সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ী ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অলিউল্লাহ মোল্লা ২০১৬ সালের ১০ জুলাই পুলিশের ‘ক্রসফায়ারে’ নিহত হন। তাঁর পরিবার বলছে, ওই দিন বিকেলে অলিউল্লাহকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়েছিল পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা–কর্মী। পরদিন সকালে অলিউল্লাহর মৃত্যুর খবর পায় পরিবার।
পুলিশ তখন দাবি করেছিল, ঘটনার দিন রাত সাড়ে তিনটার দিকে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়ার সময় টহলরত পুলিশ অলিউল্লাহকে থামার সংকেত দেয়। তিনি না থেমে উল্টো পুলিশের দিকে বোমা ও গুলি ছোড়েন। তখন পুলিশের পাল্টা গুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়। পরে পুলিশের নথিতে এ ঘটনাকে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ উল্লেখ করে অলিউল্লাহর পরিচয় লেখা হয় ‘সন্ত্রাসী’।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে এমন ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারের’ নামে অন্তত ১ হাজার ৯২৬ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে নিহত হওয়ার এই হিসাব বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। তারা এই পরিসংখ্যান তৈরি করেছে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে।
আমরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের এমন কিছু প্রস্তাব দিতে চাই, যাতে আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।সফর রাজ হোসেন, পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান
এভাবে মানুষ মারার প্রতিটি ঘটনার পর সরকারের তরফ থেকে প্রায় একই রকম গল্প বলা হয়। এসব যে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সেটা শেখ হাসিনা সরকার ও তাঁর প্রশাসন আগাগোড়াই অস্বীকার করে গেছে। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা (এসবি) ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত সাত বছরের ক্রসফায়ারের তথ্য সংরক্ষণ করেছে। এ–সংক্রান্ত তথ্যাদি প্রথম আলোর হাতে এসেছে সম্প্রতি। এতে দেখা যায়, এই সাত বছরেই ‘ক্রসফায়ার’ বা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন ১ হাজার ২৯৩ জন। দেশের এমন কোনো জেলা নেই যেখানে বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেনি। এর মধ্যে অনেক রাজনৈতিক নেতা–কর্মীও রয়েছেন।
এসবির হিসাবে সাত বছরে ক্রসফায়ারে নিহতের যে সংখ্যা বলা হয়েছে, আসকের হিসাবে সেই সংখ্যা আরও ১২০ জন বেশি।
প্রতিটি ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ক্রসফায়ারের সাজানো বর্ণনা উল্লেখ করে মামলা দেওয়া হয়, তাতে নিহত ব্যক্তির সহযোগী হিসেবে আরও অনেককে আসামি করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীর পরিবারগুলো মামলা করার সাহস পেত না। কেউ কেউ আদালতে মামলা করার চেষ্টা করতে গিয়ে হয়রানি ও হুমকি–ধমকির শিকার হয়েছেন।
আট বছর আগে বিএনপি নেতা অলিউল্লাহকে হত্যার পর তাঁর স্ত্রী সালিমাও এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন। তিনি গত ২৮ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার স্বামীকে তুলে নিয়ে নির্যাতন ও গুলি করে মারা হয়। এ নিয়ে যেন কারও সঙ্গে কথা না বলি, মামলা না করি, সে জন্য আমাদের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়। আমার স্বামীর ভাইদেরও গ্রেপ্তার করা হয়।’ সালিমা সেই ঘটনায় গত ২৮ আগস্ট সাতক্ষীরার আদালতে মামলা করেছেন।
দেশে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যার ইতিহাস অনেক পুরোনো। অনেকে বলে থাকেন, স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম ক্রসফায়ারের শিকার হয়েছেন সিরাজ শিকদার। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির ওই ঘটনার যে বর্ণনা তখনকার পুলিশ দিয়েছিল; পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন সরকার আমলেও প্রায় একই ধরনের গল্প বলে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
দেশে ক্রসফায়ারের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ২০০৪ সালে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার আমলে। ওই সময়ে রাজধানীতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তৎপরতা এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের খুনোখুনি ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০০৪ সালের মার্চে সরকার র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) গঠন করে। তখন ঢাকায় পিচ্চি হান্নানসহ কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসী এবং দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কথিত চরমপন্থী সন্ত্রাসীদের একের পর এক ‘ক্রসফায়ারের’ নামে হত্যার মধ্য দিয়ে আলোচনায় আসে র্যাব। একই সময়ে পুলিশও সমানতালে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়েছিল। তাদেরও লক্ষবস্তু ছিল প্রায় একই।
তখন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলো সোচ্চার হলেও সরকার তা আমলে নেয়নি। ‘সন্ত্রাসীদের’ হত্যা করা হচ্ছে—তখনকার সরকার সমর্থক মহল থেকে এমন একটা বয়ান তৈরি করা হয়। এর মধ্য দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ‘ক্রসফায়ার’কে যৌক্তিক হিসেবে তুলে ধরার প্রয়াস ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, ক্রসফায়ারের ক্ষেত্রে শুরুতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লক্ষ্যবস্তু ছিল আলোচিত অপরাধী বা দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীরা। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরোধ, প্রভাবশালীদের নির্দেশনা এবং প্রতিপক্ষকে দমনেও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
‘ক্রসফায়ারের’ মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করার প্রবণতা শুরু হয় মূলত ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর। এসব ঘটনায় জড়িত কর্মকর্তাদের কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে বা অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন। যার একটা বড় নজির ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনা। র্যাব-১১–এর তৎকালীন অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তারেক সাঈদসহ ১১ জন র্যাব সদস্য স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর নুর হোসেনের কাছ থেকে অর্থের বিনিময়ে এসব খুনে জড়ান।
র্যাব গঠনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের গুলি করে হত্যার মাধ্যমে ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি শুরু হয়। তখন মানুষও বাহবা দিতে থাকে। একপর্যায়ে পুলিশও জনপ্রিয় হতে ক্রসফায়ার শুরু করে। এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ট্রিগার হ্যাপি হয়ে যায়।বাহারুল আলম, সাবেক প্রধান, এসবি
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো নিয়ে এসবির তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নিহতদের নামের পাশে পরিচয়ের ঘর রয়েছে। তাতে নিহত ব্যক্তিদের ২৩ ধরনের পরিচয় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে বিএনপি ও জামায়াতের নেতা–কর্মীও রয়েছেন। তবে বেশির ভাগ নামের পাশে ‘সন্ত্রাসী’, ‘দুষ্কৃতকারী’, ‘বন্দুকধারী’ বা ‘অস্ত্রধারী’, ‘মাদক কারবারি’, ‘জলদস্যু’, ‘বনদস্যু’, ‘ডাকাত’, ‘ছিনকাইকারী’, ‘মামলার আসামি’, ‘চরমপন্থী’ ইত্যাদি পরিচয় দেওয়া হয়েছে। অনেক রাজনৈতিক কর্মীকেও এসব পরিচয়ে ক্রসফায়ারে মারা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
উল্লিখিত সাত বছরে ক্রসফায়ারে নিহত ৪৭৭ জনের পরিচয় লেখা হয়েছে মাদক ব্যবসায়ী বা মাদক কারবারি। এরপর সবচেয়ে বেশিজনের (৩০০ জন) পরিচয়ের ঘরে লেখা হয়েছে ডাকাত, রোহিঙ্গা ডাকাত ও ছিনতাইকারী। নিহত ১৪২ জনের পরিচয় ‘সন্ত্রাসী’ লেখা।
এতে ৫ জনকে বিএনপি ও অন্যান্য সংগঠনের সদস্য এবং ৯ জনকে জামায়াত-শিবিরের কর্মী হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে তালিকায় ২০১৭ সালের পর থেকে নিহত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয় আর উল্লেখ করেনি এসবি।
এ ছাড়া জলদস্যু, বনদস্যু ও দস্যু পরিচয়ে ৮৩ জন, দুষ্কৃতকারী পরিচয়ে ৩৩ জন, বিভিন্ন হত্যা মামলার আসামি পরিচয়ে ১৭ জন, অন্যান্য মামলার আসামি পরিচয়ে ১৬ জন, চরমপন্থী পরিচয়ে ১৬ জন এবং অস্ত্রধারী বা বন্দুকধারী পরিচয়ে ৩৮ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। তা ছাড়া ধর্ষক বা ধর্ষণের আসামি পরিচয়ে ৭ জন, মানব পাচারকারী পরিচয়ে ৯ জন ও স্থানীয় সন্ত্রাসী বাহিনী সদস্য পরিচয় দেওয়া হয় ৬ জনের।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৫২ জনের কোনো পরিচয় ক্রসফায়ার–সংক্রান্ত পুলিশের নথিতে উল্লেখ করা হয়নি। এ ছাড়া পাহাড়ি বিভিন্ন সশস্ত্র দল ও সংগঠনের সদস্য পরিচয়ে ৬ জন, চোরাকারবারি পরিচয়ে ৩ জন এবং অপহরণকারী পরিচয় দেওয়া হয়েছে ২ জনের।
তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নিহত এসব ব্যক্তির অনেকে নানা ধরনের অপরাধে জড়িত বা মামলার আসামি এটা যেমন ঠিক, আবার এসবের সঙ্গে জড়িত নয় এমন ব্যক্তিকেও কোনো না কোনো তকমা দিয়ে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করার অভিযোগ রয়েছে।
এমনই একটি ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করেছিল ২০১৮ সালে। ওই বছরের ২৬ মে রাতে কক্সবাজারের টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামুল হক। তিনি টেকনাফ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ক্রসফায়ারে নিহত ব্যক্তিদের নিয়ে এসবির করা তালিকায় তাঁর পরিচয় লেখা হয় ‘মাদক ব্যবসায়ী’।
হত্যা করতে নেওয়ার সময় একরাম তাঁর মেয়েকে ফোন করেছিলেন। সেই কল কাটার আগেই একরামকে গাড়ি থেকে নামিয়ে ক্রসফায়ারের নামে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুরো সময়টায় ফোন কল চালু ছিল। পরে সেই কল রেকর্ড সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তাতে একরাম ও তাঁর মেয়ের শেষ কথা, কান্না, গাড়ি থেকে নামানোর শব্দ, তারপর গুলির শব্দ মানুষকে নাড়া দিয়েছিল।
এ ঘটনাকে ‘ঠান্ডা মাথায় হত্যা’ বলে উল্লেখ করেন একরামের স্ত্রী আয়েশা বেগম। তিনি গত ৩১ অক্টোবর প্রথম আলোকে বলেন, একরামকে হাত বেঁধে গুলি করে হত্যার পর র্যাব বলে বন্দুকযুদ্ধে সে মারা গেছে। ক্ষমতাসীন দলের কর্মী হওয়ার পরও তাঁকে রাজনৈতিক শত্রুতা থেকে মারা হতে পারে বলে ধারণা করছেন তিনি।
আয়েশা আরও বলেন, ‘ক্রসফায়ারের ঘটনায় আমাদের কোনো মামলা, এমনকি জিডিও করতে দেওয়া হয়নি। উল্টো হয়রানি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের দুই গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আমাকে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে কথা বলতেও নিষেধ করেছিলেন।’
ক্রসফায়ারের পুলিশি তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৫৯ জন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে, যা আট বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ার দেওয়া হয়েছে ঢাকা বিভাগে, এখানে নিহত হন ২৯১ জন। এরপরেই রয়েছে খুলনা, সেখানে নিহত ২৬০ জন। এর বাইরে রাজশাহী বিভাগে ১১৬ জন, বরিশাল বিভাগে ২৯ জন, সিলেট বিভাগে ৩৩ জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫৮ জন ও রংপুর বিভাগে ৪৭ জনকে বিচার ছাড়াই গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই সময়ে ৬৪ জেলার প্রতিটিতেই কোনো না কোনো সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জেলা হিসেবে সবচেয়ে বেশি ক্রসফায়ারের ঘটনা কক্সবাজারে। সাত বছরে (২০১৫–২১) এই জেলায় ২২৬ জন নিহত হন পুলিশ, র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যদের ক্রসফায়ারে। জেলা হিসেবে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্রসফায়ারে ঘটনা ঢাকায়; এখানে নিহত ১৫১ জন। তৃতীয় সর্বোচ্চ চট্টগ্রামে ৭০ জন। সবচেয়ে কম ঘটনা শেরপুর, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড়ে। এসব জেলায় সাত বছরে একজন করে নিহত হন।
পুলিশের বিশেষ শাখার নথিতে (২০১৫–২১ সাল) ১ হাজার ৭টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ১ হাজার ২৯৩ জন নিহত হওয়ার তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে ৬৫১টি ঘটনায় পুলিশ ও ২৯৩টিতে র্যাব যুক্ত ছিল। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যুক্ত ছিল ৪৬টি ঘটনায়। ১০টি ঘটনায় পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ইত্যাদি বাহিনী যৌথভাবে অংশ নেয়। বাকি ঘটনাগুলোয় কোস্টগার্ডসহ অন্যান্য বাহিনী যুক্ত ছিল। একটি ঘটনায় কোনো বাহিনীর নাম উল্লেখ করা হয়নি।
ক্রসফায়ারের ঘটনা নিয়ে কথা হয় পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক মো. রেজাউল করিমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কাউকে বিনা বিচারে হত্যার সুযোগ নেই। আমরা সব পর্যায়ের পুলিশ সদস্যদের এই বার্তা দিয়েছি। অতীতের ঘটনাগুলোতে কারও বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলে আমরা তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেব।’
২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্রসফায়ারের ঘটনাগুলো সম্পর্কে ওই সময়ে বিভিন্ন দায়িত্বে থাকা পুলিশ ও র্যাবের মধ্যমসারির পাঁচজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, কাউকে ক্রসফায়ার দেওয়া হয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে অথবা তাঁদের নির্দেশে। র্যাবের ক্ষেত্রে ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) এবং মহাপরিচালক পর্যন্ত এ বিষয়ে জানতেন।
রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বা আলোচিত কাউকে ক্রসফায়ারে দেওয়ার আগে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন নেওয়া হতো।
এ বিষয়ে র্যাবের বক্তব্য জানতে গত বুধবার বাহিনীর মুখপাত্র লে. কর্নেল মুনীম ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। গতকাল রোববার পর্যন্ত কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ২০১৮ সালের বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা অতীতের সব ঘটনাকে ছাড়িয়ে যায়। এটি ছিল একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর। এ বছরের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচন হয়। তার আগে ৪ মে থেকে ‘চলো যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। যদিও এই অভিযানের পরও দেশে মাদকের কারবার কমেনি, বরং বেড়েছিল বলে পরবর্তী সময়ে খবর বের হয়েছিল।
এসবির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩০০টি ক্রসফায়ারের ঘটনায় ৩৫৮ জন নিহত হয়। এর মধ্যে ২০২টি ঘটনায় জড়িত ছিল পুলিশ, ৯৬টিতে ছিল র্যাব, পুলিশের সঙ্গে অন্যান্য বাহিনীর যৌথ অভিযান ছিল একটি এবং বিজিবি ও র্যাবের যৌথ অভিযান ছিল একটি। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ২২৭ জনকে মাদক কারবারি আখ্যা দেওয়া হয়। বাকিদের মধ্যে ৪৬ জনের পরিচয় লেখা হয়েছে ডাকাত বা ছিনতাইকারী।
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামলে সর্বোচ্চ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ঘটনা ঘটে ২০১৯ সালে; ওই বছর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ারের ২৪১টি ঘটনায় ৩০৭ জন নিহত হন।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগ সরকারের টানা দেড় দশকের শাসনামলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে-পরে ক্রসফায়ার বেড়ে যায়।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বছর ১২৮ জন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কথিত ক্রসফায়ারে নিহত হন, যা আগের পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক মৃত্যু। এর আগে নবম জাতীয় নির্বাচনের পর ২০০৯ সালে ক্রসফায়ারে নিহত হন ১২৫ জন। মাঝের বছরগুলোতে ২০১০ সালে ৯৩ জন, ২০১১ সালে ৬২ জন, ২০১২ সালে ৫৮ জন ও ২০১৩ সালে ৪২ জন নিহত হন।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, ক্রসফায়ার ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতিপক্ষকে দমন ও ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির অন্যতম হাতিয়ার। এ জন্য নির্বাচনের আগে-পরে এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটেছে।
বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরে তাদের ৬৫১ জন নেতা–কর্মীকে ক্রসফায়ারের নামে হত্যা করা হয়েছে। আর জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির বলছে, এই সময়ে একইভাবে তাদের ৫০ জনের অধিক নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে ক্রসফায়ারসহ নানা উপায়ে বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষ হত্যা করেছে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নির্মূল ও ক্ষমতা কুক্ষিগত করা এবং নির্বাচনকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া।’
পুলিশের বিশেষ শাখার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ সালে ১২৪ জন, ২০১৬ সালে ১৬৩ জন, ২০১৭ সালে ১৬৪ জন, ২০২০ সালে ১৪৭ জন ও ২০২১ সালে ৩০ জন পুলিশসহ বিভিন্ন বাহিনীর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন।
পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক ইনামুল হক সাগর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বর্তমান পুলিশ প্রশাসন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে না। আমরা চাই প্রকৃত অপরাধীর প্রচলিত আইনে বিচার হোক।’
দেশে–বিদেশে নানা সমালোচনা সত্ত্বেও গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করেনি শেখ হাসিনা সরকার। বরং সরকার নানাভাবে এই ঘটনাগুলোর বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে ২০২১ সালের ১০ ডিসেম্বর ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের’ দায়ে র্যাব এবং এর সাবেক মহাপরিচালক (পরে আইজিপি) বেনজীর আহমেদসহ বাহিনীটির সাবেক ও তখনকার সাত শীর্ষ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র।
এরপর ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড একেবারেই কমে যায়। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৪ জন ও ২০২৩ সালে একজন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্রসফায়ারে নিহত হন।
আগামীতে যেন এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সে জন্য কাজ করছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রধান সফর রাজ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানবাধিকারকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে পুলিশের সংস্কারের কাজ করছি। আমরা বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সংস্কারের এমন কিছু প্রস্তাব দিতে চাই, যাতে আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।’
শেখ হাসিনা সরকারের একপর্যায়ে ক্রসফায়ারের নামে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি মানুষকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে গুম করার ভয়ংকর প্রবণতা শুরু হয়। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের আগ দিয়ে গুমের ঘটনা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। ভুক্তভোগীদের বড় অংশই ছিল বিরোধী দলের নেতা–কর্মী।
বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠনগুলোর হিসাবে শেখ হাসিনা সরকারের তিন মেয়াদে দেশে পাঁচ শতাধিক মানুষ গুমের শিকার হন। পরবর্তী সময়ে অনেকের লাশ পাওয়া যায়। কাউকে কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। কেউ কেউ অনেক পরে ছাড়া পান। গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্বজনদের সংগঠন মায়ের ডাকের হিসাবে এখনো ১৫৮ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। সংগঠনটি নিখোঁজ এই ব্যক্তিদের তালিকা গত ১৮ আগস্ট প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) মহাপরিচালকের কাছে দিয়ে আসে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ, হেফাজতে মৃত্যু ও গুমের ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার দেশে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছিল। আর এটা করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছিল। তারা অনেকটা ‘বন্দুকবাজ’ হয়ে ওঠে বলেও আলোচনা রয়েছে।
এর প্রতিফলন দেখা যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময়ও। তখন আন্দোলন দমন করতে পুলিশ ব্যাপকভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করে। এর ফলে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশ ও থানাগুলো বিক্ষুব্ধ মানুষের আক্রোশের মুখে পড়ে।
পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সাবেক প্রধান বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘একসময়ে কাউকে গুলির কথা বললে আমাদের অন্তরে কাঁপন ধরে যেত। র্যাব গঠনের পর শীর্ষ সন্ত্রাসী ও চরমপন্থীদের গুলি করে হত্যার মাধ্যমে ক্রসফায়ারের সংস্কৃতি শুরু হয়। তখন মানুষও বাহবা দিতে থাকে। পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থা এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়। একপর্যায়ে পুলিশও জনপ্রিয় হতে ক্রসফায়ার শুরু করে। এভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা ট্রিগার হ্যাপি হয়ে যায়।’ তাঁর মতে, এবারের ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের বেপরোয়া গুলির পেছনে গত ২০ বছরের গুলি করার অভ্যস্ততা কাজ করেছে।