আম, লিচু, কলা, পেঁপে, পেয়ারা—একটা কাচঘরের মধ্যে তাগড়াভাবে বেড়ে উঠছে। আহ্, কী চমৎকার লাগছে দেশের গাছগুলোকে দেখতে! মনে হচ্ছে যেন ওরা কত আপন, কত দিন পর দেখা হলো এই স্বজনদের সঙ্গে। বিদেশবিভুঁইয়ে নিজের দেশের মানুষ আর গাছপালার সঙ্গে দেখা হওয়া যেন একটুকরো বাংলাদেশেরই মুখ দেখা!
উত্তর আমেরিকার পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের পিটসবার্গ শহরের কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় ও পিটসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশাল-বিস্তীর্ণ চত্বর যেন একটা প্রকৃতিতীর্থ। শেনলি পার্কের মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নানা রকমের ভাস্কর্য আর ইমারতের নান্দনিক স্থাপত্য, জাদুঘর আর বোটানিক্যাল গার্ডেন—সব মিলিয়ে প্রকৃতিপ্রেমী, শিক্ষানুরাগী ও শিল্পরসিকদের এক মহারসাস্বাদনের জায়গা। সেখানকার সবচেয়ে উঁচু ৪২ তলা ভবনটির নামই ক্যাথেড্রাল অব লার্নিং। সূর্যোদয়ের
সময় সকালের প্রথম রোদ পড়ে সেটি কমলা রঙের কোনো রত্নের শোভা ধারণ করে, শুধু সে দৃশ্য দেখার জন্যই রাত পোহানোর আগেই একদিন সেখানে ছুটে গিয়েছিলাম। বিশ্বের একটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয় কার্নেগি মেলন। শুধু কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই এ পর্যন্ত ছয়টি শাখায় ২১ জন নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।
তাই ছেলের সুবাদে সে বিশ্ববিদ্যালয়ের আনাচকানাচে ঘোরার দুর্লভ সুযোগ পেয়ে
ঘুরে নিলাম সেখানে থাকা ফিপস কনজারভেটরি ও বোটানিক্যাল গার্ডেনটাও। বিশাল সুদৃশ্য কাচঘরের সেই মনোরম উদ্যানটির ভেতরেই ট্রপিক্যাল প্ল্যান্টস অংশে খুঁজে পেলাম আমার দেশের এই তরুবন্ধুদের। ভাবলাম, যেহেতু ওটা একটা বোটানিক্যাল গার্ডেন, তাই বিশ্বের নানা প্রান্তের গাছপালা ওখানে থাকাটা বিচিত্র না। কিন্তু ওখানে ঘুরে আসার পর পিটসবার্গ শহর ও তার আশপাশের পার্কগুলোয় ঘুরতে ঘুরতেও দেখা হলো এ দেশে আমার দেখা আরও অনেক গাছপালার সঙ্গে। দেখা কোনো কিছুকে আবার দূরে কোথাও দেখতে পাওয়ার একটা অন্য রকম মজা আছে।
ফিপসের কাচঘরের মধ্যে পেলাম করলা, মনোস্টেরা, ফিলোডেনড্রন, সাইকাস, শ্রিম্প ফ্লাওয়ার, অ্যাগ্লাওনিমা, অ্যানথুরিয়াম, ভাদ্রা, জবা, সিলোসিয়া বা সিলভার কক্স কম্ব, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি গাছ। কাচঘরের বাইরে দেখা হলো বেগুন, চিতালিলি, ক্যাপসিকাম ও টমেটোগাছের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ও মিউজিয়ামের পাশে একটা ম্যাপলবন, তার পাশে রাস্তার ওপারে একটা সবুজ লন, বসার কয়েকটা বেঞ্চি, আশপাশটা নানা রকম ফুলগাছে ভরা। কী চমৎকারভাবে সাজানো সব। সেসব গাছে ফুটে রয়েছে জিনিয়া, কসমস, ডেইজি, অ্যাস্টার, গেলার্ডিয়া, হাইড্রেঞ্জিয়া, মোরগঝুঁটি বা সিলোসিয়া, কলাবতী, গাঁদা ও কাশফুল।
অন্য আর এক দিন সে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে দেখা হলো রূপবতী বাহারি লাল কলাগাছ ও বাহারি কচুগাছের সঙ্গে, পাশে রয়েছে বাহারি বাঁধাকপির গাছ। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অংশেই পাশে বিশাল জায়গাজুড়ে রয়েছে ১৮৮৯ সালে স্থাপিত ৪৫৬ একরের প্রাচীন শেনলি পার্ক। পাহাড়ি পথে রয়েছে বেশ কিছু গিরিপথ বা ট্রেইল, লেক, বন। পার্কের ঢাল বেয়ে ট্রেইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম ছোট্ট লেকটার পাড়ে। অগভীর জলাশয়টির কিনারে জন্মেছে হোগলাবন, ঘন হয়ে থাকা গাছগুলোয় শোভা পাচ্ছে বাদামি রঙের কাঠির মতো পুষ্পাধার, পাশে সাইপেরাস বা মুথাগাছের ঝোপ, আছে বুনো দোপাটি ও পাহাড়ের ঢালে কাশফুলের গাছ।
আরেক দিন চলে গেলাম পিটসবার্গ শহরের আরেক জনপ্রিয় ফ্রিকস পার্কে। অনেকগুলো ট্রেইল বা গিরিপথ। সব কটিতে যাওয়া অনেক সময়ের ব্যাপার। দুটি ট্রেইল ধরে কয়েক ঘণ্টা হাঁটলাম। কিন্তু প্রায় সবই আমেরিকান গাছপালা সেখানে। ফেরার সময় শুধু দেখা হলো পথের ধারে হলুদ ফুল ফোটা শুষনিশাকের সঙ্গে, ফুলহীন কিছু বুনো গোলাপগাছ রয়েছে ছোট্ট একটা ঝিরি বা ক্রিকের পাড়ে, প্রচুর ছোট ছোট লাল ফল ধরেছে সেগুলোয়। শহরের হাইল্যান্ড পার্কে গিয়ে পেলাম সাদা কসমসের দাপাদাপি।
থাকি স্কুইরেল হিলে। বাসার কাছের পথ ধরে মাঝেমধ্যে সকালে হাঁটতে বের হই। মুরে অ্যাভিনিউ, শেডি স্ট্রিট, জনসন স্ট্রিট Ñআরও কত নাম সব পথের! সব মনে থাকে না। কিন্তু সেসব পথের ধারে সুন্দর করে সাজানো বাগানওয়ালা বাড়িগুলোর কথা কিছুতেই মন থেকে মুছতে পারি না। প্রায় সব বাড়ির সামনেই ছোট ছোট বাগান, লন, জীবন্ত গাছের বেড়া। সেসব বাড়ির সামনের বাগানগুলোয় পেয়ে যাই আমাদের দেশে দেখা কিছু শীতের মৌসুমি ফুল। লাল, গোলাপি আর সবুজাভ রঙের হাইড্রেঞ্জিয়া ফুটেছে সেসব বাগান আলো করে। বাগানপথের ধারে ছোট ছোট গাছে ফুটে আছে নানা রঙের প্যানজি, কমলা রঙের ন্যাস্টারশিয়াম, লাল রঙের ল্যান্টানা ও জিনিয়া ফুল, মিনিয়েচার চন্দ্রমল্লিকা ফুলে ঠাসা চন্দ্রমল্লিকা, রংবাহারি ডালিয়া, হলদে সূর্যমুখী ও কোনফ্লাওয়ার, লাল রঙের কারনেশন, গোলাপি রঙের নয়নতারা ও ভারবেনা, পাহাড়ের ঢালে সাদা রঙের জাপানি হানিসকল, লাল গোলাপ ইত্যাদি ফুল। নিশ্চয়ই দেশে ফিরে এবার শীতে এসব ফুলের সঙ্গে আবারও দেখা হবে।