২০১২ সালে বাংলাদেশে কাজ শুরু করে গাজপ্রম ২০টি কূপ পেয়েছে। সব কটি দরপত্র ছাড়া।
দ্রুত উত্তোলন বাড়াতে গাজপ্রমকে কাজ দেওয়া হচ্ছে, যুক্তি কর্মকর্তাদের।
বিনা দরপত্রে আরও পাঁচটি গ্যাস উত্তোলনের কূপ খননের কাজ পেতে যাচ্ছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রম। ভোলায় সরকারি সংস্থা বাপেক্স যে গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে, সেখানে এই কূপ খননের সুযোগ পেতে পারে তারা।
শুধু কূপ খনন নয়, গ্যাস অনুসন্ধানের কাজও পেতে পারে গাজপ্রম। এ নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে সরকারের।
বিনা দরপত্রে কাজ দেওয়া হয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের অধীনে, যেটি দায়মুক্তি আইন নামে পরিচিত। অন্যদিকে বাপেক্সের বদলে গাজপ্রমকে দিয়ে কূপ খনন করালে সরকারের দ্বিগুণ খরচ পড়বে।
ভোলায় এখন পর্যন্ত তিনটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করেছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রডাকশন কোম্পানি (বাপেক্স) শাহবাজপুর, ভোলা নর্থ ও ইলিশা। এর মধ্যে শাহবাজপুর ও ভোলা নর্থে দুটি করে কূপ খনন করা হবে।
এই চারটি কূপ হলো উন্নয়ন কূপ, যা গ্যাস উত্তোলন শুরুর জন্য খনন করা হয়। এর বাইরে ওই দুটি গ্যাসক্ষেত্রের মাঝামাঝি একটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে। গাজপ্রমকে এ পাঁচটি কূপের কাজ দেওয়ার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হচ্ছে।
ভোলায় বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে আরও পাঁচটি কূপ খনন করবে রাশিয়ার কোম্পানি গাজপ্রম।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন—পেট্রোবাংলা ও বাপেক্স সূত্র বলছে, দ্রুত গ্যাস উত্তোলন বাড়াতে তিন বছরে ৪৬টি কূপ খননের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। বাপেক্স একা এসব কূপ খনন করতে গেলে ১০ বছরের বেশি সময় লাগার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বাপেক্সের পাশাপাশি গাজপ্রমকে কাজ দেওয়া হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়, কূপ খননের প্রস্তুতির জন্য বাপেক্সের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য নিয়েছে গাজপ্রম। তারা এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে শিগগিরই একটি দরপ্রস্তাব দেবে। এরপর দর নিয়ে বাপেক্স সমঝোতা করে পেট্রোবাংলাকে জানাবে। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সবকিছু পর্যালোচনা করে গাজপ্রমকে কাজ দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত করবে। সব মিলিয়ে দুই মাস সময় লাগতে পারে।
বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শোয়েব প্রথম আলোকে বলেন, দেশে জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস দরকার। বাপেক্সের সব খননযন্ত্র কাজে আছে, কোনোটি বসে নেই। দ্রুত গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে সমান্তরালভাবে গাজপ্রমকে দিয়েও কূপ খনন করা হচ্ছে।
বাপেক্স সূত্র বলছে, একটি কূপ খননে সর্বোচ্চ ৮০ কোটি টাকা খরচ করে তারা। অন্যদিকে সর্বশেষ ২০২০ সালে তিনটি কূপ খননের কাজ পেয়ে গাজপ্রম প্রতিটির জন্য নিয়েছে ১৮০ কোটি টাকার বেশি। গাজপ্রম সব কূপ খননের কাজ পেয়েছে দরপত্র ছাড়া।
নানা বিবেচনায় দরপত্র ছাড়াও অনুসন্ধানের কাজ দেওয়া যেতে পারে। তবে বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কূপ খনন মোটেই যৌক্তিক নয়।বদরূল ইমাম, ভূতত্ত্ববিদ
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, বাপেক্সের সক্ষমতা শতভাগ ব্যবহার করার পাশাপাশি ঠিকাদার নিয়োগ করা হচ্ছে। গাজপ্রমের সঙ্গে দর নিয়ে সমঝোতার জন্য শিগগিরই একটি কমিটি করা হবে। চুক্তি হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। দরপত্র ছাড়া কাজের বিষয়ে তিনি বলেন, দ্রুত গ্যাস সরবরাহ বাড়াতেই বিশেষ আইনে চুক্তি করা হচ্ছে। তবে সবকিছু যাচাই-বাছাই করেই দর চূড়ান্ত করা হবে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনটি করা হয় ২০১০ সালে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই আইনে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে কাজ দেওয়ায় ব্যয় বেশি পড়ে, যার দায় চাপে সাধারণ ভোক্তার ওপর। অন্যদিকে আমদানিতে নজর থাকায় দীর্ঘদিন দেশে গ্যাস কূপ খনন বাড়াতে নজর ছিল না।
বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়া ও মার্কিন ডলার-সংকটের কারণে এখন আমদানি কঠিন হয়েছে। তাই দ্রুত সরবরাহ বাড়ানোর কারণ দেখিয়ে বিনা দরপত্রে কূপ খননের কাজ দেওয়া হচ্ছে। আরেকটি অভিযোগ হলো, বিনিয়োগ করে বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়ানোর বদলে বিদেশি কোম্পানিকে কাজ দেওয়ার ঝোঁক রয়েছে সরকারের।
দেশে জরুরি ভিত্তিতে গ্যাস দরকার। বাপেক্সের সব খননযন্ত্র কাজে আছে, কোনোটি বসে নেই। দ্রুত গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে সমান্তরালভাবে গাজপ্রমকে দিয়েও কূপ খনন করা হচ্ছে।বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মো. শোয়েব
বাংলাদেশে এক দশক ধরে ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে গাজপ্রম। ২০১২ সালে তারা প্রথম ১০টি কূপ খননের কাজ পায়। এরপর সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ২০। এবার তারা সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে (গ্যাস ভাগাভাগি) গ্যাস অনুসন্ধানে নামছে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে পেট্রোবাংলা ও বাপেক্সের সঙ্গে আলাদা দুটি সমঝোতা স্মারক সই করে গাজপ্রম। এর আওতায় গ্যাস অনুসন্ধানে চুক্তি হওয়ার কথা। সেই চুক্তি করার বিষয়ে এখন আলোচনা চলছে।
দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করার জন্য উৎপাদন অংশীদারত্ব চুক্তি (পিএসসি) আছে। এর আওতায় উত্তোলিত গ্যাসের একটি অংশ পায় সরকার, বাকিটা কোম্পানি। কোম্পানির ভাগের গ্যাস আবার নির্দিষ্ট দামে সরকারই কিনে নেয়। সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য নতুন করে এ চুক্তির খসড়া চূড়ান্তের কাজ চলছে।
গাজপ্রমকে গ্যাস অনুসন্ধানের কাজও দেওয়া হতে পারে দরপত্র ছাড়া, বিশেষ আইনে। তবে বিষয়টি এখনো চূড়ান্ত হয়নি।
পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, বাপেক্সের সঙ্গে সমঝোতা স্মারকের আওতায় ভোলা দ্বীপের গ্যাসক্ষেত্রে গাজপ্রম উন্নয়ন ও অনুসন্ধান কূপ খননের কাজ করবে। আর পেট্রোবাংলার সঙ্গে সমঝোতা স্মারকটি কৌশলগত। এর আওতায় স্থল ও সাগরে গ্যাস অনুসন্ধান করার কথা রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ভোলায় গ্যাস অনুসন্ধানের আগ্রহ প্রকাশ করেছে গাজপ্রম। ভোলা থেকে গ্যাস আনার জন্য পাইপলাইন নির্মাণেরও প্রস্তাব আছে গাজপ্রমের।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, নানা বিবেচনায় দরপত্র ছাড়াও অনুসন্ধানের কাজ দেওয়া যেতে পারে। তবে বাপেক্সের আবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্রে বিদেশি ঠিকাদার নিয়োগ দিয়ে কূপ খনন মোটেই যৌক্তিক নয়। এতে খরচ হবে দ্বিগুণের বেশি। এটা জাতীয় স্বার্থেরও বিরোধী। তিনি বলেন, কষ্ট করে বাপেক্স গ্যাস আবিষ্কার করেছে, উৎপাদন কূপ করা তো কোনো ব্যাপারই না তাদের জন্য। যত বেশি কূপ খনন করবে, ততই দক্ষ হবে বাপেক্স।