দেশের গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বড় অংশে বিভিন্ন লিঙ্গের মানুষের উপস্থিতির ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রকট। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের মধ্যে মাত্র ১২ থেকে ৩০ শতাংশ খবরে নারী ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব থাকে। এর মধ্যে সংবাদপত্রে ৩০ শতাংশ, টেলিভিশন চ্যানেলে ২৫ শতাংশ এবং অনলাইন পোর্টালে সবচেয়ে কম ১২ শতাংশ খবরে নারী ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর কথা থাকে।
আজ সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দ্য ডেইলি স্টার ভবনে ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড রির্সোসেস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (এমআরডিআই) এবং সুইডেনের ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউট আয়োজিত ‘জেন্ডার ও গণমাধ্যম, বাংলাদেশ’বিষয়ক আলোচনা সভায় এ তথ্য প্রকাশ করা হয়। সভায় তিনটি পৃথক গবেষণার মূল তথ্য উপস্থাপন করেন সাংবাদিক ও গবেষক কুর্রাতুল–আইন–তাহ্মিনা।
সভায় বলা হয়, দেশের অর্ধেকের বেশি জনগোষ্ঠী নারী হলেও তাঁদের কথা কম উঠে আসছে গণমাধ্যমে। বেশির ভাগ সময় নারীকে চিত্রিত করা হয় অসহায় এবং নিপীড়ন ও নির্যাতনের শিকার হিসেবে। অপরদিকে সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নারীর উপস্থিতি অনেক কম। ১৪টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মী মাত্র ১০ শতাংশ এবং নারী প্রতিবেদকের হার মাত্র ৬ শতাংশ।
সভায় বক্তারা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে লিঙ্গভিত্তিক বিষয়ে নিজস্ব নীতিমালা তৈরি, লিঙ্গভিত্তিক সংবেদনশীলতা বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেওয়া, সংবাদ ও সাংবাদিকতায় সব লিঙ্গের সমপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ওপর জোর দেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইডিশ রাষ্ট্রদূত আলেকজান্দ্রা বার্গ ফন লিন্ডে বলেন, স্বাধীন গণমাধ্যম নানা বৈচিত্র্যের মানুষের কথা শোনা, জবাবদিহি তৈরি ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমতা নিশ্চিত করার কথা বলে। সাংবাদিকতার কাজ চ্যালেঞ্জের, এর মধ্যে নারী সাংবাদিকেরা কিছু নির্দিষ্ট বিষয়ে আরও ঝুঁকিতে থাকে। বাংলাদেশে গণমাধ্যমে নারী সাংবাদিকেরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বৈষম্যের শিকার হন। এখানে গণমাধ্যমে ১০ শতাংশ নারী, এর মধ্যে খুব কম সংখ্যকই সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। গণমাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক সমতা নিশ্চিত করতে গণমাধ্যমবিশেষজ্ঞ, বিশিষ্ট নাগরিক ও উন্নয়ন অংশীদারি সংস্থাগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নারীর উপস্থিতি অনেক কম। ১৪টি গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মী মাত্র ১০ শতাংশ এবং নারী প্রতিবেদকের হার মাত্র ৬ শতাংশ।
বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের ওপর গুরুত্ব দিয়ে প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ন্যায্যতা, সাম্যতা ও ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি সাংবাদিকতার মূল উপাদান। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা দীর্ঘদিন খাঁচার মধ্যে ছিল। একটা বড় সমস্যা অধিকাংশ সংবাদমাধ্যমে লিঙ্গভিত্তিক বিষয়ে নীতিমালা নেই। সংবাদমাধ্যমগুলোতে লিঙ্গভিত্তিক সংবেদনশীলতার বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ওপর জোর দেন তিনি।
সভায় তিন বছর ধরে করা তিনটি গবেষণার তথ্য তুলে ধরা হয়, সেগুলো হচ্ছে ‘বাংলাদেশি গণমাধ্যমে নারী ও হিজড়া’, ‘সাংবাদিকতার নীতিনৈতিকতার দিগন্তে জেন্ডার’ এবং ‘জেন্ডার সমতা ও গণমাধ্যমসংক্রান্ত আইন ও নীতি পর্যবেক্ষণ, বাংলাদেশ’। তিনটি গবেষণাতেই নেতৃত্ব দিয়েছেন কুর্রাতুল–আইন–তাহ্মিনা। এর মধ্যে ‘বাংলাদেশি গণমাধ্যমে নারী ও হিজড়া’ গবেষণাটির জন্য ১৫টি মূলধারার পত্রিকা, টেলিভিশন চ্যানেল ও অনলাইন পোর্টালের ৪ হাজার ৫৩০টি সংবাদ বিশ্লেষণ করা হয়। এ বিশ্লেষণে প্রধান খবরে নারী ও হিজড়ার অনুপস্থিতিকে সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা হয়। নারী ও হিজড়াদের উপস্থিতি আছে, এমন খবরগুলো বিশ্লেষণের জন্য বেছে নেওয়া হয়েছিল, তবে দেখা গেছে সেগুলোতেও পুরুষের উপস্থিতিই বেশি।
গবেষণার তথ্য তুলে ধরে আরও বলা হয়, নারীর যে খবরগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোতে সেই নারী হয় গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তি বা কোনো ঘটনার অংশ। সংবাদে নারীর উপস্থিতি হয় বেশির ভাগ সংবাদের বিষয় হিসেবে বা তাঁর অভিজ্ঞতার বর্ণনাকারী হিসেবে। বিশেষজ্ঞ হিসেবে নারীর বক্তব্য খুব কম থাকে। নমুনা হিসেবে নেওয়া খবরে সবচেয়ে বেশি ছিল রাজনীতি ও শাসনসংক্রান্ত। তবে সব ধরনের সহিংসতা ও নির্যাতনের খবরে নারীকে বেশি দেখা গেছে। টেলিভিশন চ্যানেলের ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংবাদ উপস্থাপনায় নারী ও পুরুষের অনুপাত ৯:১১। সাধারণত কম বয়সীদের নেওয়া হয়। মধ্যবয়সী উপস্থাপকদের মধ্যে পুরুষই বেশি।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুইডিশ দূতাবাসের হেড অব ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন মারিয়া স্ট্রিডসম্যান বলেন, নৈতিক সাংবাদিকতা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে মানুষ গণমাধ্যমের ওপর আস্থা রাখতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরীন বলেন, ‘সাংবাদিকতায় নারীর সংখ্যা আগের চেয়ে কমে যাচ্ছে। এটা উদ্বেগজনক। নারীরা সব মাধ্যমের চ্যালেঞ্জ নিতে পারলে সাংবাদিকতায় কেন পারছে না? কারণ গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে কাঠামোগত সমস্যা রয়েছে। জেন্ডার সমতার খবরের এত অনুপস্থিতি কেন সেটাও দেখতে হবে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন-বিএফইউজের সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মনজুরুল আহসান বুলবুল বলেন, গণমাধ্যমে লিঙ্গ ভিত্তিক সংবেদনশীল শব্দ ব্যবহার, নির্যাতনের শিকার নারীর নাম প্রকাশ না করার বিষয়ে গনমাধ্যমে আগের চেয়ে ইতিবাচক অনেক পরিবর্তন হয়েছে। নৈতিকতা ও যথার্থতা মেনে ভালো সাংবাদিকতার চর্চা থাকলে গণমাধ্যমে নারীর সংখ্যাও বাড়বে।
সভায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোতে লিঙ্গভিত্তিক নীতিমালা বিষয়ে বলা হয়, মাত্র ৫টি প্রতিষ্ঠানে জেন্ডার সম্পর্কিত লিখিত নীতিমালা আছে। আরও পাঁচটি প্রতিষ্ঠানে মৌখিক নীতিমালা আছে। সংবাদশিল্পের কক্ষ থেকে নীতি নৈতিকতার মানদণ্ড ঠিক করা ও চর্চা করার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়।
ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের (বিজেসি) চেয়ারম্যান রেজোয়ানুল হক বলেন, সামগ্রিকভাবে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ কম থাকায় নারী বিষয়ে সংবাদ বেশি প্রচার করা কঠিন হয়ে যায়। লিঙ্গভিত্তিক সমতা ও লিঙ্গভিত্তিক সংবেদনশীলতা বাড়াতে গণমাধ্যমকে নিয়মিত পর্যবেক্ষণে রাখা দরকার।
আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন–বিএফইউজের মহাসচিব দীপ আজাদ, সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রের সভাপতি নাসিমুন আরা হক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম, মানবাধিকারকর্মী শিপা হাফিজা, ব্র্যাকের পরিচালক (জেন্ডার কর্মসূচি) নবনীতা চৌধুরী, ফোয়ো মিডিয়া ইনস্টিটিউটের জেন্ডার বিশেষজ্ঞ আগনেটা সোডেরবার্গ জ্যাকবসন, যশোরের গ্রামের কাগজ পত্রিকার সম্পাদক মবিনুল ইসলাম এবং ঢাকা সাব–এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি মামুন ফরাজী।
সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন এমআরডিআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গবেষক ও সাংবাদিক আফসান চৌধুরী।