জাতীয় অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনের লেখা জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স বইটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে বিবেচিত হবে। বইটিতে ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের ধারাবাহিকতা উঠে এসেছে। শুধু যুদ্ধদিনের কথা নয়, বরং যুদ্ধ শুরুর পেছনের গল্প উপস্থাপন করা হয়েছে, যা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের বহুমাত্রিকতা সম্পর্কে জানা যায়।
শনিবার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে বইটির পাঠ উন্মোচনে বক্তারা এসব কথা বলেন। জেনেসিস অব দ্য বাংলাদেশ ওয়ার অব ইনডিপেনডেন্স বইটি প্রকাশিত হয়েছে প্রথমা প্রকাশন থেকে। এই বইয়ের পাঠ উন্মোচন অনুষ্ঠানটি হয়ে উঠেছিল শিক্ষক, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী, আইনজীবীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলা। অতিথিদের পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছিল মিলনায়তন।
ইতিহাসের আলপথে হেঁটে সত্য তুলে এনেছেন আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। বইটিতে লেখক পাকিস্তানের জাতি গঠনে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংকটগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। বাঙালি অর্থনীতিবিদদের দেওয়া দুই অর্থনীতির প্রসঙ্গ যেমন এসেছে, ছয় দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের কথাও আলোচিত হয়েছে এ বইয়ে। বাংলাদেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বের বিভিন্ন দলিল এতে উদ্ধৃত হয়েছে। এর ভিত্তিতে ইতিহাসকে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছেন লেখক।
পাঠ উন্মোচনে আলোচক হিসেবে ছিলেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক মু. সিকান্দার খান, অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক সালমা বিনতে শফিক। সঞ্চালনা করেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক বিশ্বজিৎ চৌধুরী।
অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম লেখকের প্রশংসা করে বলেন, ‘অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় বইটি লেখা হয়েছে। কমপক্ষে ৩০০ বই ও গবেষণাকর্মের আলোচনা বইটিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। বইটি লেখকের সাধনার প্রকৃত পরিচয়। সে জন্য তাঁকে অভিবাদন জানাই।’
ঐতিহাসিক ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনার প্রসঙ্গ টেনে অর্থনীতিবিদ মইনুল ইসলাম বলেন, ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা নিয়ে এ বইতে আলোচনা রয়েছে। এই পরিকল্পনা মহাত্মা গান্ধী মেনে নিয়েছিলেন। তবে জওহরলাল নেহরু ও সরদার বল্লভভাই প্যাটেল দ্বিমত করেন। তাঁরা বলেছিলেন, এটি তাঁরা মানেন না। অতএব দোষটা প্রধানত কংগ্রেসের ওপরই পড়ে। ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনা গৃহীত হলে হয়তো দেশভাগের দরকার হতো না। কংগ্রেস মানতে অস্বীকার করায় ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশনে’র সূচনা হয়। এরপর কলকাতা ও নানা শহরে দাঙ্গা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে দেশভাগ অনিবার্য হয়ে উঠেছিল।
মইনুল ইসলাম বলেন, ‘অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন তাঁর বইয়ের পরিশিষ্টে এই ক্যাবিনেট মিশন পরিকল্পনাটি পুরোপুরি উল্লেখ করেছেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়েছে। কারণ, ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যানে সমাধানের একটি ফর্মুলা ছিল। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ না নেওয়ায় আজ আমরা এ বর্তমান অবস্থায় এসেছি।’
কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক আবুল মোমেন বলেন, পাকিস্তানের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক প্রয়াস এবং সংকটগুলো এই বইতে আলোচিত হয়েছে। প্রখ্যাত অনেক লেখক ও গবেষকের নথিপত্র ও উদ্ধৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। পড়ার সময় পাঠককে ধরে রাখার সমস্ত রসদ রয়েছে এতে।
ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমানের সংযোগ ধরা পড়ে আবুল মোমেনের বক্তব্যে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সৃষ্টির ন্যায্যতা প্রমাণ করতে গিয়ে মুসলিম লীগের নেতারা সব সময় সংকটের মধ্যে ছিলেন। তাঁরা বলার চেষ্টা করেছেন, ভারতবর্ষের মুসলমানরা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের চাপে ছিল। তাই ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। অবশ্য একটা রাষ্ট্র আসলে কীভাবে গঠিত হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। শুধু ধর্মীয় মিল থেকে একটা রাষ্ট্র কি হতে পারে? কারণ, তারা (পশ্চিম পাকিস্তানিরা) আমাদের মুসলমানই মনে করে না। শারীরিকভাবেও তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ মনে করত। আমরা দেখলাম, এটি ফেল করেছে।’
শিক্ষাবিদ মু. সিকান্দার খান বলেন, আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন অত্যন্ত ভালো শিক্ষক ও ছাত্র। তিনি দীর্ঘ পড়াশোনার ও গবেষণার পর অবশেষে বইটি প্রকাশ করেছেন। বর্তমান সময়ের পাঠককে এই বইটি অবশ্যই পড়তে হবে। বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে থেকে যাবে।
অধ্যাপক সালমা বিনতে শফিক তাঁর আলোচনায় বলেন, বইয়ের সাতটি অধ্যায়ের মধ্যে প্রথম ও সপ্তম অধ্যায় যথারীতি ভূমিকা ও উপসংহার। দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম অধ্যায়ে প্রতিফলিত হয়েছে পাকিস্তান রাষ্ট্রটির অসারতা ও অযৌক্তিকতার পক্ষে নানা সাক্ষ্য-প্রমাণ। এসব প্রমাণ পাকিস্তানের ভাঙন নিশ্চিত করেছে।
আলোচনায় অংশ নেওয়ায় সবাইকে ধন্যবাদ জানান অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন। তিনি বলেন, নব্বইয়ের দশকেই তিনি বইটি লিখতে চেয়েছিলেন; কিন্তু সম্ভব হয়নি। অবশেষে প্রথমা প্রকাশন থেকে বইটি বের হলো।