দেশে মানবাধিকার পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে দাবি করেছে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ)। বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থাটি বলছে, নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা ও রাজনীতিতে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার খর্ব হচ্ছে। আজ শুক্রবার গণমাধ্যমে পাঠানো এমএসএফের বার্ষিক পর্যবেক্ষণে এ দাবি করা হয়।
এমএসএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সুলতানা কামাল স্বাক্ষরিত পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার, সর্বোপরি মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কার্যত কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি; বরং প্রায় সব ক্ষেত্রে মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও সভা–সমাবেশে বাধা দেওয়া হয়েছে, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধ হয়নি, সাংবাদিক নির্যাতন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা এবং পুলিশ হেফাজত ও কারা হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে।
গায়েবি মামলা ও গ্রেপ্তারকে অন্যতম উদ্বেগের বিষয় উল্লেখ করে পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গত ২২ আগস্ট থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিএনপির নেতা–কর্মীদের বিরুদ্ধে ৩১২টি ‘কথিত গায়েবি মামলা’ হয়েছে। এসব মামলায় ৮ হাজার ৪৮৬ জনকে এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে এবং ২৫ হাজার ১১৫ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। গ্রেপ্তার করা হয়েছে বিএনপির ১ হাজার ৩০৯ নেতা–কর্মীকে। বিএনপির মহাসচিবসহ উচ্চ পর্যায়ের অনেক নেতা গ্রেপ্তার রয়েছেন এবং তাঁরা জামিনও পাচ্ছেন না। এখনো গ্রেপ্তার অব্যাহত রয়েছে। এর ফলে নাগরিকের বাক্স্বাধীনতা ও রাজনীতিতে নিজস্ব মতামত প্রকাশ করার অধিকার খর্ব হচ্ছে।
বিরোধী দলের নেতা–কর্মী ও সমর্থকদের সভাস্থলে যাওয়া বাধাগ্রস্ত করতে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নানান কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়েছে দাবি করে বলা হয়েছে, পুলিশ বাহিনী সরকারদলীয় সংস্থায় পরিণত হয়েছে কি না, এমন প্রশ্ন এখন সর্বত্র।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেআইনি, অসাংবিধানিক ও ফৌজদারি অপরাধ, যা কখনোই সমর্থনযোগ্য নয় উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার ভূমিকা রাখলেও ‘ক্রসফায়ার’ বা বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ঘটনা সরকার অস্বীকার করে আসছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও এমএসএফের সংগ্রহ করা তথ্যের বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ২২টি ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যাতে ১ জন নারী, ১২ জন যুবক ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) ১ জন কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন একজন সেনা ও তিনজন র্যাব সদস্য। গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন ১ জন নারী ও ১৩ জন যুবক।
সাংবাদিকতা ও মত প্রকাশের অধিকার সম্পর্কে বলা হয়েছে, সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে এ বছরের চিত্র ছিল অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং গত বছরের তুলনায় এ বছর সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে। এ বছর পেশাগত দায়িত্ব পালনে মহিউদ্দিন নাঈম নামের একজন সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। ২৬৬ সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩৯ জন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ২১ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, যার মধ্যে পুলিশ ২০ জন। এ ছাড়া এ বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৮২টি মামলা হয়েছে ও এসব মামলার গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৭৭ জনকে। অন্যদিকে নির্বাচনী সহিংসতায় ২০২২ সালে ৫০ জন নিহত হয়েছেন, যার মধ্যে ২ জন শিশু রয়েছে এবং সহিংসতায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ১ হাজার ৫৪১ জন।
সংখ্যালঘু নির্যাতন সম্পর্কে বলা হয়েছে, ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ ৭৮টি ঘটনায় নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২টি মন্দিরে আগুনসহ ২২টি উপাসনালয়ের মূর্তি ভাঙচুর, ২টি মন্দিরের দানবাক্স লুট, ১১টি বাড়িতে আক্রমণ, ভাঙচুর ও লুটপাট ও আগুন লাগিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এমএসএফের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনটি তৈরি করতে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে এবং প্রায় প্রতিটি ঘটনাই স্থানীয় হিউম্যান রাইটস ডিফেন্ডারদের মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে।
পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজনৈতিক বিক্ষোভকারীদের দমনে অতিরিক্ত বল প্রয়োগ না করে মানবিক ও সংবেদনশীল ভূমিকা পালন করা, কথিত গায়েবি মামলা দায়ের ও এ–সংক্রান্ত মামলায় গ্রেপ্তার করা থেকে বিরত থাকা এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা করাসহ বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে।