তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগ

আইসিটি বিভাগ

সফর বন্ধের ঘোষণা দিয়ে সাড়ে তিন মাসেই বিদেশ গেলেন প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে টানা তিন মেয়াদে দায়িত্বে আছেন জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক। দ্বাদশ সংসদে এ বিভাগে প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন শুরুর প্রথম কার্যদিবসেই তিনি কিছু ঘোষণা দেন। উল্লেখযোগ্য ঘোষণার মধ্যে ছিল বছরের প্রথম ছয় মাস আইসিটি বিভাগের সব বিদেশ সফর বন্ধ রাখার বিষয়টি। কিন্তু ঘোষণার সাড়ে তিন মাসেই প্রতিমন্ত্রীসহ ২৩ জন বিদেশ সফর করেছেন।

জুনাইদ আহ্‌মেদ দশম ও একাদশ সংসদে সরকারের আইসিটি বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। দ্বাদশ সংসদে এসে আইসিটির সঙ্গে ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগেরও দায়িত্ব পেয়েছেন তিনি।

চলতি মেয়াদে সরকারের প্রথম কার্যদিবস ছিল গত ১৪ জানুয়ারি। আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সঙ্গে ওই দিন মতবিনিময় সভা করেন জুনাইদ আহ্‌মেদ। সভায় তিনি কিছু নির্দেশনা দেন।

অর্থনৈতিক সংকটে ব্যয়সংকোচনের কথা সরকার থেকে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। মানুষ প্রত্যাশা করে, সরকার ও মন্ত্রীরা যখন কোনো নির্দেশনা দেবেন, তা পালন করা হবে। কিন্তু সেখানে যদি এ ধরনের ব্যত্যয়ের ঘটনা ঘটে, তখন শুধু মন্ত্রীদেরই না, সরকারের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।
ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

সেদিনের সভায় জুনাইদ আহ্‌মেদ বলেছিলেন, ‘প্রথম দিন থেকেই আমরা কিছু না কিছু পরিবর্তন আনতে চাই; যেখানে মূল হবে মিতব্যয়িতা। আমরা আমাদের সময়-মেধা ও অর্থের অপচয় রোধ করতে চাই। এ কারণে আমি সচিবকে অনুরোধ করব, আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত আইসিটি ডিভিশন থেকে কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী বিদেশ সফরে যাবেন না।’

প্রতিমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের এক্সপোর্ট আর্নিং (রপ্তানি আয়) বাড়াতে হবে, রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) বাড়াতে হবে। আউটবাউন্ড যত রকম কারেন্সি (বিদেশে খরচ), বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে হবে। এর মধ্যে প্রথম পদক্ষেপ যেটি আমার হাতে আছে, আগামী ছয় মাস আমি বিদেশ যাব না, সেক্রেটারি (সচিব) যাবে না। আইসিটি ডিভিশনের কেউ যাবে না। কোনো ট্রেনিং না, কোনো শিক্ষাসফর না, কোনো কিছু না।’

প্রতিমন্ত্রীর এমন ঘোষণার পর আইসিটি বিভাগ থেকে বিদেশ সফর–সংক্রান্ত ১৫টি সরকারি আদেশ জারি হয়েছে; যেখানে একজনের ডেপুটেশন বাদে আইসিটি বিভাগ ও এর অধীন বিভিন্ন সংস্থা এবং প্রকল্পের ২৩ জনের বিদেশ সফরের হিসাব পাওয়া যায়।

প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ তাঁর ঘোষণায় নিজে ছাড়াও সচিব বিদেশ সফর করবেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন গত ৪ থেকে ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে যান ‘গ্লোবাল ডিজিটাল সামিট অ্যান্ড এক্সিবিট: একসেলারেটিং ডিজিটাল-কানেক্ট, ইনোভেট ট্রান্সফর্ম’ নামের একটি আয়োজনে অংশ নেন।

জানতে চাইলে জুনাইদ আহ্‌মেদ প্রথম আলোকে নিজের সফর সম্পর্কে বলেন, থাইল্যান্ডে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসকাপ) এক সম্মেলনের ৮০তম অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে সফরসঙ্গী হিসেবে গিয়েছেন। আর অন্যদের বিষয়ে বলেন, যেসব সফর বার্ষিক উন্নয়ন ও প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ছিল এবং যেখানে না গেলে প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় বেড়ে যেত; সেখানে যাওয়া হয়েছে। তবে বিদেশ সফর তিনি নিরুৎসাহিত করছেন।

জুনাইদ আহ্‌মেদ ওই সফর ছাড়াও গত ১৬ থেকে ১৮ এপ্রিল সিঙ্গাপুরে যান ‘ওরাকল ক্লাউড ওয়ার্ল্ড ট্যুরে’ অংশ নিতে। বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের (বিসিসি) ‘এনহেন্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি (ইডিজিই)’ প্রকল্প থেকে তাঁর এ সফরের ব্যয় বহন করা হয়। এ ছাড়া এপ্রিলেই থাইল্যান্ডেও যান তিনি।

এদিকে প্রতিমন্ত্রী তাঁর ঘোষণায় নিজে ছাড়াও সচিব বিদেশ সফর করবেন না বলে জানিয়েছেন। কিন্তু বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন গত ৪ থেকে ৭ মার্চ যুক্তরাষ্ট্রে যান ‘গ্লোবাল ডিজিটাল সামিট অ্যান্ড এক্সিবিট: একসেলারেটিং ডিজিটাল–কানেক্ট, ইনোভেট ট্রান্সফর্ম’ নামের একটি আয়োজনে অংশ নেন। সফরে তাঁর সঙ্গে এটুআইয়ের পলিসি অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরীও যান। সফরের ব্যয় বহন করে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ।

কারা কোন সফরে

থাইল্যান্ডে ২২ থেকে ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের সম্মেলনে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ, এটুআই প্রকল্প পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ ভূঁইয়া, পলিসি অ্যাডভাইজার আনির চৌধুরী, প্রতিমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব মো. মুশফিকুর রহমান, এটুআইয়ের স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড ইনোভেশন বিশেষজ্ঞ এইচ এম আসাদ–উজ–জামান ও কমিউনিকেশনস অ্যান্ড আউটরিচ কনসালট্যান্ট এ বি এম আদনান ফয়সল অংশ নেন। সফরে প্রতিমন্ত্রীর খরচ আইসিটি বিভাগ এবং অন্য পাঁচজনের খরচ এটুআই বহন করে।

কোনো প্রশিক্ষণে যাওয়া যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু বিদেশ সফরের আদেশ থেকে দেখা যায়, জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির সহকারী পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ও উত্তরা শতদ্রু প্রাচী ১৯ মে থেকে আগামী ১ জুন জাপানে ‘ক্যাপাসিটি ডেভেলপমেন্ট অন সাইবার সিকিউরিটি’ নামের এক প্রশিক্ষণে অংশ নেবেন। তাঁদের খরচ বহন করবে জাইকা।

২৪ থেকে ২৬ এপ্রিল ‘জাপান আইটি উইক স্প্রিং’–এ অংশ নিতে জাপানে যান হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জি এস এম জাফরুল্লাহ, উপপরিচালক মোহাম্মদ আতিকুল ইসলাম ও সহকারী পরিচালক শাহরিয়ার আল হাসান। খরচ বহন করে হাই–টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ।

জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা এজেন্সির মহাপরিচালক আবু সাঈদ মো. কামরুজ্জামান, বিসিসির পরিচালক মো. আবু সাঈদ ও আইসিটি বিভাগের উপসচিব মো. জিল্লুর রহমান ২৯ থেকে ৩০ এপ্রিল থাইল্যান্ডে ‘ডিজিটাল অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্ট অ্যাপেক কংগ্রেস ২০২৪’–এ  অংশ নেন। খরচ বহন করে হুয়াওয়ে।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে ৮ থেকে ৯ মার্চ ‘এক্সক্লুসিভ নেক্সাস এক্সিকিউটিভ ইভেন্ট’–এ যোগ দেন আইসিটি বিভাগের যুগ্ম সচিব আতাউর রহমান খান ও মো. মজিবর রহমান। নেক্সাস এক্সিকিউটিভ ফোরাম ব্যয় বহন করে।

৭ মার্চ একই বিভাগের উপসচিব মোহাম্মদ ইউসুফ কাজাখস্তানে ‘ইনফরমাল ড্রাফটিং গ্রুপ ফর ডেভেলপমেন্ট অব এ ড্রাফট মিনিস্ট্রিয়াল ডিক্লারেশন’-এ যোগ দেন। খরচ বহন করে ইউএনএসকাপ।

বিসিসির নির্বাহী পরিচালক রণজিৎ কুমার ও পরিচালক মো. গোলাম সারওয়ার ২৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ মার্চ ‘জাইকা’স ভিজিট প্রোগ্রাম টু ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ইনফরমেটিকস’–এ অংশ নিতে জাপান যান। খরচ বহন করে জাইকা।

২৬ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি মালদ্বীপে ‘ফার্স্ট ইউএনডিপি–আইএসডিবি’স ডিজিটাল স্টুয়ার্ডস’ ওয়ার্কশপে অংশ নেন আইসিটি বিভাগের যুগ্ম সচিব এ টি এম জিয়াউল ইসলাম। খরচ বহন করে ইউএনডিপি।

হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষের বিডিসেট প্রকল্প পরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম ২০ থেকে ২২ ফেব্রুয়ারি থাইল্যান্ডে ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন’ ওয়ার্কশপে যোগ দেন। এ জেড টেকনোলজি নামের একটি প্রতিষ্ঠান সফরের ব্যয় বহন করে।

এ ছাড়া ওই সরকারি আদেশ অনুযায়ী, বিসিসির অ্যাসোসিয়েট (সিএ) মো. আবদুর রউফের ২৪ এপ্রিল থেকে ৩ মে দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন কোর্স’ নামের প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়ার কথা। তাঁর খরচ বহন করবে ন্যাশনাল আইটি ইন্ডাস্ট্রি প্রোমোশন এজেন্সি।

কৃচ্ছ্র সাধনে বিদেশ সফর বন্ধে সরকারের নির্দেশনা

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ২০২২ সালের মে মাসে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের বিষয়ে পরিপত্র জারি করেছিল সরকার। তবে ওই বছরের সেপ্টেম্বরে কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সীমিত আকারে বিদেশ ভ্রমণ করা যাবে বলে সিদ্ধান্ত হয়।
একই বছরের নভেম্বরে পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ সফর বন্ধের আরও একটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। আবার ২০২৩ সালের ৩১ মে এক নির্দেশনায় সরকারি ব্যয়ে আকাশপথে প্রথম শ্রেণিতে বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত করা হয়।

সরকারের এসব নির্দেশনা এখনো তুলে নেওয়া হয়নি।

প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদও বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে নিজেই আইসিটি বিভাগে সব বিদেশ সফর বন্ধের নির্দেশনা দেন। অবশ্য নির্দেশনায় সরকারি–বেসরকারি অর্থায়নের বিষয় উল্লেখ করেননি তিনি। তাঁর নির্দেশনার পর গত সাড়ে তিন মাসে যে ২৩ জনের বিদেশ সফরের আদেশ জারি হয়েছে, তাতে ১৫ জনের অর্থায়নের বেলায় বেসরকারি সংস্থা, প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি সহায়তা সংস্থার কথা উল্লেখ করা হয়। অন্যরা আইসিটি বিভাগ ও এর অধীনস্থ সংস্থা ও প্রকল্পের টাকায় বিদেশে সফর করেছেন।

এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, অর্থনৈতিক সংকটে ব্যয়সংকোচনের কথা সরকার থেকে বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে। মানুষ প্রত্যাশা করে, সরকার ও মন্ত্রীরা যখন কোনো নির্দেশনা দেবেন, তা পালন করা হবে। কিন্তু সেখানে যদি এ ধরনের ব্যত্যয়ের ঘটনা ঘটে, তখন শুধু মন্ত্রীদেরই না, সরকারের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়।

আইসিটি প্রতিমন্ত্রীর নির্দেশনা কেন মানা হলো না এবং সফরগুলোর সবই প্রয়োজনীয় ছিল কি না, তা তাঁর নিজেরই খতিয়ে দেখা উচিত বলে মন্তব্য করেন ইফতেখারুজ্জামান।