আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে ঢাকা ওয়াসা বোর্ড। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হওয়ার কথা। কিন্তু বোর্ডের এই সিদ্ধান্তে সন্তুষ্ট নয় ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। আবাসিকে ২৫ শতাংশ এবং বাণিজ্যিক সংযোগে ১৯ শতাংশ পর্যন্ত পানির দাম বাড়াতে চায় তারা। এ জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগে প্রস্তাব পাঠিয়েছে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ।
বর্তমানে ঢাকা ওয়াসার আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ১ হাজার লিটার পানির জন্য দাম দিতে হয় ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। ওয়াসার নতুন প্রস্তাব কার্যকর হলে ১ হাজার লিটার পানির জন্য ১৯ টাকা খরচ করতে হবে। অন্যদিকে বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম বর্তমানে ৪২ টাকা। ওয়াসার নতুন প্রস্তাব অনুযায়ী, বাণিজ্যিক সংযোগে পানির দাম দিতে হবে ৫০ টাকা।
সবশেষ গত ৬ জুলাই ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সভায় পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছিল। বর্তমান মূল্যস্ফীতির কথা বিবেচনায় রেখে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের সদস্যরা সর্বসম্মতিক্রমে ওই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। উৎপাদন ও পরিচালন ব্যয় বৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়ে তখনই পানির দাম ২০ শতাংশ বাড়ানোর পক্ষে ছিলেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান।
আইন অনুযায়ী, প্রতিবছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়াতে পারে ঢাকা ওয়াসা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এ ক্ষেত্রে ওয়াসা বোর্ডের অনুমোদন নিতে হয়। আর ৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি করতে চাইলে নিতে হয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন। আবাসিকে পানির দাম ১৯ টাকা ও বাণিজ্যিকে ৫০ টাকা করার জন্য এখন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন চেয়েছে ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে ৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিবের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এতে বলা হয়, পরিচালনা ব্যয় এবং বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকার (ডিএসএল) পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমান পানির দামে ওয়াসার পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ এবং ডিএসএল পরিশোধ দুরূহ হয়ে পড়েছে। ঋণের টাকা পরিশোধ এবং ব্যয়ভার বহন করতে পানির বিশেষ মূল্যবৃদ্ধি প্রয়োজন। তবে বস্তি এলাকার বাসিন্দাদের জন্য লো ইনকাম কমিউনিটি (এলআইসি) পানির দাম অপরিবর্তিত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম ওয়াসা পানির দাম আবাসিকে ৩৮ শতাংশ এবং বাণিজ্যিকে ১৬ শতাংশ বাড়িয়েছে। চট্টগ্রাম ওয়াসাও পানির দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধের বিষয়টি সামনে এনেছে।
বোর্ড ৫ শতাংশ পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিলেও ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ কেন আরও বেশি দাম বাড়াতে চাচ্ছে, জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার বোর্ড চেয়ারম্যান গোলাম মোস্তফা গত রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান পানির দাম আরও বাড়াতে সরকারের কাছে গেছেন। এখন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। তবে পানির দাম বেশি বাড়ালে জনগণের ওপর চাপ বাড়বে, অন্যদিকে অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধিতে সরকার বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে—এই দুটি দিক বিবেচনায় ওয়াসা বোর্ড ৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর পক্ষে ছিল।
কয়েক মাস ধরে দফায় দফায় নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষ কষ্টে আছে। করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংকটে রয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা ওয়াসা গত দুই বছরে দুবার আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৪ বছরে ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বেড়েছে ১৫ বার।
পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খানের বক্তব্য জানতে তাঁর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। কিন্তু রিং হলেও সাড়া দেননি তিনি। পরে সংস্থাটির উপপ্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক প্রথম আলোকে বলেন, পানির দাম ৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধির বিষয়টি তাঁর জানা নেইবর্তমানে ঢাকা ওয়াসার সাতটি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। বিপুল ঋণ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে ঢাকা ওয়াসাকে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে। ওয়াসার চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ঋণের সুদ ও আসলের কিস্তি পরিশোধ করতে হয়েছিল ২০১ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা বেড়ে হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা।
এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পানি সরবরাহ) মো. খাইরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষের দেওয়া প্রস্তাবটি যৌক্তিক কি না, সেটি দেখা হবে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
ঢাকা ওয়াসা দৈনিক যত পানি উৎপাদন করে, তার ২০ শতাংশের বেশি গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছায় না। কাগজে-কলমে ওয়াসার এই সিস্টেম লসের (কারিগরি অপচয়) আর্থিক পরিমাণ ২৪০ কোটি টাকার বেশি। শুধু এ অপচয় কমাতে পারলেই বছর বছর ওয়াসাকে পানির দাম বাড়াতে হতো না। ঢাকা ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নিজেদের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়মের দায় জনগণের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ঢাকা ওয়াসা সেবামূলক মনোবৃত্তিতে নেই বলে মনে করেন নগরবিদদের সংগঠন ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বড় প্রকল্পের মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানো এবং পানির দাম বাড়িয়ে মুনাফা করাই তাদের উদ্দেশ্য। ওয়াসার অদক্ষতার দায় জনগণকে কেন টানতে হবে, সরকারের উচিত এই জবাবদিহি চাওয়া।