হত্যা মামলায় হাইকোর্টে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল। যাবজ্জীবন সাজা ১৮৫ জনের।
বিস্ফোরক মামলার ১,৩৪৪ সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ২৫৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ।
পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় করা দুই মামলার একটি (হত্যা মামলা) এখন আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে। অপর মামলাটি (বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা) বিচার শেষ হয়নি। এখনো মামলাটি বিচারিক আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
হত্যা মামলা আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা এখন বিচারিক আদালতের গণ্ডি পার হয়নি।
আজ থেকে ১৪ বছর আগে ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিডিআরের (বর্তমান নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি) সদর দপ্তর পিলখানাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ হয়। পিলখানায় নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার হন বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদসহ ৫৭ জন সেনা কর্মকর্তা। মোট নিহত হন ৭৪ জন। দুই দিনব্যাপী ওই বিদ্রোহে নিষ্ঠুর আচরণ ও পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন বিডিআরের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব পালনরত অনেক কর্মকর্তা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা।
ওই ঘটনায় ২০০৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দুটি মামলা হয়। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৮৫০ জনকে আসামি করা হয়। দেশের ইতিহাসে আসামির সংখ্যার দিক থেকে এটি সবচেয়ে বড় মামলা। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে ১৫২ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১৬০ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ২৫৬ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। খালাস পান ২৭৮ জন। রায়ের আগে মারা যান চারজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ের পর দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে ২০৬ জন আসামি পৃথকভাবে ৫৩টি আপিল ও লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে আবেদন) করেছেন। অন্যদিকে হাইকোর্টের রায়ে খালাস পাওয়া এবং সাজা কমা ৮৩ আসামির বিষয়ে ২০টি লিভ টু আপিল করেছে রাষ্ট্রপক্ষ। এসব আপিল ও লিভ টু আপিল এখন শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, তারা আপিলের সারসংক্ষেপ তৈরি করে এ মাসের শুরুতে সংশ্লিষ্ট শাখায় জমা দিয়েছে। আসামিপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ এখনো জমা দেয়নি।
মামলার পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে একাধিক আইনজীবীর ভাষ্য, আপিল দায়েরের পর সাধারণত সংক্ষুব্ধ পক্ষ অপর পক্ষকে আপিলের সারসংক্ষেপ সরবরাহ করে থাকে। লিভ টু আপিলের ক্ষেত্রে আদালতে শুনানি হয়ে থাকে। সংক্ষুব্ধ পক্ষের লিভ টু আপিল মঞ্জুর হলে নিয়মিত আপিল হিসেবে তা রূপান্তরিত হয়। এসব প্রক্রিয়া শেষে মামলা প্রস্তুত হওয়া সাপেক্ষে শুনানি হবে।
হত্যা মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ের পর আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) হাইকোর্টে অনুমোদনের জন্য আসে। ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর শুনানি শেষে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেন। হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় ২০২০ সালের জানুয়ারিতে প্রকাশিত হয়। রায়ে ১৩৯ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া হয় ১৮৫ জনকে এবং বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয় ২২৮ জনকে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত তোরাব আলীসহ বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত ২৮৩ জন খালাস পান। হাইকোর্টের রায়ের আগে ১৫ জনসহ সব মিলিয়ে ৪৪ জন আসামি মারা যান।
রায় প্রকাশিত হওয়ার পর রায়ের বিরুদ্ধে ২০২০ সালে রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক লিভ টু আপিল করে। ২০২১ ও ২০২২ সালে আসামিপক্ষ পৃথক আপিল ও লিভ টু আপিল করে।
এ মামলা সম্পর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, আসামিপক্ষ আপিলের সারসংক্ষেপ জমা না দেওয়ায় শুনানির কার্যক্রম এগোচ্ছিল না। তাই আসামিপক্ষের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপক্ষ আবেদন করেছে। এই আবেদন যখন আদালতে আসবে, তখন সারসংক্ষেপ দাখিলের জন্য আসামিপক্ষকে সময় নির্ধারণ করে দেওয়ার আরজি জানানো হবে। সারসংক্ষেপ পেলে আপিলগুলো পর্যালোচনা করা হবে। এই প্রক্রিয়াগুলো শেষ করে চলতি বছরই মামলার শুনানি শুরু করতে পারবেন বলে আশা করছেন রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা।
এই মামলায় হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ড বহাল সৈয়দ তৌহিদুল আলমসহ (তৎকালীন বিডিআরের ডিএডি) দণ্ডপ্রাপ্ত তিন শর বেশি আসামির আইনজীবী ছিলেন মো. আমিনুল ইসলাম। মঙ্গলবার তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগামী মাসের মধ্যে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁদের চেষ্টা থাকবে।
বিস্ফোরক আইনে করা মামলার বিচার ১৪ বছরেও শেষ হয়নি। এ মামলায় ১ হাজার ৩৪৪ জন সাক্ষীর মধ্যে এ পর্যন্ত ১৩৬ কার্যদিবসে ২৫৭ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। আগামী ২৭ ও ২৮ ফেব্রুয়ারি সাক্ষ্য গ্রহণের পরবর্তী দিন ধার্য রয়েছে। বিচারকাজ চলছে পুরান ঢাকার বকশীবাজারে আলিয়া মাদ্রাসাসংলগ্ন মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে। এ মামলায় আসামি ৮৩৪ জন। তাঁদের মধ্যে ৪২ জন ইতিমধ্যে মারা গেছেন। ১৯ জন এখনো পলাতক। বাকি ৭৭৩ আসামি কারাগারে আছেন।
এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের অন্যতম কৌঁসুলি মোশাররফ হোসেন কাজল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতি মাসে চার দিন করে শুনানি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ২৫৭ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। এখন ১৬৪ ধারায় আসামিদের জবানবন্দি গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের সাক্ষ্য চলছে। চলতি বছর মামলার কার্যক্রম শেষ হবে বলে আশা করেন তিনি।
আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, হত্যা মামলায় উচ্চ আদালতে খালাস পেয়েছেন এমন অনেকে বিস্ফোরক আইনের মামলার আসামি। আবার হত্যা মামলায় যাঁদের ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হয়েছে, তাঁদের সাজাভোগ শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু বিস্ফোরক মামলায় আসামি থাকায় কারাগারে আছেন। হত্যা মামলায় খালাস ও সাজাভোগ শেষ হওয়া আসামির সংখ্যা পাঁচ শতাধিক। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় জামিন না হওয়ায় তাঁরা মুক্তি পাচ্ছেন না।
বিস্ফোরক আইনের মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি চান আসামিদের স্বজনেরাও। এক আসামির বড় ভাই কামরুল হাসান মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই আতিকুর রহমান (তৎকালীন বিডিআরের সিপাহি) ২০০৯ সাল থেকে কারাগারে। তিনি হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে খালাস পেয়েছেন। তিনি বিস্ফোরক মামলারও আসামি। এ মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হলে নিরপরাধ কেউ থাকলে সে-ও মুক্তি পাবে।
এই দুটি মামলার বাইরে পিলখানাসহ বিভিন্ন স্থানে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় বাহিনীর নিজস্ব আইনে বিচার হয়, যা সামারি ট্রায়াল (সংক্ষিপ্ত বিচার) নামে পরিচিত। তাতে ১০ হাজার ৯৭৩ জনের বিভিন্ন ধরনের সাজা হয়। এর মধ্যে ৮ হাজার ৭৫৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। বাকিরা প্রশাসনিক দণ্ড শেষে আবার চাকরিতে যোগ দেন। এ ছাড়া সারা দেশে বিশেষ আদালত গঠন করে বিচার করা হয়। বিশেষ আদালতে ৫৭টি মামলায় ৫ হাজার ৯২৬ জন জওয়ানের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড হয়।
২০০৯ সালে বিদ্রোহ ও হত্যাযজ্ঞের সেই ঘটনার পর বাংলাদেশ রাইফেলসকে (বিডিআর) পুনর্গঠন করা হয়। ২০১১ সালের ২৩ জানুয়ারি থেকে সীমান্তরক্ষী এই বাহিনীটির নাম হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।