‘দেশে ছাত্ররাজনীতির অতীত গৌরবোজ্জ্বল। এখন তা অভিশাপে পরিণত হয়েছে। এই কলুষিত ছাত্ররাজনীতির কারণে হানাহানি, মারামারি ও শিক্ষাঙ্গনে অস্থিরতা। সন্তানকে কষ্টার্জিত টাকায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াচ্ছি। সেখানে কলুষিত ছাত্ররাজনীতি ঢুকুক, তা আমরা চাই না।’
এই বক্তব্য বেসরকারি স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের বাবা ব্যবসায়ী শাহাব উদ্দীনের। তিনি প্রথম আলোকে আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবিদাওয়া নিয়ে কাজ করার কথা থাকলেও তা না করে ছাত্রনেতারা এখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের ব্যানার ব্যবহার করে নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থ উদ্ধারে ব্যস্ত।
শাহাব উদ্দীনের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা সেখানে ছাত্ররাজনীতি ‘ঢোকানোর চেষ্টা’ নিয়ে উদ্বিগ্ন। তাঁদের প্রশ্ন, ছাত্ররাজনীতির নামে যে হানাহানি হয়, সেটা কি এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রবেশ করবে?
শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের এই উদ্বেগ তৈরি হয়েছে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করতে শুরু করায়। সম্প্রতি ১৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংগঠনিক কমিটি ঘোষণা করে ছাত্রলীগ। এর মধ্যে নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, ব্র্যাকসহ ১২টি বিশ্ববিদ্যালয় রাজধানীতে অবস্থিত। অন্য চারটি ঢাকার বাইরের।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের জন্য প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত বলে আমরা মনে করি। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ছাত্ররাজনীতিকে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা করছে। তাদের উদ্দেশে বলব, ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করে দয়া করে জঙ্গিবাদকে প্রশ্রয় দেবেন না।’
বিএনপির ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আলাদা করে কমিটি নেই। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল নামে একটি ইউনিট কমিটি রয়েছে। ছাত্রদল শিগগিরই বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা করে কমিটি ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাকিবুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দায় পুরোপুরি ছাত্রলীগের। তাদের অপকর্মের কারণেই সেখানে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে শঙ্কা তৈরি হয়েছে।
যোগাযোগ করা হলে তিনটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনজন শিক্ষক প্রথম আলোকে নিজেদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। তাঁদের একজন ইউল্যাবের উপাচার্য ইমরান রহমান। তিনি বলেন, ‘ছাত্ররাজনীতি এই মুহূর্তে কোনো সুফল বয়ে আনবে বলে মনে করি না৷ ইউল্যাবে রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন আমরা অ্যালাউ (অনুমোদন) করি না। কিন্তু আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের গভর্ন্যান্সে (পরিচালনা) শিক্ষার্থীদের ভূমিকা রাখা বা নীতিনির্ধারণে প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার পরিকল্পনা করছি, যাতে আমরা তাঁদের আরও ভালো সেবা দিতে পারি।’
কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ ইতিমধ্যে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়ে তাদের আনুষ্ঠানিক অবস্থান জানিয়েছে। এগুলো হলো ব্র্যাক, নর্থ সাউথ, ইস্ট ওয়েস্ট, এআইইউবি ও আইইউবিএটি। আরও তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রথম আলোকে তাঁদের ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার কথা জানিয়েছেন।
বেসরকারি ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘১৯৯০ সালের পর থেকে দলীয় ছাত্ররাজনীতি দেশের জন্য কোনো উপকার বয়ে আনেনি বলে আমরা মনে করি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের সঙ্গে একমত হবে না৷ তারা সবাই যে ভালো চলছে, তা মনে হয় না৷ ছাত্ররাজনীতি বন্ধ রাখার পেছনে এটি একটি বড় কারণ। তিনি বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময়ই বলা হয়েছিল, এটি হবে অরাজনৈতিক। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় তো ভালোই চলছে।
ঢাকার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত কি না, সেই প্রশ্ন রয়েছে। সেখানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে তা চালু করার উদ্দেশ্য কী? তিনি আরও বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও কি ছাত্রনেতারা ৫ বছরের পড়াশোনা ১৪ বছর ধরে করতে চান, শিক্ষার্থীদের দিয়ে জোর করে মিটিং-মিছিল করাতে চান, দলবাজি করতে চান, মারামারি করতে চান?
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক হিসাব বলছে, ২০২০ সাল থেকে গত মাস আগস্ট পর্যন্ত ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সংঘর্ষে ৬ জন নিহত ও ২২০ জন আহত হয়েছেন। একই সময়ে ছাত্রলীগের সঙ্গে অন্য রাজনৈতিক দল, তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘাতে ৩ জন নিহত ও ৫২০ জন আহত হয়েছেন।
বেসরকারি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির এক ছাত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি কলেজগুলোতে ছাত্রলীগের নিজেদের মধ্যে হানাহানি প্রায় নিয়মিত ঘটনা। অন্য ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গেও প্রায়ই তারা সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে চাঁদাবাজি নিয়েও দ্বন্দ্ব বাধে। এই নেতিবাচক রাজনীতি এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে রপ্তানি করার পাঁয়তারা হচ্ছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। তিনি বলেন, এর বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আরও জোরালো অবস্থান নেওয়া উচিত।
দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে ১০৮টি। এতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিন লাখের বেশি। শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা বলছেন, প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ আছে। পড়াশোনার পরিবেশ নির্বিঘ্ন।
সরকারি দলের ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন না এনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই রাজনীতির প্রবেশকে বিপজ্জনক বলছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্ররাজনীতি থাকা খুব জরুরি বলে আমি মনে করি। কিন্তু দলীয় রাজনীতির কারণে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খেসারত দিচ্ছে এবং এই রাজনীতির মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধঃপতন ছাড়া আর কিছুই হচ্ছে না।’
ছাত্ররাজনীতির নামে অপরাজনীতির কারণে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) আবরার হত্যার ঘটনা সামনে আনছেন শিক্ষক ও অভিভাবকেরা।
শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি শুরু করার পক্ষে নন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, একসময় ছাত্ররাজনীতির যে আদর্শিক চরিত্র (দেশের প্রয়োজনে মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলা) ছিল, তা এখন থাকলে কোনো আপত্তি ছিল না৷ কিন্তু এখনকার দলীয় রাজনীতির রূপটা খুব আকর্ষণীয় নয়। আদর্শ হারিয়ে ছাত্ররাজনীতি এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও নেতাসর্বস্ব হয়ে গেছে। তিনি আরও বলেন, বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যেসব খবর পাওয়া যায়, সেখানে কিছু ভয়ের ছবিও পাওয়া যায়। এই রাজনীতির চর্চাটা সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়াটা খুব দরকার বলে মনে হয় না।