ডিজেলে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ভাড়া কিলোমিটারে পাঁচ পয়সা কমানো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, এতে যাত্রীদের কতটা লাভ হবে। বরং সরকার পরিবহনমালিক-শ্রমিকদের আয় বৃদ্ধির একটা সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করছেন ভুক্তভোগীরা।
সরকার গত সোমবার জ্বালানি তেলের দাম লিটারে পাঁচ টাকা করে কমিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে। এরপরই পরিবহন ভাড়া কমানোর বিষয়টি সামনে আসে।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রতি কিলোমিটারে ৫ পয়সা ভাড়া কমানোর অর্থ—একজন যাত্রী ২০ কিলোমিটার চললে ১ টাকা ভাড়া কমবে। কিন্তু নগর পরিবহনে বেশির ভাগ যাত্রীই স্বল্প দূরত্বে চলাচল করে। এতে ভাড়া কমানোর সুফল তারা পাবে না। আবার ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বড় শহরে ৫ কিংবা ১০ টাকার বাইরে খুচরা নোটের প্রচলন খুব একটা নেই। অর্থাৎ, ৫ বা ১০ টাকার কম ভাড়া কমলে দূরপাল্লার যাত্রীরাও সুবিধা পাবে না।
বুধবার বিকেলে বনানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) প্রধান কার্যালয়ে পরিবহনমালিক-শ্রমিকনেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে কিলোমিটারপ্রতি পাঁচ পয়সা ভাড়া কমানোর ঘোষণা দেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী।
এর আগে ডিজেলের দাম প্রতি লিটারে ৩৪ টাকা বৃদ্ধির পর দূরপাল্লায় কিলোমিটারপ্রতি ৪০ পয়সা এবং নগর পরিবহনে ৩৫ পয়সা হারে ভাড়া বৃদ্ধির ঘোষণা দেয় সরকার। এবার দূরপাল্লা ও মহানগর—সব বাসেই প্রতি কিলোমিটারে পাঁচ পয়সা কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রাজধানীতে প্রতি কিলোমিটারে বাসভাড়া ২ টাকা ৪৫ পয়সা এবং দূরপাল্লায় ২ টাকা ১৫ পয়সা হবে। বৃহস্পতিবার থেকে নতুন ভাড়ার হার কার্যকর হবে।
এর আগে ২০১৬ সালে ডিজেলের মূল্য লিটারে তিন টাকা কমানোর পর বাসভাড়া তিন পয়সা কমানো হয়। কিন্তু বাসমালিক-শ্রমিকেরা যাত্রীদের কাছ থেকে আগের ভাড়াই আদায় করেন। এবারও এমনটিই হবে বলে মনে করছেন বিআরটিএ কর্মকর্তারা।
ভাড়া নির্ধারণে যুক্ত বিআরটিএ সূত্র বলছে, জ্বালানি তেলের দাম অল্প কমালে যাত্রীদের উপকারে আসে না। কারণ, দাম বাড়লে বাসের অন্যান্য খরচ বাড়িয়ে ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। ৬ আগস্ট ভাড়া বৃদ্ধির সময় এভাবে ব্যয় বিশ্লেষণে বাসের টায়ার-টিউব ও চালকের বেতন-ভাতা-বোনাসসহ নানা উপকরণের মূল্যবৃদ্ধি বিবেচনায় নেওয়া হয়। এমনকি গ্যারেজ ভাড়াসহ এমন সব আজগুবি ব্যয় যুক্ত করা হয়, যা আসলে পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা খরচ করেন না। অন্যদিকে ভাড়া কমানোর প্রশ্ন এলে শুধু জ্বালানির মূল্য যত কমেছে, সেই হারে ভাড়া কমানো হয়।
বিআরটিএ সূত্র জানায়, ৬ আগস্ট ব্যয় বিশ্লেষণের সময় বলা হয়েছিল, মহানগর এলাকায় একটি বাস-মিনিবাস এক লিটার ডিজেলে আড়াই কিলোমিটার চলে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গাজীপুরের চন্দ্রা পর্যন্ত দূরত্ব প্রায় ৫০ কিলোমিটার। সে হিসাবে ওই পথে একবার যাত্রায় ডিজেল খরচ হয় ২০ লিটার। আগে জ্বালানিতে খরচ হতো ২ হাজার ২৮০ টাকা। ৫ টাকা কমায় এখন খরচ হবে ২ হাজার ১৮০ টাকা। অর্থাৎ, ব্যয় কমেছে ১০০ টাকা। কোনো যাত্রী শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যাতায়াত করলে আড়াই টাকা ভাড়া কমবে। এভাবে দিনে ৪ বার আসা-যাওয়া করলে ১টি বাসে ৪০০ টাকা খরচ কমবে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, বিআরটিএ যেভাবে তালিকা করে দেবে, সেভাবেই ভাড়া আদায় করা হবে। কেউ ভাড়া বেশি আদায় করলে মালিক সমিতি ও সরকার ব্যবস্থা নেবে।
একইভাবে দূরপাল্লার পথেও মালিক-শ্রমিকেরই সুবিধা হবে। ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব ২৪২ কিলোমিটার। বিআরটিএ যেভাবে ব্যয় বিশ্লেষণ করেছে, তাতে একটি বাস একবার চট্টগ্রামে গেলে প্রায় ৪০০ টাকা জ্বালানি খরচ কমবে। এই পথের বেশির ভাগ বাসই দিনে একবার করে যাওয়া-আসা করে। এর ফলে ৮০০ টাকা জ্বালানি খরচ বাঁচবে। এই পথে যাত্রীপ্রতি ভাড়া কমবে ১২ টাকা। অতীতে সামান্য ভাড়া কমলে মালিক-শ্রমিকেরা সেটি মানেননি।
বিআরটিএ সূত্র বলছে, বিলাসবহুল এসি বাস ও মালবাহী যানবাহন ব্যবহারকারীরা আরও বেশি ঠকবেন। কারণ, এই দুই শ্রেণির পরিবহনের ভাড়া সরকার নির্ধারণ করে না। সাধারণ বাসের চেয়ে এসি বাস ও মালবাহী যানে জ্বালানি খরচও বেশি হয়। এর ফলে ডিজেলের দাম কমায় তাদের খরচ বেশ কমবে। এখানে ভাড়া ঠিক হলো কি না, দেখারও কেউ নেই।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহানগরে ৮২ শতাংশ মানুষ ৩-৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাসে যাতায়াত করে। তাদের ভাড়া কমবে না। কারণ, এই দূরত্বে সরকার সর্বনিম্ন ভাড়া মিনিবাসে ৮ টাকা ও বাসে ১০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। দূরপাল্লার পথে ৫০ শতাংশ মানুষ ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে যাতায়াত করে। এ ক্ষেত্রে জনপ্রতি ভাড়া কমবে পাঁচ টাকা, যা কখনোই কার্যকর হবে না। এর ফলে সরকারের সিদ্ধান্তে সাধারণ মানুষ নয়, লাভবান হয়েছেন পরিবহনমালিক-শ্রমিকেরা।
অবশ্য বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মাহবুব-ই-রব্বানী যাত্রীদের তালিকা দেখে ভাড়া পরিশোধ করার পরামর্শ দিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, কোনো যাত্রী বিআরটিএতে অভিযোগ করলে সংশ্লিষ্ট বাসমালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতও চলবে।