মনজুর আহমেদ চৌধুরী চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৮ সালে কর্মজীবন শুরু করেন তিনি।
১৯৭৬ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রাণিবিদ্যায় স্নাতক, ১৯৭৮ সালে স্নাতকোত্তর ও ১৯৮৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। মনজুর আহমেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৫২ সালে মাদারীপুরে। বিশ্ব নদী দিবস উপলক্ষে তাঁর এই সাক্ষাৎকার নিয়েছেন প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি ইফতেখার মাহমুদ।
প্রথম আলো: সরকার তো নদী দখলমুক্ত করাকে গুরুত্ব দিচ্ছে। তাহলে কাজ হচ্ছে না কেন?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: নদী দখলমুক্ত করতে গিয়ে আমাদের অনেক বিব্রতকর ও খারাপ অভিজ্ঞতার মুখে পড়তে হয়েছে। আমরা দেখেছি, শুধু বেসরকারি খাতের প্রভাবশালীরা যে নদী দখল করছে, তা কিন্তু নয়। সরকারি সংস্থাগুলোও নদী দখলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। তারা নিজেরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নদী দখল করছে। আবার প্রভাবশালীদের দখলে সহায়তা করছে। বিশেষ করে জেলা–উপজেলা প্রশাসন ও পৌরসভাগুলোকেও আমরা নদী দখলের সঙ্গে যুক্ত থাকতে দেখেছি। দখলদারদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েও অনেকে দখলে সহায়তা করছে। এ ধরনের পরিস্থিতি বজায় থাকলে নদী দখলমুক্ত করা কঠিন হয়ে যাবে।
প্রথম আলো: এত দিন ধরে বলা হতো, দেশের নদ–নদী রক্ষায় একক কোনো সংস্থা নেই। পানি উন্নয়ন বোর্ড, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ, পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে শুরু করে মৎস্য অধিদপ্তরের নদীর ওপর নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণ আছে। তাহলে নদী রক্ষা কমিশনের কাজ কি শুধু তালিকা তৈরি করা?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: নদীকে একটি জীবন্ত সত্তা ঘোষণা করেছে উচ্চ আদালত। আর দেশের নদ–নদী রক্ষার প্রধান দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে। কিন্তু আমরা হাতে গোনা কয়েকজন কর্মকর্তা–কর্মচারী নিয়ে কাজ করছি। আমরা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কাছে সারা দেশে কাজ করা ও তত্ত্বাবধায়ন করার জন্য জনবল চেয়েছি। কমিশনের ন্যূনতম কাজ করার জন্য ১৪ জন কর্মকর্তা চেয়ে চিঠি দিয়েছি। অনেক কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে কাজ করতে রাজিও আছেন। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ ব্যাপারে সাড়া পাচ্ছি না।
প্রথম আলো: দেশের বড় শহরগুলো ছাড়াও স্থানীয় পর্যায়েও এখন নদী দখল করা হচ্ছে। প্রতিকারের উপায় কী?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: দেশের প্রতিটি উপজেলায় একটি নদী রক্ষা কমিটি আছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা (ইউএনও) এর সভাপতি হিসেবে রয়েছেন। কিন্তু তাঁরা নদী রক্ষায় যতটা না আগ্রহী, তার চেয়ে বেশি তাঁদের নদীর জমি ব্যক্তিমালিকানায় নামজারির ব্যাপারে বেশি তৎপর দেখি। এমনকি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সামনে নদী দখল হলেও তারা দখলমুক্ত করতে ভূমিকা রাখছে না, উল্টো নদী দখলকারীদের নানা সুবিধার বিনিময়ে সহায়তা করছে।
প্রথম আলো: চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ তো সেলিম খানের মতো প্রভাবশালী বালুখেকোর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন। মেঘনা নদী রক্ষায় তিনি সাহসী ভূমিকা রেখেছেন।
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: অঞ্জনা খান মজলিশ অত্যন্ত সাহসী একজন কর্মকর্তা। কিন্তু তিনি সাহস করে নদী রক্ষা করতে গিয়ে উল্টো নিজে বিপদে পড়েছেন। দখলকারী প্রভাবশালী চক্র যে কত শক্তিশালী, তার বড় প্রমাণ হচ্ছে, তিনি তাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার পর তাঁকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছে। ওই জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্বকেও বদলি করা হয়েছে। চাঁদপুরের মৎস্য অধিদপ্তরের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তা অনেক বছর ধরে চাঁদপুরের ইলিশ রক্ষায় ভূমিকা রাখছিলেন। তাঁকেও চিংড়ি গবেষণা কেন্দ্রে বদলি করা হয়েছে। অর্থাৎ নদী রক্ষায় যাঁরা ভূমিকা রাখবেন, তাঁদের এমন সংকেত দেওয়া হলো, যাতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস করে নদী রক্ষায় ভূমিকা না রাখেন। এসব কাজ দেশের নদ–নদী রক্ষায় অশনিসংকেত। এভাবে চলতে থাকলে দেশের কোনো নদী দখলমুক্ত হবে না। উল্টো যেসব জায়গা দখলমুক্ত হয়েছে, তা আবারও দখল হবে।
প্রথম আলো: ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে তো প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছে। ওই নদীগুলোর পানি তো এমনভাবে দূষিত হয়েছে যে সেখানে বেশির ভাগ মাছের পক্ষে বেঁচে থাকা কঠিন। নদী রক্ষার আইন–নিয়ম কি তাহলে শুধু কাগজে–কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে?
মনজুর আহমেদ চৌধুরী: আমরা সরকারের বিভিন্ন মহলের কাছে ২০২৩ সালের মার্চের মধ্যে অন্তত ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করার ব্যাপারে একটি পরিকল্পনা নিয়েছিলাম। দেশের স্বাধীনতার ৫২ বছর ও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশে আমরা ওই নদীগুলোকে রক্ষা করার একটি উদাহরণ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকারি অন্য সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছ থেকে এ জন্য যে ধরনের সমর্থন দরকার, যে পরিমাণে অর্থ ও জনবল দরকার, তার কোনোটাই আমরা পাইনি। তাহলে এ দেশে কীভাবে নদী রক্ষা হবে, এটা এখন আমারও প্রশ্ন।