বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিগত তিনটি নির্বাচন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কাজেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে নামেই ডাকা হোক না কেন, নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকারের বিকল্প নেই। তাই নির্বাচনী সংস্কারের প্রধান ক্ষেত্র হিসেবে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে আজ শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এসব কথা বলেছেন সিলেটে অবস্থিত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক মো. নজরুল ইসলাম। সেমিনারে অন্য বক্তারাও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও গণতান্ত্রিক চর্চা থাকাসহ আরও বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরা হয়।
‘বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন: কার্যকর ও টেকসই সংস্কার’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করে ‘জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদ’ নামের একটি সংগঠন।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা বলে, দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হয়নি। সর্বশেষ ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন তার জ্বলন্ত প্রমাণ। নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও শক্তিশালী করার পরেও সুষ্ঠু নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কারণ, পুরো নির্বাচনটি পরিচালনা করে সরকারের নির্বাহী বিভাগের লোকেরা, আমলাতান্ত্রিক প্রশাসনের কর্মকর্তা এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মচারীরা। নির্বাচন কমিশন সেখানে কেবল লজিস্টিক সাপোর্টস এবং গাইডিং প্রিন্সিপালস সরবরাহ করে মাত্র। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি প্রশাসনের সদস্যরাই এ–সংক্রান্ত নির্বাহী কার্যক্রম সম্পন্ন করে। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা আরও বলে, ক্ষমতাসীন সরকার ও দল ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনে পরাজয় বরণ করতে একদম নারাজ। নিকট ভবিষ্যতেও এর কোনো ব্যত্যয় হওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না। কাজেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দলীয় সরকার নয়; বরং নির্বাচনকালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা অন্তর্বর্তী সরকার, যে নামেই অভিহিত করা হোক না কেন, এর বিকল্প নেই।
অধ্যাপক নজরুল বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ত্রুটিগুলো দূর করতে এবং বাংলাদেশে নির্বাচনকে সত্যিকার অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু করতে হলে সংস্কারের বেশ কিছু ক্ষেত্র বিবেচনা করতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার, আইনি সংস্কার এবং স্বচ্ছতা বৃদ্ধি এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করার জন্য পদ্ধতিগত পরিবর্তন।
দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনের তথ্য উল্লেখ করে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো কমবেশি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। এরপর ৯০–এর দশকের শুরু থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যে কয়েকটি নির্বাচন হয়েছিল, এগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে, দেশে ও বিদেশে গ্রহণযোগত্যা পেয়েছে। কিন্তু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করার পর যে নির্বাচন হয়েছে, এই নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়নি। এটাই ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হওয়ার মূল কারণ। তাই কীভাবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হবে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে নির্বাচনে সবার জন্য সমান সুযোগের (লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড) ওপর গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সম্পাদক ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ–উপাচার্য অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন। বিভিন্ন প্রেক্ষাপট তুলে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যখন একটার পর একটা নির্বাচন হলো ১৯৯১ সালে, ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ সালে—তার প্রতিটি নির্বাচনে দেখা গেছে, একদম সুষ্ঠুভাবে ভোট হয়েছে এবং সুন্দর একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে বাংলাদেশে বিরাজমান ছিল। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে স্বৈরাচার স্থাপন করল। তারপর ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনের প্রতিটিতে দেখা গেল, এমনকি তিনি নিজে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন তাঁর ভোট দেওয়া হয়ে গেছে। অর্থাৎ কোনো মানুষ সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে পারেনি। নির্বাচনটি ছিল একটা ছেলেখেলা।
অধ্যাপক দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন বলেন, ছাত্র-জনতা সবাই মিলে একসঙ্গে আন্দোলন করেছেন। এখন তাঁরা আশা করছেন একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হবে এবং এর সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে আশা–আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হবে।
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় রাষ্ট্রচিন্তা পরিষদের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল লতিফ মাসুম বলেন, আজকের সেমিনারের বক্তব্যগুলো সমন্বিত করে প্রথমে নির্বাচনী ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের কাছে দেবেন। পরে তা নির্বাচন কমিশনের কাছেও দেবেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক কাজী মাহবুবুর রহমানের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য দেন সাবেক সচিব শেখ মোতাহার হোসেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক তারেক ফজল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের চেয়ারম্যান মেজবাহ উল-আজম সওদাগর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক স ম আলী রেজা, আয়োজক সংগঠনের কোষাধ্যক্ষ জিয়া হাসান, জ্যেষ্ঠ নাগরিক শাহ আবদুল হালিম প্রমুখ।