মুঠোফোনে ইন্টারনেট ডেটার ৩ দিনের প্যাকেজ থাকছে না, যে যুক্তি দিল বিটিআরসি

নতুন নির্দেশিকায় মুঠোফোন ডেটার প্যাকেজসংখ্যা সর্বোচ্চ ৪০ এবং মেয়াদ ৭ দিন, ৩০ দিন ও অসীম (আনলিমিটেড) করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে এটি কার্যকর হবে।

মোবাইল ইন্টারনেট

মুঠোফোনের ডেটার প্যাকেজ নিয়ে দেড় বছরের মাথায় নতুন নির্দেশিকা দিয়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি), যেখানে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত তিন দিন মেয়াদের প্যাকেজ না থাকার কথা বলা হয়েছে।

মুঠোফোন অপারেটরগুলো বলছে, তিন দিনের প্যাকেজ বাদ দেওয়া যৌক্তিক নয়। তবে বিটিআরসি বলছে, তিন দিনে গ্রাহক সব ডেটা শেষ করতে পারেন না। তাই অসন্তোষ তৈরি হয়।

আজ রোববার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বিটিআরসির এক সভায় এসব কথা উঠে আসে। মুঠোফোন অপারেটরগুলোর ডেটা এবং ডেটা–সংশ্লিষ্ট প্যাকেজ–সম্পর্কিত হালনাগাদ করা নির্দেশিকা নিয়ে এ সভার আয়োজন করা হয়।

নতুন নির্দেশিকায় মুঠোফোন ডেটার প্যাকেজসংখ্যা সর্বোচ্চ ৪০ এবং মেয়াদ ৭ দিন, ৩০ দিন ও অসীম (আনলিমিটেড) করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আগামী ১৫ অক্টোবর থেকে এটি কার্যকর হবে।

সভায় ডেটা–সংশ্লিষ্ট প্যাকেজ–সম্পর্কিত নতুন নির্দেশিকা উপস্থাপন করেন বিটিআরসির সিস্টেমস অ্যান্ড সার্ভিসেস বিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাসিম পারভেজ। তিনি বলেন, এই নির্দেশিকা তৈরি করার আগে গত ২৫ মে থেকে ১২ জুন অনলাইনে একটি জরিপ পরিচালনা করা হয়। সেখানে ১ হাজার ৬৭৫ গ্রাহক অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ৬১ দশমিক ৪ শতাংশ ৪০ থেকে ৫০টি প্যাকেজের পক্ষে মত দিয়েছেন। মেয়াদ ৭ ও ৩০ দিন এবং অসীম করার পক্ষে ছিলেন ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রাহক। এ ছাড়া ৩, ৭, ১৫ ও ৩০ দিন এবং অসীম করার পক্ষে ছিলেন ৪১ দশমিক ৩ শতাংশ গ্রাহক।

বিটিআরসি বলেছে, তারা এই নির্দেশিকা প্রণয়ন করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ১৪টি সভা করেছে। অপারেটররা জানিয়েছে, সভাগুলোয় অংশ নিয়ে তারা বিভিন্ন বিষয়সহ তিন দিনের মেয়াদ রাখার পক্ষে মত দেয়।

মেয়াদের চক্র ও প্যাকেজের চক্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে অতিরিক্ত মুনাফা করা। লাভ কমে যাচ্ছে বলেই অপারেটররা তিন দিনের মেয়াদ চাচ্ছে। ব্যবসার একটি সীমা থাকা উচিত। ব্যবসা করতে গিয়ে প্রতারণা করে টিকে থাকা যাবে না।
মোস্তাফা জব্বার, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী

গ্রাহকদের কাছ থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিটিআরসি যে ফলাফল পেয়েছে, তা আজ তুলে ধরে। সেখানে দেখা যায়, দেশে গ্রাহকদের ৬৯ দশমিক ২৩ শতাংশ ৩ দিনের মেয়াদ, ১৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ ৭ দিনের মেয়াদ, ৩ দশমিক ৮২ শতাংশ ১৫ দিনের মেয়াদ এবং ১০ দশমিক ১১ শতাংশ ৩০ দিনের মেয়াদ ব্যবহার করে থাকেন।

গ্রাহক চাহিদার শীর্ষে থাকলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা ডেটার তিন দিনের মেয়াদ বাদ দিয়েছে। এর পক্ষে বিটিআরসির যুক্তি হচ্ছে, অপারেটররা তিন দিনের প্যাকেজে যে পরিমাণ ডেটা দেয়, তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই গ্রাহক ওই সময়ের মধ্যে খরচ করতে ব্যর্থ হন। ফলে গ্রাহক অসন্তুষ্টির সৃষ্টি হয়। তিন দিনের প্যাকেজের সংখ্যা বেশি হওয়ায় এবং সময়সীমা খুব কম হওয়ায় গ্রাহকেরা এই মেয়াদের প্যাকেজ আবার ক্রয় করলে তার অব্যবহৃত ডেটা যুক্ত হবে কি না, তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে যান।

বিটিআরসির জরিপে দেখা যায়, ৫৪ দশমিক ৬ শতাংশ গ্রাহক তিন দিন মেয়াদের প্যাকেজ চান না। সংস্থাটি বলছে, তিন দিনের প্যাকেজে কম মূল্যে বেশি ডেটা অফার করার মাধ্যমে নিম্ন আয়ের ও তরুণ গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করা হয়। কিন্তু তিন দিনের মধ্যে পুরো ডেটা ব্যবহার করতে না পারলে, বিশেষ করে বিদ্যুতের অভাবে মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক না থাকার কারণে অব্যবহৃত ডেটা হারিয়ে যায়। এতে গ্রাহক অসন্তোষের সৃষ্টি হয় এবং গ্রাহক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও হটলাইনে বিটিআরসির কাছে অভিযোগ করেন।

গ্রাহক অসন্তোষ রোধ করতে বিটিআরসি তিন দিন মেয়াদের পরিবর্তে সাত দিনের মেয়াদ নির্ধারণ করেছে। এতে গ্রাহকদের অব্যবহৃত ডেটা হারানোর আশঙ্কা কমে আসবে।

তিন দিন মেয়াদের বিষয়টি শুধু ব্যবসাবান্ধব বিষয় নয়। প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহক তিন দিন মেয়াদি প্যাকেজ ব্যবহার করেন। তাই এটা বাদ দেওয়া যৌক্তিক নয়।
মোহাম্মদ জুলফিকার, মহাসচিব, অ্যামটব

বিটিআরসি বলছে, গ্রাহকের স্বার্থ রক্ষা করা তাদের দায়িত্ব। তাই তারা ডেটা প্যাকেজ নির্দেশিকা হালনাগাদের মাধ্যমে প্যাকেজের সংখ্যা, মেয়াদের ধরন ইত্যাদি পরিবর্তন করেছে।

ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, মেয়াদের চক্র ও প্যাকেজের চক্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে অতিরিক্ত মুনাফা করা। লাভ কমে যাচ্ছে বলেই অপারেটররা তিন দিনের মেয়াদ চাচ্ছে। ব্যবসার একটি সীমা থাকা উচিত। ব্যবসা করতে গিয়ে প্রতারণা করে টিকে থাকা যাবে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মেয়াদ, অসংখ্য প্যাকেজে গ্রাহক বিভ্রান্ত হয়েছেন। নতুন নির্দেশিকা গ্রহণযোগ্য।

তবে তিন দিন মেয়াদের প্যাকেজ বাদ দেওয়াকে যৌক্তিক বলে মনে করে না মুঠোফোন অপারেটরদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব মোবাইল টেলিকম অপারেটরস বাংলাদেশ (অ্যামটব)। সংগঠনটির মহাসচিব মোহাম্মদ জুলফিকার বলেন, ‘তিন দিন মেয়াদের বিষয়টি শুধু ব্যবসাবান্ধব বিষয় নয়। প্রায় ৭০ শতাংশ গ্রাহক তিন দিন মেয়াদি প্যাকেজ ব্যবহার করেন। তাই এটা বাদ দেওয়া যৌক্তিক নয়।’ তাঁর মতে, মানুষের পছন্দকে সীমিত করলে তাদেরই খরচ বাড়বে। মানুষ ডেটা ব্যবহারে কম উৎসাহী হবে, যাতে রাজস্বের ওপরও প্রভাব পড়বে। তাই নির্দেশিকাটি পর্যালোচনা করে পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান তিনি।

বিটিআরসির জরিপ অনুযায়ী, ৯১ দশমিক ২ শতাংশ গ্রাহক চেয়েছিলেন, মেয়াদকালের মধ্যে যেকোনো প্যাকেজ কিনলেই যেন অব্যবহৃত ডেটা যুক্ত হয়। তবে বিটিআরসি বলেছে, এটি অপারেটরদের জন্য ব্যবসাবান্ধব নয়। তাই তারা নতুন নির্দেশিকায় তা রাখেনি। তবে মেয়াদকালে একই প্যাকেজ পুনরায় কিনলে সর্বোচ্চ ৫০ জিবি পর্যন্ত গ্রাহক ব্যবহার করতে পারবেন।

নতুন নির্দেশিকা অনুযায়ী, অপারেটররা একজন গ্রাহককে দিনে সর্বোচ্চ তিনটি প্রমোশনাল এসএমএস দিতে পারবে। প্যাকেজের মেয়াদ শেষ হওয়ার এক দিন আগে গ্রাহককে এসএমএসের মাধ্যমে মেয়াদ শেষ হওয়ার বিষয়ে বার্তা পাঠাবে।

প্যাকেজসংখ্যা ৪০ করার বিষয়ে বিটিআরসি জানিয়েছে, তারা চারটি অপারেটরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখেছে, ২৩ থেকে ৫০টি প্যাকেজ সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। সভায় টেলিটকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে এম হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, তিনি ৪০টির মধ্যে প্যাকেজ বানাতে হিমশিম খাচ্ছেন।

সভাপতির বক্তব্যে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর সিকদার বলেছেন, গ্রাহক না বুঝে তিন দিনের প্যাকেজ রাখার পক্ষে কথা বলেছে। বাস্তবে গ্রাহকদের স্বার্থ বিবেচনার জন্যই তিন দিনের জায়গায় সাত দিন করা হয়েছে। পুনর্বিবেচনার যে কথা উঠেছে, সেটা ভবিষ্যতে প্রয়োজন হলে করা হবে।

সভায় আরও বক্তব্য দেন বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ, গ্রামীণফোনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ইয়াসির আজমান, বাংলালিংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক অস, রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম।