২০১৫ সালের কথা। দিনাজপুরের পার্বতীপুরের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গিয়াস উদ্দিন ব্যক্তিগত ঋণের জন্য উপজেলার হুগলীপাড়া শাখা সোনালী ব্যাংকে যান। ব্যাংক ব্যবস্থাপকের পরামর্শে নাজমা খাতুন নামের স্থানীয় এক নারীর সঙ্গে যোগাযোগ করে ঋণের ভয়ংকর ফাঁদে পড়েন বলে দাবি গিয়াসের।
ঘটনার বিষয়ে গিয়াসের ভাষ্য, ব্যাংক ব্যবস্থাপক নাজির হোসেন তাঁকে সেখানে (ব্যাংক) থাকা নাজমার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। নাজমা ঋণের আবেদন পূরণ করতে বলেন। ১ লাখ টাকা ঋণের কথা বলে ৩টি ফাঁকা চেক ও ৩০০ টাকার নন–জুডিশিয়াল ফাঁকা স্ট্যাম্পে তাঁর স্বাক্ষর নেন নাজমা। তিনি পরে গিয়াসকে ৫০ হাজার টাকা দেন। এই টাকা মাসিক ২০ শতাংশ সুদে (দাদন) দেওয়া হয়েছে বলে জানান। ঋণের পাঁচ গুণ টাকা দিয়েও রেহাই পাননি গিয়াস। চক্রটি ভয় দেখিয়ে ২০১৮ সালে তাঁর ৩ শতক জমি লিখে নেয়। তাঁর বিরুদ্ধে দিনাজপুর, নীলফামারী ও রাজশাহীর আদালতে ২৫ লাখ টাকার চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা দেওয়া হয়। একটি মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে জামিন পান।
গিয়াসের অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমে পার্বতীপুরে একটি চক্রের সন্ধান পাওয়া যায়, যাঁরা প্রতারণার মাধ্যমে লোকজনকে ঋণের ফাঁদে ফেলে সুদের ব্যবসা করেন। চক্রে ব্যাংক কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, পার্বতীপুরে এমন ফাঁদে পড়া ব্যক্তির সংখ্যা তিন শতাধিক। দেশের বিভিন্ন জেলার আদালতে তাঁদের নামে চেক প্রত্যাখ্যানের ৬ শতাধিক মামলা করেছে চক্রটি।
১৫২ ভুক্তভোগীর তথ্য প্রথম আলোর কাছে রয়েছে। ২ থেকে ৬ জুন এই প্রতিবেদক ৪৭ ভুক্তভোগীর বাড়িতে যান। এ ছাড়া ৫৫ জনের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেন। সবাই ঋণের ফাঁদে পড়ার কথা বলেন।
পার্বতীপুরের বাসিন্দা অবসরপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ জেলা ও দায়রা জজ আ ব ম আবু সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, নাজমাদের চক্র অনেক মানুষকে জিম্মি ও হয়রানি করেছে। মানুষ আদালতের বারান্দায় ঘুরছে। চক্রটির বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর হওয়া উচিত। কিন্তু তা দেখা যাচ্ছে না।
স্থানীয় সূত্রের ভাষ্য, হুগলীপাড়া শাখা সোনালী ব্যাংকে উপজেলার প্রায় ১ হাজার শিক্ষকের সঞ্চয়ী হিসাব আছে। তাঁরা সেখান থেকে বেতন-বোনাস তোলেন। আর্থিক সংকটে পড়লে ব্যক্তিগত ঋণ নেন। এই সুযোগ কাজে লাগান নাজমারা। শিক্ষকসহ অন্যদের তাঁরা ঋণের ফাঁদে ফেলেন। চক্রে নাজমার ছেলে নাদির শাহ ওরফে নয়ন, ব্যবসায়িক অংশীদার সাখাওয়াত হোসেন ওরফে সাজু ও মরিয়ম খাতুন আছেন। স্থানীয়দের কাছে এটি ‘নাজমা-সাজু চক্র’ নামে পরিচিত। চক্রের সঙ্গে ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশ আছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৯ সালে চক্রটি বেপরোয়াভাবে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা দিতে শুরু করে। সে সময় থেকে গত মে মাস পর্যন্ত পার্বতীপুরের ১৫ শিক্ষকসহ ২৮ ব্যক্তি মামলায় গ্রেপ্তার হন।
পার্বতীপুরের সিরাজুল হুদা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন যোগেন্দ্র নাথ রায়। তিনি ও তাঁর স্ত্রী দয়া রানী রায়ের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দেয় চক্রটি। সহকর্মীদের ভাষ্য, যোগেন্দ্র গ্রেপ্তার-আতঙ্কে ছিলেন। তিনি গত ১৩ নভেম্বর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। সম্প্রতি পার্বতীপুরের সরকারি বঙ্গবন্ধু উচ্চবিদ্যালয়ের অফিস সহকারী স্বপন কুমার পাল ‘আত্মহত্যা’ করেন। সহকর্মীদের ভাষ্য, তিনি চক্রটির খপ্পরে পড়ে ‘আত্মহত্যা’ করেন।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, নাজমা-সাজুরা নিজেরা বাদী হয়ে অনেকের বিরুদ্ধে চেক প্রত্যাখ্যানের মামলা করেছেন। অনেক ক্ষেত্রে ‘ভাড়াটে’ লোক দিয়ে মামলা করিয়েছেন।
১৫২টি মামলার কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, রাজশাহীর আদালতে সবচেয়ে বেশি ৯৬টি মামলা হয়েছে। দিনাজপুরে ৪৩টি। এ ছাড়া নীলফামারী, রংপুর, গাইবান্ধা, ঠাকুরগাঁও, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও ঢাকার আদালতে মামলা আছে। নাজমা ২৬টি, সাজু ৩৪টি, সোহানুর ১৭টি, শাহাজাদা ১৫টি ও মরিয়ম ১০টি মামলার বাদী।
নাজমার দাবি, টাকা পরিশোধ না করায় তিনি মামলা করেছেন। ২৯ মে সাজুর গ্রামের বাড়ি ছোট হরিপুর মুন্সিপাড়ায় গিয়ে তাঁকে পাওয়া যায়নি। তাঁর মুঠোফোনে যোগাযোগ করেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। তাঁর মা মাহমুদা বেগম বলেন, টাকা নিলে তা পরিশোধ করতে হবে।
‘ভাড়াটে’ বাদী সোহানুর প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর তিনি ভুল বুঝতে পেরে এই চক্র থেকে বেরিয়ে আসেন। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে দুটি মামলা দেওয়া হয়।
স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ২০২০ সালে নাজমার স্টেশনারি দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালান। অভিযানে সই করা ফাঁকা স্ট্যাম্প ও চেক, চেকবই, ঋণের আবেদনপত্র, ব্যাংকের সিলসহ নানা আলামত জব্দ হয়। নাজমা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা ও মুচলেকা দিয়ে ছাড়া পান।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এই চক্রের সঙ্গে সোনালী ব্যাংকের হুগলীপাড়া শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক নাজির হোসেন, রেজওয়ানুল হক ও বর্তমান ব্যবস্থাপক মোকাদ্দেছ হোসেন জড়িত।
নাজির এখন সোনালী ব্যাংকের দিনাজপুরের প্রিন্সিপাল কার্যালয়ের (সাউথ) জ্যেষ্ঠ প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা। রেজওয়ানুল প্রিন্সিপাল কর্মকর্তা (নর্থ)। অভিযোগের বিষয়ে নাজিরের দাবি, এ রকম ঘটনা তাঁর জানা নেই। রেজওয়ানুল বলেন, তাঁর সময়ে নাজমা এসএমই গ্রাহক হওয়ায় ব্যাংকে তাঁর যাতায়াত ছিল। বাইরের ঘটনা তিনি জানেন না। আর বর্তমান ব্যবস্থাপক মোকাদ্দেছের দাবি, তিনি নাজমাকে চেনেন না।
জানতে চাইলে দিনাজপুরের সোনালী ব্যাংকের প্রিন্সিপাল কার্যালয়ের (নর্থ) উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আতাহারুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তিনি গত ফেব্রুয়ারিতে এখানে এসেছেন। অভিযোগের বিষয়ে তাঁর জানা নেই। তবে এমন ঘটনা ঘটে থাকলে তিনি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবেন।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, ঋণের ফাঁদ পেতে গত ১০ বছরে নাজমারা বিপুল অর্থসম্পদের মালিক হয়েছেন। তাঁরা অনেকের কাছ থেকে জমি পর্যন্ত লিখে নিয়েছেন। চক্রের খপ্পরে পড়ে, গ্রেপ্তার এড়াতে বেশ কিছু পরিবার এলাকাছাড়া হয়েছেন। কিন্তু চক্রটির বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
নাজমার দাবি, তিনি অনেক কষ্ট করে সম্পদ করেছেন। তাঁর উল্টো প্রশ্ন, লোকজন জমি লিখে দেয় কেন?
অন্তত ৯ ভুক্তভোগী বলেন, তাঁরা চক্রের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন। ৬ ভুক্তভোগী বলেন, তাঁরা প্রতিকার চেয়ে থানায় গিয়েছিলেন, সমাধান পাননি। শিক্ষক সাহেদারা খাতুন বলেন, থানায় গিয়ে উল্টো তাঁর ৫ হাজার টাকা খরচ হয়েছে।
পার্বতীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা চিত্তরঞ্জন রায় বলেন, পুলিশ সুপারের নির্দেশে গত বছর তাঁরা চক্রটির ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে একটি প্রতিবেদন দিয়েছেন। ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না কেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটা আদালতের বিষয়।’