জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের মূল ভেন্যুতে জলবায়ু অর্থসংক্রান্ত প্যানেল আলোচনায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল জার্মানিতে
জার্মানির মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনের মূল ভেন্যুতে জলবায়ু অর্থসংক্রান্ত প্যানেল আলোচনায় ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল জার্মানিতে

অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে জলবায়ু তহবিলে অর্থ দিন

প্যানেল আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানান। 

অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করে সেই অর্থ জলবায়ু তহবিলে দেওয়ারও আহ্বান জানান তিনি। এ সময় প্রধানমন্ত্রী ছয় দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল শুক্রবার মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে (এমএসসি) যোগ দেন। গতকাল রাতে এমএসসির মূল মঞ্চে আয়োজিত ‘ফ্রম পকেট টু প্ল্যানেট: স্কেলিং আপ ক্লাইমেট ফাইন্যান্স’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন তিনি।

প্যানেল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থহীন অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে এবং এর পরিবর্তে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তহবিল সংগ্রহের জন্য সম্পদের সংস্থান করা দরকার। আমাদের মনে রাখতে হবে যে মানবতার অস্তিত্ব যখন হুমকির মুখে পড়বে, তখন সংকীর্ণ স্বার্থ রক্ষার পথ অনুসরণ করলে তা কোনো সুফল বয়ে আনবে না।’

ছয় প্রস্তাবের প্রথম প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সঠিক পথের জন্য জলবায়ু অর্থায়নের বরাদ্দ ছাড় করার সঠিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। উন্নত দেশগুলোকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি মেনে চলতে হবে। তিনি বলেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ জলবায়ু তহবিলের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করতে হবে। বৈজ্ঞানিক তথ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে তা বছরে ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি হতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলেন, বিশ্বকে যুদ্ধ ও সংঘাত, অবৈধ দখলদারত্ব এবং নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকদের বিশেষ করে নারী ও শিশুদের নির্মম হত্যাকাণ্ড থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে, যা গাজা ও অন্যত্র বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করছেন। তিনি বলেন, নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব সংশ্লিষ্ট অঞ্চলগুলো থেকে অনেক দূরেও পড়ছে। 

তৃতীয় প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলাবায়ুর প্রভাব প্রশমন ও অভিযোজনের জন্য অর্থায়নের তীব্র ভারসাম্যহীনতা দূর করার জন্য অভিযোজন অর্থায়নের বর্তমান পর্যায় অন্তত দ্বিগুণ করা প্রয়োজন।

এ লক্ষ্যে, অভিযোজনে সহায়তার জন্য বাংলাদেশকে ১০০ কোটি ইউরো দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্য তিনি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁকে ধন্যবাদ জানান।

চতুর্থ প্রস্তাবে শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যমান আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থপ্রাপ্তি সুগম করার জন্য দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত সমস্যার সমাধান করতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী তাঁর পঞ্চম প্রস্তাবে বলেন, বৈশ্বিক অর্থায়নের ব্যবস্থাপনায় সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষ করে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর ঋণের বোঝা দূর করতে তাদের জন্য অনুদান ও সুবিধাজনক ঋণ লাভের সুযোগ বাড়ানোর মাধ্যমে অর্থপূর্ণ ফল দেখাতে হবে।

সর্বশেষ ও ষষ্ঠ প্রস্তাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জলবায়ু কর্মসূচির জন্য বেসরকারি পুঁজিপ্রবাহের জন্য সরকারগুলোকে সঠিক পরিকল্পনা, নীতি ও ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এসব প্রকল্পের জন্য বেসরকারি পুঁজি আকৃষ্ট করার জন্য উদ্ভাবনী, মিশ্র অর্থায়নের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তিনি বলেন, ‘এটি সুস্পষ্ট যে বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ ছাড়া জলবায়ু অর্থায়নের বিপুল পরিমাণ ঘাটতির কার্যকর সমাধান করা যাবে না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, তিনি ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে কপ-১৫ চলাকালে শেষ মুহূর্তের সমাধান খুঁজে বের করার লক্ষ্যে নেতাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে অংশ নিয়েছিলেন। তখন বুঝতে পেরেছিলেন যে আন্তর্জাতিক জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করা বেশ কঠিন হবে। দেশে ফিরে যাওয়ার পর তিনি স্থানীয়ভাবে অভিযোজন প্রকল্প গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে এখন স্থানীয়ভাবে পরিচালিত জলবায়ু অভিযোজনের একটি পরীক্ষাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ এ পর্যন্ত ৪৮ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে প্রায় ৮০০ প্রকল্প বাস্তবায়িত করেছে, সব কটিই নিজস্ব সম্পদ থেকে। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি অবশ্যই বাংলাদেশকে “লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ডের” সহায়তার প্রথম প্রাপক হিসেবে দেখতে চাই।’ বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণে আমাদের অবদান নগণ্য (বৈশ্বিক নির্গমনের ০.৪৭%-এর কম) হলেও আমাদের দেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে সপ্তম স্থানে রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ধারণা করা হয়, এখন থেকে ২০৫০ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের বার্ষিক জিডিপির ক্ষতি হবে ২% এবং এই হারে ২১০০ সালের মধ্যে ক্ষতি হবে ৯% পর্যন্ত। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি ৩৩ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হতে পারে।’

এই প্যানেল আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের জলবায়ুবিষয়ক বিশেষ দূত জন কেরি, বার্বাডোজের প্রধানমন্ত্রী মিয়া মোটলে ও মালদ্বীপের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুসা জমির।

এর আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল হোটেল বেইরিশার হফের কনফারেন্স হলে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ ছাড়া তিনি ডেনমার্কের প্রধানমন্ত্রী মেটে ফ্রেডেরিকসেন এবং কাতারের প্রধানমন্ত্রী আবদুল রহমান আল-থানির সঙ্গে বৈঠক করেন। 

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেটা গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্সের প্রেসিডেন্ট নিক ক্লেগ, বিশ্বব্যাংকের ডেভেলপমেন্ট পলিসি অ্যান্ড পার্টনারশিপের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পরিচালক অ্যাক্সেল ভ্যান ট্রটসেনবার্গ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুসের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিতে তিন দিনের সরকারি সফরে গত বৃহস্পতিবার মিউনিখ পৌঁছান। টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর এটি তাঁর প্রথম বিদেশ সফর।