গবেষণা বলছে, ২০১৯ সালে মানুষের ব্যয় হয়েছিল ৪৫০ কোটি টাকা। গবেষকদের ধারণা, এবার হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।
আয়ানের বয়স ৫ মাস ২০ দিন। ছয় দিন আগে ওর ডেঙ্গু ধরা পড়েছে। দুই হাসপাতাল ঘুরে এখন ওর চিকিৎসা চলছে রাজধানীর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে (শিশু হাসপাতাল)।
আয়ানের বাবা হাফিজুর রহমানের চিন্তা ছেলের চিকিৎসার খরচ চালাবেন কী করে, ঢাকায় থাকা-খাওয়ার ব্যয়ই বা কীভাবে মেটাবেন।
হাফিজুর রহমানের বাড়ি মাদারীপুর জেলার শিবচরে। গত সপ্তাহে একমাত্র সন্তান আয়ানের জ্বর হয়। তিন দিনে জ্বর ভালো না হওয়ায় স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে ৫ আগস্ট ঢাকায় এসে মগবাজার এলাকার আদ–দ্বীন হাসপাতালে ছেলেকে ভর্তি করান। ওই দিন স্বাস্থ্য পরীক্ষায় ছেলের ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। কিন্তু ওই হাসপাতালে শিশুদের জন্য রেসপিরেটরি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আরআইসিইউ) না থাকায় আয়ানকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা।
আদ–দ্বীন হাসপাতালে ১০ হাজার টাকার মতো বিল পরিশোধ করে ওই দিন রাতেই আয়ানকে ভর্তি করান মালিবাগের ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। খরচ বেশি হওয়ায় ওই হাসপাতালে আয়ানকে রাখা আর সম্ভব হয়নি। ১০ আগস্ট রাতে আয়ানকে শিশু হাসপাতালে এনে আরআইসিইউতে রাখা হয়েছে। হিসাবের কাগজপত্রে দেখা যায়, মালিবাগের হাসপাতালটিতে ৭১ হাজার ২০০ টাকা বিল পরিশোধ করতে হয়েছে আয়ানের বাবাকে।
আয়ানের মতো বহু ডেঙ্গু রোগী বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় কষ্টে থাকা পরিবারগুলোর কষ্ট আরও বাড়িয়েছে ডেঙ্গু। উল্লেখ্য, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) এক জরিপে গত বছর অক্টোবরে উঠে আসে, ৮৮ শতাংশ মানুষ খাদ্যের চড়া দামকে বড় আঘাত হিসেবে মনে করেন। দ্বিতীয় বড় আঘাত ছিল রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়।
সারা দেশে কত ডেঙ্গু রোগী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তার কোনো পৃথক পরিসংখ্যান নেই। তবে ঢাকা শহরের এ বছর ৪০ হাজার ৭৬৪ জন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ৮৫০ জন বা ৪১ শতাংশ রোগী। অন্যান্য যেকোনো রোগের মতো ডেঙ্গু চিকিৎসার ব্যয়ও বেসরকারি হাসপাতালে অনেক বেশি। এ বছর ডেঙ্গুর পেছনে মানুষের ব্যয় এক হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদেরা।
আয়ানের বাবা হাফিজুর রহমান চিকিৎসা ব্যয় নিয়েই উদ্বেগের কথা বললেন। তিনি বিদেশে থাকতেন। দেশে ফিরে এখন বেকার।
হাফিজুর প্রথম আলোকে বললেন, ছেলের চিকিৎসা খরচ মেটাতে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ইতিমধ্যে আত্মীয়দের কাছ থেকে ধার নিয়েছেন। আরও নিতে হবে। শিশু হাসপাতালের খরচ কত দাঁড়াবে তা তিনি জানেন না। তিনজনের দৈনিক খরচ আছে। মোহাম্মদপুরে যে ছোট্ট একটি কক্ষ ভাড়া নিয়েছেন, তার জন্য দৈনিক ৭৫০ টাকা দিতে হয়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘কীভাবে কী করব, বুঝতে উঠতে পারতেছি না।’
প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, এমন চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে বাসায় রোগী চিকিৎসা বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় গ্রহণযোগ্য বিকল্প চিকিৎসা যা আছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে। মূল লক্ষ্য হবে ঢাকায় যেন রোগী কম আসে, হাসপাতালে যেন কম রোগী ভর্তি হয়।জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল
ধানমন্ডির এক নারী গত ১৫ জুলাই আনোয়ার খান মডার্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হন। ওই নারীর উচ্চ রক্তচাপ ছিল। এর দুই দিন পর তাঁর স্বামীও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ওই হাসপাতালেই ভর্তি হন। স্বামীর ডায়াবেটিসের পাশাপাশি হৃদ্রোগ ছিল। স্বামী-স্ত্রী দুজন ছাড়া পান ছয় দিন পর, গত ২১ জুলাই। স্ত্রীর বিল ছিল ৪৬ হাজার ৬০০ টাকা, স্বামীর ৬৫ হাজার ৩৪ টাকা।
ওই দম্পতির ছেলে একজন কম্পিউটার প্রকৌশলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বাবা-মাকে বাসায় রেখে তিনি ঝুঁকি নিতে চাননি। কিন্তু চিকিৎসার খরচ বড্ড বেশি মনে হয়েছে।
ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয় কমবেশি হওয়ার কারণ আছে। হাসপাতালে অবস্থানকাল বেশি হলে, চিকিৎসায় আইসিইউর ব্যবহার হলে, পরীক্ষার পরিমাণ বেশি হলে, রোগীর অন্য কোনো রোগ থাকলে ব্যয় বেশি হয় বলে একাধিক বেসরকারি হাসপাতাল থেকে বলা হয়েছে। এ ছাড়া কোন ধরনের বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া হচ্ছে, তার ওপরও ব্যয়ের পরিমাণ নির্ভর করে।
একজন গণমাধ্যমকর্মীর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ১১ বছরের মেয়েকে রাজধানীর পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি করা হয় ২ আগস্ট। চিকিৎসার একপর্যায়ে মেয়েটিকে চার দিনের জন্য আইসিইউতে রাখার প্রয়োজন হয়েছিল। তবে মেয়েটি আট দিনের মাথায় ১০ আগস্ট ছুটি নিয়ে বাড়ি যায়। ২৫ হাজার টাকা মূল্য ছাড় পাওয়ার পরও তার চিকিৎসার জন্য মা-বাবাকে হাসপাতালে ২ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯২ টাকা দিতে হয়েছে।
গতকাল শুক্রবার এই প্রতিবেদককে রাজধানীর গ্রিন রোডের গ্রিন লাইফ হাসপাতাল থেকে বলা হয়, সাধারণ শয্যার দৈনিক ভাড়া ৩ হাজার ২০০ টাকা, কেবিন ৮ হাজার ৪০০ টাকা এবং বিশেষ (ডিলাক্স) কেবিনের ভাড়া ১২ হাজার টাকা।
গ্রিন লাইফ হাসপাতাল থেকে কিছু দূর এগিয়ে গেলেই ল্যাবএইড হাসপাতাল। সেখানকার অনুসন্ধান সেবাকেন্দ্র থেকে বলা হয়, সাধারণ শয্যার দৈনিক ভাড়া ৬ হাজার টাকা এবং কেবিনের দৈনিক ভাড়া ১২ হাজার টাকা। ল্যাবএইডের পাশেই গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল। এই হাসপাতালে ভর্তির জন্য দিতে হয় ৫০০ টাকা। দৈনিক শয্যা ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। এই হাসপাতালে দৈনিক কেবিন ভাড়া ৭ হাজার টাকা।
প্রথম আলোর চট্টগ্রাম অফিস জানিয়েছে, বন্দর নগরে ডেঙ্গু নিয়ে বেসরকারি হাসপাতালে চার-পাঁচ দিন থাকলে খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা। আইসিইউতে থাকলে সেই হিসাব আলাদা।
গ্রিন লাইফ হাসপাতাল থেকে কিছু দূর এগিয়ে গেলেই ল্যাবএইড হাসপাতাল। সেখানকার অনুসন্ধান সেবাকেন্দ্র থেকে বলা হয়, সাধারণ শয্যার দৈনিক ভাড়া ৬ হাজার টাকা এবং কেবিনের দৈনিক ভাড়া ১২ হাজার টাকা।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ছয়তলায় নিউরোলজি বিভাগে বেশ কয়েকটি কক্ষ নিয়ে ডেঙ্গু ওয়ার্ড খুলেছে কর্তৃপক্ষ। গতকাল গিয়ে দেখা যায়, একটি কক্ষে কোনো রোগী নেই। একটি কক্ষে অনেক রোগী। একজন রোগীর মা বললেন, তাঁরা রাজধানীর কামরাঙ্গীরচর থেকে এসেছেন চার দিন আগে। হাসপাতালের চিকিৎসা ভালোই। চার দিনে তাঁদের খরচ হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকার মতো।
সরকারি হাসপাতালে সেবা ও ওষুধ বিনা মূল্যে পাওয়ার কথা। তারপরও কিছু ওষুধ বাইরে থেকে কিনতে হয়। কিছু পরীক্ষাও বাইরে থেকে করাতে হয়। হাসপাতালে পরীক্ষা করাতে ভিড় অনেক বেশি।
চিকিৎসক, ওষুধ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, শয্যা ভাড়া—এসব খাতে খরচটা সহজে চোখে পড়ে। তবে এসব খাতের বাইরেও খরচ হয়। ঢাকায় আসতে গাড়ি বা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া দিতে হয়, ঢাকায় থাকার খরচ আছে, খাওয়ার খরচ আছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য দৌড়াদৌড়িতে খরচ আছে। এসব খরচ ধরলে একজন ডেঙ্গু রোগীর পেছনে খরচ অনেক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ ও তাঁর সহকর্মীরা ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে ব্যয় নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। তাতে দেখা গিয়েছিল, ঢাকার একটি সরকারি হাসপাতালে একজন ডেঙ্গু রোগীর গড় খরচ ১১ হাজার টাকা। ঢাকার বাইরে থেকে আসা রোগীর সরকারি হাসপাতালে খরচ ২০ হাজার টাকা।
বেসরকারি হাসপাতালকে গবেষকেরা তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করেন। সবচেয়ে দামি বা ক শ্রেণির হাসপাতালে একজন রোগীর গড় খরচ ছিল দুই লাখ টাকা। খ শ্রেণির হাসপাতালে গড়ে খরচ ছিল ৪১ হাজার টাকা। এবং গ শ্রেণির হাসপাতালে খরচ ছিল ২৫ থেকে ২৬ হাজার টাকা।
২০১৯ সালের তুলনায় এখন ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, শয্যা ভাড়া, চিকিৎসকের ফি, যাতায়াত ভাড়া কয়েক গুণ বেড়েছে। ডেঙ্গুর চিকিৎসা খরচও বেড়েছে।
স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘২০১৯ সালের গবেষণার সময় আমরা বলেছিলাম ডেঙ্গুর পেছনে ৪৫০ কোটি টাকা খরচ হয়ে গেছে। আমার এ বছর গবেষণা এখনো শুরু করিনি। তবে আমাদের অনুমিত হিসাব হচ্ছে, এ বছর চিকিৎসা খরচ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।’
এদিকে বাংলাদেশে স্বাস্থ্য ব্যয়ে সরকারের অংশ বছর বছর কমছে। বাড়ছে ব্যক্তির পকেটের ব্যয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস ১৯৯৭-২০২০’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে গত জানুয়ারি মাসে জানায়, ২০২০ সালে ব্যক্তির পকেট থেকে ব্যয় হয়েছে ৬৯ শতাংশ, যা ২০১৮ সালেও ৬৪ শতাংশ ছিল।
সরকারের, বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের আন্তরিকতার অভাব ও অবহেলার কারণে সারা দেশে ডেঙ্গু ছড়িয়েছে এবং কয়েক দিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যাবে। প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা হবে কয়েক লাখ। এঁদের প্রত্যেকেরই চিকিৎসার খরচ আছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের উচিত এই খরচ কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেওয়া। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করার পাশাপাশি স্যালাইনসহ সব ধরনের চিকিৎসাসামগ্রীর সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। ঢাকার বেশ কিছু সরকারি হাসপাতালে শয্যা খালি থাকলেও রোগী না যাওয়ার কারণ নির্ণয় করে সেসব হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালের নজরদারি বাড়াতে হবে, যেন তারা অবস্থার সুযোগ নিতে না পারে।
জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, এমন চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে বাসায় রোগী চিকিৎসা বাড়াতে হবে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় গ্রহণযোগ্য বিকল্প চিকিৎসা যা আছে, তাকে কাজে লাগাতে হবে। মূল লক্ষ্য হবে ঢাকায় যেন রোগী কম আসে, হাসপাতালে যেন কম রোগী ভর্তি হয়।’