমিন উদ্দিনের ব্যবহার করা একটি কাঁচি। এ রকম বহু নিদর্শনের পাশাপাশি রাখা আছে আলোকচিত্র, সেই সময় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বুদ্ধিজীবী হত্যা নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কাটিংসহ অনেক রকম তথ্যউপাত্ত।

মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের দুই নম্বর গ্যালারির একাংশে রয়েছে ২৫ মার্চ রাত ও এরপরে যে বুদ্ধিজীবীরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের প্রতিকৃতি, পরিচিতি ও বিভিন্ন নিদর্শন। এর মধ্যে আছে কবি মেহেরুন্নেসার প্রতিকৃতি, তাঁর লেখা কবিতার খাতা, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার নোটবুক, ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ডায়েরি, চিকিৎসক জিকরুল হকের ব্যবহৃত কোটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অনেক স্মারক।

প্রতিদিন অনেক দর্শনার্থী জাদুঘরে আসেন দেশের ইতিহাসের গৌরবময় অর্জনের স্মৃতিময় নিদর্শনগুলো দেখতে। গত বৃহস্পতিবার গভীর আগ্রহ নিয়ে নিদর্শনগুলো দেখছিলেন মগবাজার থেকে আসা দুই বোন। এমআইএসটি থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতক রিফা তামান্না ইসলাম ও আইইউবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকের শিক্ষার্থী রাইসা তাবাসসুম বললেন, বছরের শেষে এখন ক্লাসের চাপ কম, সেই সুযোগে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর দেখতে এসেছেন। এখানে শুধু মুক্তিযুদ্ধই নয়, সংক্ষেপে খুব সুন্দরভাবে দেশের সামগ্রিক ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। দেশের ভৌগোলিক পরিচিতি, সুদূর অতীতের বিভিন্ন সময়ের আন্দোলন, সংগ্রাম এবং তার ধারাবাহিকতায় মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব পর্যায়ক্রমিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। বইয়ে যে ইতিহাস তাঁরা পড়েছেন তার অনেক কিছুই এখানে প্রামাণ্য আকারে দেখা যাচ্ছে, এতে ধারণা আরও স্পষ্ট হয়েছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে অনেক কিছু এখানে জানা যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের জন্য এটা খুবই অনুপ্রেরণাময়।

শহীদ সেলিনা পারভিনের প্রতিকৃতির পাশেই আছে তাঁর সম্পাদিত পত্রিকা শিলালিপির একটি কপি। এর পাশে আছে রায়েরবাজার বধ্যভূমির ইটখোলায় পড়ে থাকা তাঁর হাত বাঁধা মরদেহের ছবি।

বরাবরের মতো এবারও কৃতজ্ঞ জাতি বিজয় দিবসের প্রাক্কালে আজ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণ করবে শোক ও শ্রদ্ধায়। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য সম্পর্কে ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৪ ডিসেম্বর জাতির জন্য বেদনাঘন দিন। ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্যও। যাঁরা সেদিন শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে রাশীদুল হাসান, সন্তোষ ভট্টাচার্য, গিয়াসউদ্দিন আহমদসহ বেশ কয়েকজন আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। দেশবরেণ্য দার্শনিক জে সি দেব হবিগঞ্জের মানুষ। আমার জন্মস্থানও সেখানে বলে খুব স্নেহ করতেন। বলতেন, ইংরেজি ভাষায় দর্শন পড়া আর মাতৃভাষায় তা অনুভব করা খুবই আনন্দের। মুনীর চৌধুরী আমার সরাসরি শিক্ষক না হলেও বক্তৃতা শুনতে অনেক সময় তাঁর ক্লাসে গিয়েছি।’

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, শহীদ এই বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন অত্যন্ত মানবিক গুণসম্পন্ন মানুষ, দেশের সম্পদ। তাঁদের হত্যার পেছনে পাকিস্তানের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশটাকে বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে দরিদ্র করা, যাতে দেশ স্বাধীন হলেও উঠে দাঁড়াতে না পারে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি বুদ্ধিজীবীরা পরবর্তীকালে তরুণকে অনুপ্রাণিত করবেন। এই তরুণেরাই পরবর্তী সময়ে দেশকে সব ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়েছে। এখনকার তরুণদেরও শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঐতিহ্যে শামিল হতে হবে। সেই ঐতিহ্য হচ্ছে জ্ঞানতত্ত্বের, চিন্তাশীলতার, দেশের ইতিহাস ও কৃষ্টির প্রতি ভালোবাসা এবং মানবিকতার। এটাই শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের তাৎপর্য।