‘আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ: আরাফাত ওড়ালেন বাংলাদেশের পতাকা’—গত বছরের ৮ মে প্রথম আলোর একটি শিরোনাম। এই অর্জনটা ছিল ৭ মের।
যুক্তরাষ্ট্রের উটাহ অঙ্গরাজ্যে অনুষ্ঠিত সাঁতার, সাইক্লিং ও দৌড়ের সমন্বয়ে কঠিনতম ট্রায়াথলন আয়রনম্যান প্রতিযোগিতার সর্বোচ্চ আসর আয়রনম্যান ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ সফলভাবে সম্পন্ন করেছিলেন এই বাংলাদেশি ট্রায়াথলেট, উড়িয়েছিলেন লাল-সবুজ পতাকা। আয়রনম্যান মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাতই হলেন প্রথম বাংলাদেশি, যিনি আয়রনম্যানের সর্বোচ্চ আসর ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন এবং চ্যালেঞ্জ সম্পন্ন করেছেন। ৩০ থেকে ৩৪ বছরের বয়সভিত্তিক গ্রুপে আরাফাতের অবস্থান ছিল ৬১তম।
বিশ্বকাপ ফুটবলের মতো আয়রনম্যানের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে প্রতিবারই আলাদা করে নির্বাচিত হতে হয়, কয়েকটি আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আরাফাত ভালো ফল করেন। উটাহর পর মালয়েশিয়া, ভারতসহ কয়েকটি দেশে কয়েকটি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে আরাফাত এ বছরে আয়রনম্যানের দুটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এর একটি অর্ধ দূরত্বের আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, যা ২৬-২৭ আগস্ট ফিনল্যান্ডে অনুষ্ঠিত হবে। পূর্ণ দূরত্বের আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ২০২৩-এ–ও আরাফাত অংশ নেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। এটি হবে ফ্রান্সে, আগামী ১০ সেপ্টেম্বর।
তারুণ্যের জয়যাত্রায় এর চেয়ে আনন্দ সংবাদ আর কী হতে পারে! কিন্তু মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাতের এই দুটি ইভেন্টসহ বার্লিন ম্যারাথন ও আয়রনম্যান মালয়েশিয়ায় অংশগ্রহণ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। মানুষের জন্য কঠিনতম খেলা আয়রনম্যানে আরাফাত একের পর এক সাফল্য দেশের জন্য নিয়ে এলেও তিনি একজন ‘ছা-পোষা চাকুরে’। তাই কর্তৃপক্ষের অনুমিত না মিললে তিনি তো কিছু করতে পারেন না।
মোহাম্মদ সামছুজ্জামান আরাফাত বাংলাদেশ ব্যাংকের উপপরিচালক। বিদেশের মাটিতে যেতে বা কোনো প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাঁর প্রয়োজন হয় ছুটি, কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) ও একটি সরকারি আদেশ (জিও)। তিনি সেটা পাননি।
গতকাল সোমবার রাতে ফেসবুকে আরাফাত তাঁর পেজে লেখেন, ‘আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ও আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপ ডিরেক্ট কোয়ালিফাই করেও অংশগ্রহণ করার জন্য অফিস থেকে এনওসি হলো না। অনেক মানুষ চেষ্টা করেছেন, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সরকারি আদেশও জারি করেছিল। জানি না কেন অনুমতি হলো না। নিজের মধ্যে এত বড় অসহায় এবং হতাশবোধ এর আগে কখনো আসেনি। ছোট একজন মানুষ আমি, অফিসের ডেস্কের বাহিরে কোনো স্বপ্ন দেখা উচিত নয়। সরাসরি নির্দেশনা পেয়েছি চাকরি করে স্পোর্টস করা যাবে না। কোনো আন্তর্জাতিক স্পোর্টসে যাওয়া যাবে না। অফিস ও স্পোর্টস একসঙ্গে চলবে না! অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি দুটি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে কোয়ালিফাই করে। কতগুলো স্বপ্ন! মাত্র তো শুরু হয়েছিল যাত্রাটা। এই অল্প সময়ে থমকে যাবে! বাংলাদেশ ক্ষমা করো! আমি পারলাম না!’
অনুমতি মিলছে না—এ নিয়ে কয়েক দিন ধরে আরাফাত তাঁর হতাশার কথা জানাচ্ছিলেন। দেখা হলেও তাঁর চেহারায় দেখেছি হতাশা। কেননা, আরাফাতের এই যে সাঁতার, সাইক্লিং আর দৌড় নিয়ে নিয়মিত চর্চা, দেশে–বিদেশে সাফল্য—তা অনেক তরুণকে শরীরচর্চা, কঠিনতম ক্রীড়ায় উৎসাহিত করেছে। তাই আরাফাত বারবারই বলেন, ‘আমরা সবে শুরু করেছি। এখানেই থেমে যাব। শুধু অনুমতি না মেলার কারণে।’ আরাফাতকে বলতাম, ‘কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে রাজি করান। আপনি তো শুধু নিজের জন্য এসব প্রতিযোগিতায় যাচ্ছেন না। বাংলাদেশের পতাকাও সঙ্গে নিয়ে যাচ্ছেন। আপনার সাফল্য মানে বাংলাদেশের নাম আন্তর্জাতিক অঙ্গনে উচ্চারিত হওয়া, লাল-সবুজ পতাকা পতপত করে ওড়া।’
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আগে অনুমতি পেতেন বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য। এবার পাচ্ছেন না, ভেবেছি শেষ পর্যন্ত পেয়ে যাবেন। কিন্তু এখনো তাঁর অনুমতি মেলেনি। আরাফাত নিয়ম মেনে সময়মতো কর্তৃপক্ষের কাছে আগস্ট থেকে অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চারটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার জন্য ছুটি ও এনওসি চেয়ে আবেদন করেছেন। সেটি প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।
আরাফাতের সঙ্গে কথা বলে যতটুকু জানি, তাঁর ছুটি পাওনাও আছে। সেই ছুটিও তিনি পেতে পারেন, তবে দেশে থাকতে হবে। বিদেশে খেলার জন্য এনওসি মিলবে না।
আয়রনম্যানে সাফল্যের কারণেই এই ট্রায়াথলেটকে বিশেষ স্নেহ করেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান। তাঁর সঙ্গেও কথা বলেছেন আরাফাত। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় থেকে গত ২ আগস্ট চারটি ইভেন্টে অংশ নিয়ে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার সরকারি আদেশ জারি করা হয়েছে। এই জিওতে মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব এস এম হুমায়ূন কবিরের সই রয়েছে।
কিন্তু এই সরকারি আদেশের পরেও মোহাম্মদ সামছুজ্জামানের কর্মস্থল থেকে এনওসি দেওয়া হয়নি। তাঁকে বলা হয়েছে, এনওসি দেওয়া হবে না। চাকরি আর ক্রীড়া একসঙ্গে নাকি হয় না। অথচ একসময় ব্যাংকসহ অনেক সরকারি প্রতিষ্ঠানে ক্রীড়াবিদ কোটায় চাকরি হতো, অফিসের ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ভলিবলের দল থাকত। আর এখন এসে দাঁড়াল, খেলাই হতে পারে চাকরি হারানোর কারণ!
আরাফাতের মতো একক ক্রীড়ায় যাঁরা অংশ নেন, কিংবা পর্বতারোহণে যান, দেশের পতাকা বিদেশের আসরে ওড়ান, তাঁরা নিজেরা কত কষ্ট করে খরচাপাতি জোগাড় করেন, তা তাঁদের সঙ্গে কথা বললেই জানা যায়। নিজেরা স্পনসর জোগাড় করেন, নিজের উপার্জনের টাকা, ভাইবোন, বন্ধু, পরিবারের কাছ থেকে ধারদেনা করে টাকা জোগাড় করেন, তবু সরকারি কোনো সহায়তা মেলে না এ রকম একক অফট্র্যাকের খেলাধুলার জন্য। কিন্তু তাঁরা সাফল্য নিয়েই দেশে ফেরেন। তখন সবাই বাহবা দেন।
এখন একটু বলি, আয়রনম্যানে আরাফাতদের কী করতে হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ৩ দশমিক ৮ কিলোমিটার সাঁতার, ১৮০ কিলোমিটার সাইক্লিং ও ৪২ দশমিক ২ কিলোমিটার দৌড় সম্পন্ন করতে হয় আয়রনম্যানের প্রতিযোগিতায়। আর এর অর্ধেক দূরত্ব নিয়ে হয় আয়রনম্যান ৭০.৩ প্রতিযোগিতা। আয়রনম্যানের বৈশ্বিক কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন দেশে বছরজুড়ে এই আয়োজন করে। সেগুলোতে ফলাফলের ভিত্তিতে আয়রনম্যান ও আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের জন্য প্রতিযোগী বাছাই করা হয়। আয়রনম্যানের চেয়ে বৈরী পরিবেশে আয়োজিত ট্রায়াথলন ‘হিমালায়ান এক্স–ট্রায়াথলন’ গত মে মাসে সম্পন্ন করেন আরাফাত। এটি হয়েছিল নেপালে, হিমালয় পর্বতমালায়।
আরাফাতের ফেসবুক স্ট্যাটাস পড়ে আজ নিজের ফেসবুকে লিখেছেন ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান। তিনি দীর্ঘ পোস্টে লিখেছেন, ‘ভীষণ মন খারাপ নিয়ে এক তরুণের জন্য লিখছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি। যার জন্য লিখছি, সেই তরুণ বিশ্বের সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশি হিসেবে উড়িয়েছেন লাল-সবুজ পতাকা। নয়বার বাংলা চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন তিনি। দৌড়েছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া। এমন একজন তরুণ, যিনি বিশ্বের মঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা উঁচু করেছেন বারবার, আমলাতন্ত্রের লাল ফিতা তাঁকে আটকে রাখতে চাইছে।... ’ পুরো স্ট্যাটাসে শরিফুল হাসান আরাফাতের বীরত্ব, অর্জন, দেশপ্রেম আর নিজের মন খারাপের কথা লিখেছেন।
মন খারাপ হওয়ার মতোই ঘটনা। মানুষ তো স্বপ্নের চেয়ে বড়। আরাফাত যখন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া দৌড়ে যান, তখন ভিডিও কলে পাশে থাকেন তাঁর স্ত্রী সুমাইয়া। ফোনে থাকে বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবার স্নেহভরা উৎসাহ। এখন মালয়েশিয়া, ভারত বা কাছাকাছি দেশে আয়রনম্যান প্রতিযোগিতায় সঙ্গী সুমাইয়া আর তাঁদের শিশু সন্তান আহিয়াশ। আরাফাতের ঘাম ঝরানো সাফল্যে তাঁরাও আরও বড় কিছুর স্বপ্ন দেখেন। সব প্রতিযোগিতায় বিজয়ের ক্ষণে আরাফাতের শরীরে জড়ানো থাকে বাংলাদেশের পতাকা।
২০২১ সালে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়রনম্যান আরাফাতকে নিয়ে তথ্যচিত্র বানায় প্রথম আলো। কোটি কোটি ভিউ হয় সেটির। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, ঢাকা ও ঢাকার বাইরের তরুণেরা আরাফাতের কীর্তিতে অনুপ্রেরণা পান। ক্রীড়াচর্চায় উৎসাহ পান। দেশের জন্য একজন আরাফাতের এই অবদান কি কম? গত বছর আরাফাতই একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে আয়রনম্যান ও আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নেন। এবার আয়রনম্যান বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ তিনিসহ পাঁচজন অংশ নিচ্ছেন।
আয়রনম্যান ৭০.৩ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে আরাফাত একমাত্র বাংলাদেশি এবার। এর মানে আরাফাত যা সূচনা করেছেন, তা ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে। আমাদের ‘দুবলা’ মানুষেরাও যে লৌহমানব হয়ে উঠতে যাচ্ছেন।
আয়রনি হলো, আয়রনম্যানের যাত্রা যত কঠিন, তার চেয়ে কঠিন বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র।