সন্তান জন্ম দিতে হাসপাতালে মায়ের মৃত্যু সবাইকে চিন্তায় ফেলেছে। কারণ জানা জরুরি হয়ে পড়েছে।
দেশের তিনটি জেলায় অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের সময় ১৬ জন মায়ের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ফেব্রুয়ারি–মার্চে হাসপাতালে এসব মৃত্যু হয়েছে। হঠাৎ এই ধরনের মৃত্যুতে মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা চিন্তিত। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, ঘটনাগুলো দুর্ভাগ্যজনক।
চট্টগ্রামে হাসপাতালে মারা গেছেন আটজন। হাসপাতালগুলো হলো চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিটি করপোরেশন মেমন মাতৃসদন হাসপাতাল এবং মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতাল। সিলেটে তিনজন মায়ের মৃত্যু হয়েছে ইবনে সিনা হাসপাতালে। কুমিল্লায় হাসপাতালে মারা গেছেন পাঁচজন। হাসপাতালগুলো হলো পপুলার হাসপাতাল, মুক্তি হাসপাতাল ও মেডি কেয়ার হাসপাতাল।
চট্টগ্রামে হাসপাতালে মারা গেছেন আটজন। সিলেটে মারা গেছেন তিনজন। কুমিল্লায় মারা গেছেন পাঁচজন।
স্ত্রীরোগ ও মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের সংগঠন অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান গতকাল বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘হাসপাতালে মানুষ নিরাপদ প্রসবের জন্য আসে। আমরা চিন্তিত এই কারণে যে পরপর বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটল হাসপাতালেই। মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যাচ্ছে না। আমরা কিছু সাধারণ লক্ষণের কথা জানতে পেরেছি। তবে প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান জরুরি হয়ে পড়েছে। এই মৃত্যু অচিরেই বন্ধ করার পদক্ষেপ নিতে হবে।’
স্বাস্থ্য বিভাগ দুই দশকের বেশি সময় ধরে হাসপাতাল, ক্লিনিক বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সন্তান প্রসবের ব্যাপারে সাধারণ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে। সব সময় দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পাওয়া যায় না বলে বাড়িতে সন্তান প্রসবে মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। দিন দিন বাড়িতে সন্তান প্রসব কমছে এবং হাসপাতাল, ক্লিনিক ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে প্রসব বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাব বলছে, এখন ৩৩ শতাংশ সন্তান প্রসব হয় বাড়িতে। কিন্তু হাসপাতালে এসে মৃত্যুর এই ঘটনা মানুষের মধ্যে সেবাকেন্দ্রে আসার ব্যাপারে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন।
অবিলম্বে জাতীয় কমিটি করে ঘটনার অনুসন্ধান করতে হবে, জাতীয় নির্দেশনা তৈরি করতে হবে। মায়ের জীবন রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করার উদ্যোগ নিতে হবে।অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ, জনস্বাস্থ্যবিদ
গত বুধবার ওজিএসবির জাতীয় সভায় চট্টগ্রাম, সিলেট ও কুমিল্লার বেসরকারি হাসপাতালে মাতৃমৃত্যুর ঘটনা আলোচনা হয়। ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন প্রবীণ মাতৃস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা তো মানা যায় না যে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে হাসপাতালে মা মারা যাবে। হাসপাতালের তো পূর্ণ প্রস্তুতি থাকার কথা। ঘটনা তো একটি হাসপাতালের নয়; বেশ কয়টি হাসপাতালের। এতগুলো হাসপাতালে একই ঘটনা কী করে ঘটল, তার অনুসন্ধান জরুরি।’
চিকিৎসকদের একটি সূত্র বলছে, এর আগে ২৫ মার্চ সকালে একই বিষয় নিয়ে চট্টগ্রামে একটি অনানুষ্ঠানিক সভা হয়। এই সভায় অবেদনবিদ, স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ ও শল্যবিদেরা উপস্থিত ছিলেন। তারপর ওই দিন বিকেলে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনের সভাপতিত্বে আরও একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি সভায় মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে জোর দেওয়া হয়।
হাসপাতালে মানুষ নিরাপদ প্রসবের জন্য আসে। আমরা চিন্তিত এই কারণে যে পরপর বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটল হাসপাতালেই। মৃত্যুর সুনির্দিষ্ট কারণ জানা যাচ্ছে না।অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান, অবস্টেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সভাপতি
গত দেড় মাসে চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজন, মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে তিনজন এবং সিটি করপোরেশন মেমন মাতৃসদন হাসপাতালে একজন প্রসূতি মারা গেছেন বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে। অস্ত্রোপচারের পর জটিল হয়ে পড়া আরও দুই প্রসূতি এখন নগরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু কেন সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারের পর রোগী মারা যাচ্ছে, এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, অন্য অস্ত্রোপচারের রোগীদের এই সমস্যা হচ্ছে না। যেসব রোগী মারা গেছে, তাদের বেশির ভাগেরই কিডনি ফেইল করেছে।’
সিভিল সার্জন জানান, ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চারজন রোগীর অবস্থা জটিল হয়ে পড়ে। উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পর তাঁরা মারা যান।
রীমা আকতার ৪ ফেব্রুয়ারি, পপি আকতার ৮ ফেব্রুয়ারি, রেহেনা আকতার ১৮ মার্চ এবং ফারজানা আকতার ১৯ মার্চ মারা যান।
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ফরিদার পাড়ার বাসিন্দা রেহেনা আকতার (২৭) ১৬ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রসবব্যথা নিয়ে ভর্তি হন। ওই দিন দুপুরে অস্ত্রোপচারে একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। কিন্তু সন্ধ্যা থেকে রোগীর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। রাতভর অসহ্য যন্ত্রণায় ছটফট করেন ওই রোগী। পরদিন দুপুরে সংকটাপন্ন অবস্থায় রেহেনাকে নগরের ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
শুধু কেন সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারের পর রোগী মারা যাচ্ছে, এই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ, অন্য অস্ত্রোপচারের রোগীদের এই সমস্যা হচ্ছে না।মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী, চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন
রেহেনার স্বামী ইলিয়াস চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন ন্যাশনাল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়, তখনই তাঁর (স্ত্রী) অবস্থা খুব খারাপ। সাদা কাগজের একটা ছাড়পত্র নিয়ে ওখানে আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। তখন চিকিৎসকেরা জানান, রেহেনার কিডনি নষ্ট হয়ে গেছে। পরে ডায়ালাইসিস করা হয়। কিন্তু অবস্থা আরও খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে লাইফ সাপোর্টে নেওয়া হয়। ১৮ মার্চ বেলা আড়াইটার দিকে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতাল আমার রোগী মেরে ফেলেছে।’
ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সন্তান জন্মে অস্ত্রোপচারের পর সুমাইয়া তারিনের (১৯) কিডনি বিকল হয়ে পড়ে। তিনি এখন বেসরকারি পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গতকাল দুপুরে হাসপাতালে ওই রোগীর সঙ্গে কথা হয়। তিনি এক দিন আইসিইউতে ছিলেন। এখন তাঁর সপ্তাহে তিন দিন কিডনি ডায়ালাইসিস চলছে।
সুমাইয়ার স্বামী আজিম উদ্দিন বলেন, তাঁরা ১৫ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেলে সুমাইয়াকে ভর্তি করেন। পরদিন অস্ত্রোপচারে কন্যাসন্তান প্রসব করেন সুমাইয়া। এর পরদিন তাঁর অবস্থা খারাপ হতে থাকে। এখানকার চিকিৎসক বলেছেন, কিডনি কাজ করছে না।
এ বিষয়ে জানার জন্য ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেলের পরিচালক আমির হোসেন ও উপপরিচালক আবদুর রাজ্জাক খানকে ফোন করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
চট্টগ্রামে মা ও শিশু হাসপাতালের প্রসূতি মৃত্যুর বিষয়ে হাসপাতালটির পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের এখানে দুই–তিনটা ঘটনা ঘটেছে। কেন ঘটছে, তা খতিয়ে দেখতে আমরা নিজেরা ব্যবহৃত ওষুধ পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছি। তাতে কিছুটা সমস্যা পেয়েছি প্রাথমিকভাবে। বিষয়টি সিভিল সার্জনকে জানানো হয়েছে।’
গত রাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক মঈনুল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের মাতৃমৃত্যুর ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষকে প্রধান করে আট সদস্যের কমিটি করা হয়েছে।
ঘটনাগুলো দুর্ভাগ্যজনক। আমরা প্রাথমিকভাবে জেনেছি যে সব জায়গাতেই প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ অবেদনবিদ, স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ এবং শল্যচিকিৎসক ছিলেন। তাঁরা এতগুলো ভুল করবেন? অন্যদিকে চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের মান নিয়ে কথা উঠেছে। ব্যবহৃত ওষুধ ও স্যালাইনের মান জানতে আমরা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গেও কথা বলেছি।আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
সিলেটে মাতৃমৃত্যুর বিষয়টি জানাজানি হয় ওজিএসবির গত বুধবারের সভায়। গতকাল বৃহস্পতিবার ওজিএসবির সিলেট শাখার সূত্র জানিয়েছে, মার্চ মাসে সিলেটের ইবনে সিনা হাসপাতালে তিনজন প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে অস্ত্রোপচারের পর।
গতকাল সকালে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে ইবনে সিনা হাসপাতালের জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি পরিচালকের নাম–নম্বর দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা অসমাপ্ত রেখে ফোন কেটে দেন। পরে সারা দিন আর ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর কাছ থেকে কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে ওজিএসবির সভাপতি অধ্যাপক ফারহানা দেওয়ান বলেছেন, কুমিল্লার পপুলার হাসপাতালে একটি মাতৃমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এ ছাড়া মুক্তি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর পরিস্থিতি খারাপ হওয়ায় দুজন প্রসূতির উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজধানীর দুটি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
তবে প্রথম আলোর কুমিল্লা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, গত ১৫ দিনে কুমিল্লা শহরের তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর পাঁচজন মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তি হাসপাতালে একজন ও মেডি কেয়ার হাসপাতালে তিনজন। সর্বশেষ ২৬ মার্চ এক মায়ের মৃত্যু হয়েছে পপুলার হাসপাতালে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ঘটনাগুলো দুর্ভাগ্যজনক। আমরা প্রাথমিকভাবে জেনেছি যে সব জায়গাতেই প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ অবেদনবিদ, স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ এবং শল্যচিকিৎসক ছিলেন। তাঁরা এতগুলো ভুল করবেন? অন্যদিকে চিকিৎসায় ব্যবহৃত ওষুধের মান নিয়ে কথা উঠেছে। ব্যবহৃত ওষুধ ও স্যালাইনের মান জানতে আমরা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সঙ্গেও কথা বলেছি।’
গত পরশু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি ওষুধ ব্যবহারের ব্যাপারে চিকিৎসকদের সতর্ক করেছে। মূলত অবেদনবিদেরা ওষুধটি অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর শরীরে প্রয়োগ করেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক প্রথম আলোকে বলেন, ওষুধটির মান নিয়ে সন্দেহ আছে।
ওজিএসবির একাধিক বিশেষজ্ঞ, অবেদনবিদ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্ত্রোপচারের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রসূতির প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়া সাধারণ লক্ষণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ কিডনি অকেজো হয়ে পড়ছে। কারও শ্বাসকষ্ট দেখা দিচ্ছে। প্রায় সবাই মারা গেছেন আইসিইউতে।
জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রসবে অস্ত্রোপচার একটি জীবনদায়ী ব্যবস্থা। সেখানে মায়ের জীবন চলে যাওয়া অত্যন্ত বেদনায়দক এবং একই সঙ্গে গভীর উদ্বেগের বিষয়। অবিলম্বে জাতীয় কমিটি করে ঘটনার অনুসন্ধান করতে হবে, জাতীয় নির্দেশনা তৈরি করতে হবে। মায়ের জীবন রক্ষায় সম্ভাব্য সবকিছু করার উদ্যোগ নিতে হবে।’