আনসার ব্যাটালিয়নকে অপরাধী আটক, তল্লাশি ও মালামাল জব্দ করার ক্ষমতা দেওয়া নিয়ে নিজেদের অসন্তোষের কথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের কাছে আবারও তুলে ধরেছে পুলিশ। তারা বলছে, আনসার ব্যাটালিয়নকে এই ক্ষমতা দেওয়া হলে বিশৃঙ্খলা এবং দুই বাহিনীর মধ্যে বিরোধ তৈরি হতে পারে। অবশ্য আনসার বলছে, এই ক্ষমতা না দেওয়া হলে তাদের দায়িত্ব পালন কঠিন হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মঙ্গলবার দুর্গাপূজার ছুটির মধ্যে পুলিশ ও আনসার কর্মকর্তাদের নিয়ে বৈঠক করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। সূত্র বলছে, সেখানে পুলিশ ও আনসারের অবস্থান উঠে আসে।
‘আনসার ব্যাটালিয়ন বিল, ২০২৩’ সোমবার জাতীয় সংসদে তোলা হয়। এরপর তা তিন দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য সংসদীয় কমিটিতে পাঠানো হয়।
আনসার ব্যাটালিয়ন বিল নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। অনেক কিছুই বলা হচ্ছে, যা আইনে নেই। আরও আলোচনা হবে।—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান
বিলটি সংসদে তোলার আগে গত রোববার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনের নেতৃত্বে ঊর্ধ্বতন ২৫ জন কর্মকর্তা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে দেখা করে তাঁদের আপত্তির কথা জানিয়েছিলেন। এ সময় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন ও পুলিশ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন।
রোববারের বৈঠকের পর মঙ্গলবার পুলিশ ও আনসারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকটি প্রায় পৌনে চার ঘণ্টা ধরে চলে। শুরু হয়েছিল বেলা তিনটায়। সূত্র বলছে, বৈঠকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বুধবার দুপুরে আবার বৈঠক হতে পারে। বৃহস্পতিবার সংসদীয় কমিটির বৈঠকে বিলটির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। সরকার সংসদের বর্তমান অধিবেশনেই আইনটি পাস করাতে চায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বৈঠকের পর প্রথম আলোকে বলেন, আনসার ব্যাটালিয়ন বিল নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। অনেক কিছুই বলা হচ্ছে, যা আইনে নেই। আরও আলোচনা হবে। তিনি বলেন, ‘সংসদীয় কমিটির বৈঠকে আলোচনার পর একটা সমাধানে পৌঁছাতে পারব বলে আশা রাখছি।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, প্রস্তাবিত আইনের কিছু শব্দ বাদ দিয়ে সমন্বয় করা হবে।
আনসার ব্যাটালিয়ন আইন, ২০২৩–এর খসড়ার ৮ নম্বর ধারায় ব্যাটালিয়ন সদস্যের এখতিয়ার ও ক্ষমতা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত আইনের ৭ নম্বর ধারার ‘কার্যাবলি সম্পাদনকালে, কোনো ব্যাটালিয়ন সদস্য তাহার সম্মুখে সংঘটিত অপরাধের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার অনুমোদনক্রমে অপরাধ সংঘটনকারীকে আটক করিয়া অবিলম্বে পুলিশের নিকট সোপর্দ করিবে এবং ক্ষেত্রমত, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট অথবা এতদুদ্দেশ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার নির্দেশক্রমে উক্ত আটক ব্যক্তির দেহ তল্লাশি, কোনো স্থানে প্রবেশ ও তল্লাশি এবং মালামাল জব্দ করিতে পারিবে।’
কার্যাবলি কী কী, তা উল্লেখ করা হয়েছে ৭ নম্বর ধারায়। কাজগুলো হলো সরকারের নির্দেশে জননিরাপত্তামূলক কাজ, দুর্যোগ মোকাবিলা, গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার নিরাপত্তা, গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নিরাপত্তা, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনায় সহায়তা, সরকারি সম্পত্তি ও জনস্বার্থে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের চাহিদা অনুযায়ী দায়িত্ব পালন, সশস্ত্র বাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশকে সহায়তা দেওয়া এবং সরকার অর্পিত অন্য যেকোনো দায়িত্ব পালন।
বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীতে তিন ধরনের সদস্য রয়েছেন—ব্যাটালিয়ন আনসার, আনসার বাহিনী ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী। ব্যাটালিয়ন আনসার পরিচালিত হয় ১৯৯৫ সালের আইন দ্বারা।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর (ভিডিপি) সদর দপ্তর থেকে একটি প্রস্তাব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। তাতে আইন সংশোধন করে ব্যাটালিয়ন আনসারের ক্ষমতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। তবে পুলিশের আপত্তির কারণে প্রস্তাবটি এত দিন আটকে ছিল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ ও আনসার সূত্রে জানা গেছে, বুধবারের অনির্ধারিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুন, আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম আমিনুল হক, পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মো. মনিরুল ইসলাম, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান হারুন অর রশিদ ও ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি সৈয়দ নুরুল ইসলাম। এতে পুলিশ ও আনসারের কর্মকর্তারা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। আনসারের পক্ষ থেকে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরা হয়। সেখানে কোন কোন আইনে আনসার ব্যাটালিয়নকে কী কী দায়িত্ব ও ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তা উপস্থাপন করেন আনসার কর্মকর্তারা। তাঁরা বলেছেন, আনসার ব্যাটালিয়নকে যেসব দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, তা পালন করতে সন্দেহভাজন ব্যক্তিকে আটক ও তল্লাশি করার এখতিয়ার দরকার।
আনসারের উপস্থাপনার শেষ কথা হিসেবে বলা হয়, কিছুটা দায়িত্বের আওতায় না এনে মৃত্যুদণ্ড/যাবজ্জীবন সাজার বিধান রেখে আইনটি তৈরি করা হলে ব্যাটালিয়নের ভেতরে শান্তির চেয়ে চাপা অশান্তির সৃষ্টি হবে। উল্লেখ্য, প্রস্তাবিত আইনে বিদ্রোহের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড/যাবজ্জীবন সাজার কথা বলা হয়েছে।
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আইন প্রয়োগের জন্য একাধিক বাহিনীকে সহাধিকারক্ষেত্র দেওয়া হলে পারস্পরিক ভুল–বোঝাবুঝি ও দায়বদ্ধতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতভেদসহ নানাবিধ সমস্যা এবং আন্তবাহিনীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হতে পারে। কোনো প্রতিষ্ঠানে পুলিশ তল্লাশি চালাতে গিয়ে দেখল সেখানে আনসার সদস্যরা একই কাজ করছেন। তখন এ নিয়ে দুই বাহিনীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেবে।
বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. আসাদুজ্জামান বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সামনে আমলযোগ্য অপরাধ করলে তাকে বিনা পরোয়ানায় আটক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সুতারাং নতুন করে আটক করার ক্ষমতা দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী আনসার ব্যাটালিয়নকে জব্দ তালিকা প্রস্তুত, তল্লাশি ও স্থাপনায় প্রবেশ করার ক্ষমতা দেওয়া হলে আইনি জটিলতা তৈরি হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের আপত্তির কারণে প্রস্তাবিত আইনে অপরাধীকে আটক, দেহ তল্লাশি ও মালামাল জব্দের ক্ষমতা দেওয়ার কথা সরাসরি রাখা না–ও হতে পারে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির সামনে আমলযোগ্য অপরাধ সংঘটিত হলে তিনি অপরাধীকে বিনা পরোয়ানায় আটক করতে পারেন। এই ধারা অনুযায়ী আনসারকে ক্ষমতা দেওয়া হতে পারে।