দখলদারদের নাম চেপে যাচ্ছে নদী রক্ষা কমিশন

২৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সমীক্ষা। ৪৮ নদীতে প্রায় ৩৮ হাজার অবৈধ স্থাপনা ও দখলদারের নাম পাওয়া গেছে। পুরো অর্থই জলে গেল

বালু ফেলে দখল করা হচ্ছে তুরাগ নদ

দেশের ৪৮টি নদীর দখলদারদের নিয়ে তৈরি একটি তালিকা প্রকাশ করছে না জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। চূড়ান্ত প্রতিবেদনে তাদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে। এমনকি সংস্থাটির ওয়েবসাইটে স্থাপনার তালিকা দিয়ে পরে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। চার বছর সমীক্ষা চালিয়ে ৪৮টি নদী দখলে ৩৮ হাজার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সমীক্ষা করতে খরচ হয়েছিল ২৯ কোটি টাকা। তালিকা প্রকাশ না করায় এখন পুরো টাকা গচ্চা যাচ্ছে।

গত ১৫ ডিসেম্বর কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় সিদ্ধান্ত হয়, নদীর দখলদার ও ১০ মিটারের মধ্যে নির্মিত স্থাপনার নাম চূড়ান্ত প্রতিবেদনে প্রকাশ করা যাবে না। দখলদারদের তালিকা সংস্থার ডেটাবেজে প্রকাশ করা হবে না। প্রিন্ট কপিতেও এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। কমিশনের যুক্তি, সিএস খতিয়ান মেনে সমীক্ষাটি করা হয়নি।

‘নদীদূষণ ও অবৈধ দখলদারি থেকে ৪৮ নদী রক্ষা’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় দখলদারদের তালিকা করা হয়। ২০১৮ সালে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে গত ৩১ ডিসেম্বর শেষ হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে ২৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।

কমিশন অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দখলদারদের তালিকা বাদ দিচ্ছে। সিএস খতিয়ানের সঙ্গে পানি আইনের সাংঘর্ষিক কোনো কিছু নেই। ২০২৩ সালে এসে শুনতে হচ্ছে, অবৈধ দখলদারদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। তাহলে কমিশন কার নাম প্রকাশ করবে?
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী

কমিশনের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও নদীবিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রভাবশালীদের বাঁচাতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে দখলদারদের নাম বাদ দেওয়া হচ্ছে।

প্রকল্পের কাজ শুরুর সময় কমিশনের চেয়ারম্যান ছিলেন মুজিবুর রহমান হাওলাদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৪৮টি নদীতে দখল করে কারা স্থাপনা বানিয়েছেন, তাদের চিহ্নিত করতেই ওই প্রকল্প নেওয়া হয়। সব আইন মেনে দখলদারদের তালিকা করা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদন থেকে তালিকা বাদ দেওয়ার অর্থ হচ্ছে, দখলদারদের প্রশ্রয় দেওয়া। তালিকায় নাম আসা রথী-মহারথীরা প্রভাব খাটিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দিচ্ছেন না।

কমিশনের সভায় যা আলোচনা হয়

কমিশনের ৩২তম সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, সভায় কমিশনের সদস্য মালিক ফিদা আবদুল্লাহ খান বলেন, হাইকোর্টের রায়ের আলোকে সিএস খতিয়ান অনুযায়ী দখলদার চিহ্নিত করা হয়নি। প্রকল্পের মাধ্যমে চিহ্নিত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম প্রতিবেদনে আনা যাবে না। ডেটাবেজে দেওয়া যাবে না। তালিকাও প্রকাশ করা যাবে না।

সভায় কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ বলেন, ২০১৩ সালের পানি আইন অনুযায়ী নদীর অবৈধ দখল বা নদীর তীরবর্তী স্থাপনার তালিকা করা হয়েছে। এই তালিকা প্রকাশ করলে আইনি ও প্রশাসনিক সমস্যা হতে পারে।

একই মত প্রকাশ করেন কমিশনের নির্বাহী পরিচালক মনজুরুল কাদের।

মুখোমুখি কর্মকর্তারা

সমীক্ষা প্রতিবেদন নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে কমিশন ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। প্রকল্পের কর্মকর্তারা বলছেন, সমীক্ষা করতে গিয়ে তাঁরা জিআইএস প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন। জেলা প্রশাসকসহ সরকারি দপ্তর থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। প্রতিটি মৌজার তথ্য নিয়ে সমীক্ষা করা হয়েছে। সিএস অনুযায়ী সমীক্ষা করলে সঠিক তথ্য পাওয়া যেত না। কারণ, গত কয়েক বছরে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়ে গেছে।

কমিশনের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আপাতত তালিকাটি প্রকাশ করছি না। কারণ, এতে ভুলত্রুটি আছে। তা ছাড়া সমীক্ষায় দখলদারদের নাম নেই, শুধু স্থাপনার নাম দেওয়া হয়েছে।’

জবাবে প্রকল্পের পরিবেশ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ মুনির হোসেন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, প্রথমে দখলদারদের নাম দেওয়া হলেও কমিশনের চেয়ারম্যানের চাপে নাম বাদ দেওয়া হয়েছে।

কমিশনের চেয়ারম্যান প্রকল্পের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ফাঁকিবাজির অভিযোগ এনেছেন। জবাবে মুনির হোসেন বলেন, ফাঁকিবাজি করলে কমিশন দায় এড়াতে পারে না। তারা কী ব্যবস্থা নিয়েছে?

প্রতিবেদনের তথ্য

সমীক্ষা প্রকল্পের প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, সবচেয়ে বেশি ৪ হাজার ৭০৭টি স্থাপনা পাওয়া গেছে কীর্তনখোলা নদীতে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে পাওয়া গেছে ২ হাজার ৪৯৩টি স্থাপনা। এ ছাড়া ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে ৮৯৪টি, ধলেশ্বরীতে ৮৮৬টি, তুরাগ নদে ৬৬১টি এবং শীতলক্ষ্যা নদীতে ৪৬৮টি অবৈধ স্থাপনার কথা উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।

ঢাকার বাইরে করতোয়ায় ৮০৭, কক্সবাজারের বাঁকখালীতে ২১৮, গোমতীতে ২ হাজার ১২০টি, পার্বত্য জেলার সাঙ্গুতে ৩৩৩ স্থাপনাসহ বিভিন্ন নদ–নদীতে অবৈধ স্থাপনা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় দখলদারদের তালিকা বাদ দিচ্ছে। সিএস খতিয়ানের সঙ্গে পানি আইনের সাংঘর্ষিক কোনো কিছু নেই। ২০২৩ সালে এসে শুনতে হচ্ছে, অবৈধ দখলদারদের নাম প্রকাশ করা যাবে না। তাহলে কমিশন কার নাম প্রকাশ করবে?