দেশে বছরে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০০ আকালিক নবজাতকের জন্ম হয়।
২৩% নবজাতকের জন্ম ওজন কম। অপরিণত নবজাতক জন্ডিস, শ্বাসকষ্ট, রক্তস্বল্পতায় ভোগে। শরীরে তাপ কম থাকে, রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকে।
সেরিব্রাল পালসি, মৃগীরোগ, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি থাকে।
আকালিক বা সময়ের আগে জন্ম নেওয়া শিশুর হার বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। দেশে ১৬ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে অকালে। প্রতি ঘণ্টায় অপরিণত ও কম ওজনের তিনটি নবজাতক দেশের কোথাও না কোথাও মারা যাচ্ছে। প্রতিরোধ ও চিকিৎসার ব্যবস্থা যা আছে, তার পূর্ণ ব্যবহার হচ্ছে না।
গতকাল শনিবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) আয়োজিত এক কর্মশালায় এই তথ্য জানানো হয়। ‘বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর বোঝা, গৃহীত পদক্ষেপ ও উদ্ভাবন’ শীর্ষক এই কর্মশালা যৌথভাবে আয়োজন করে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) ও বিএসএমএমইউ। এতে গবেষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা, জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক, শিক্ষার্থী এবং একাধিক পেশাজীবী সংগঠনের প্রতিনিধি অংশ নেন।
কর্মশালার শুরুতে আইসিডিডিআরবির মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিভাগের বিজ্ঞানী ড. আহমেদ এহসানূর রহমান মাতৃগর্ভে কততম সপ্তাহে ভ্রূণের কোন ধরনের পরিবর্তন ঘটে, তার বর্ণনা দেন। ২৮ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম হলে কী সমস্যা হয়, ৩২ বা ৩৬ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম হলে কী সমস্যা, তা ব্যাখ্যা করেন। সময়ের আগে অর্থাৎ ৪০ সপ্তাহ পূর্ণ হওয়ার আগে জন্ম হলে সেসব নবজাতকের শ্বাসকষ্ট, জন্ডিস, রক্তস্বল্পতার ঝুঁকি থাকে। এসব নবজাতকের শরীরে তাপ কম থাকে। রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাও কম থাকে। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেশি থাকে। এদের সেরিব্রাল পালসি, মৃগীরোগ বা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার ঝুঁকি থাকে। তাদের মানসিক বিকাশও ঠিকমতো হয় না।
আকালিক নবজাতকের সমস্যা তুলে ধরার পর আহমেদ এহসানূর রহমান ১০৩টি দেশ নিয়ে করা গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, দেশে বছরে ৪ লাখ ৮৮ হাজার ৬০০ আকালিক নবজাতকের জন্ম হয়। ১০০ নবজাতকের মধ্যে ১৬ দশমিক ২টি শিশু আকালিক। বিশ্বে আকালিক শিশু জন্মের হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে আছে যথাক্রমে মালাবি, পাকিস্তান ও ফিলিস্তিন। অন্যদিকে ২৩ শতাংশ নবজাতক প্রয়োজনের চেয়ে কম ওজন নিয়ে জন্মায়। এই হার বিশ্বে দ্বিতীয়।
অকালে ও কম ওজন নিয়ে জন্ম নেওয়া নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও মৃত্যুঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। আহমেদ এহসানূর রহমান বলেন, বাংলাদেশে
বছরে অপরিণত ও কম ওজন নিয়ে জন্মানো ২৪ হাজার ৯০০-র বেশি নবজাতক মারা যায়। এর অর্থ প্রতি ঘণ্টায় এ ধরনের তিনটি নবজাতকের মৃত্যু হচ্ছে।
গবেষকেরা দেখেছেন, এ ধরনের নবজাতক মেয়ের চেয়ে ছেলে বেশি। ছেলেদের মৃত্যুহারও বেশি।
বিশ্বের অনেক দেশেই এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ নবজাতকের বিষয়ে অনেক কাজ হয়েছে, আছে অনেক উদ্ভাবন। সেসব বিষয়ে জ্ঞান ও প্রযুক্তি বাংলাদেশে আছে। কিন্তু প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় কাজ ঠিকমতো হচ্ছে না বলে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারীরা প্রায় সবাই মত প্রকাশ করেন।
মূল উপস্থাপনায় বিএসএমএমইউর নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মান্নান বলেন, অপরিণত ও কম জন্ম ওজনের নবজাতকের চিকিৎসায় তিনটি ব্যবস্থা আছে: এন্টিনেটাল কোরটিকোস্টেরয়েড (এসিএস), ক্যাঙারু মায়ের সেবা (কেএমসি) এবং নবজাতকের বিশেষ সেবা ইউনিট (স্ক্যানু)। ৫ শতাংশের কম নবজাতক কেএমসির সুযোগ পায়। দেশে মাত্র ৬২টি হাসপাতালে স্ক্যানু আছে, ২০২৪ সালে ১ লাখ ২২ হাজার ৬১ নবজাতক সেখানে রাখা হয়েছিল। নবজাতকের সেবার ক্ষেত্রে বেসরকারি হাসপাতালগুলো অনেক পিছিয়ে। তিনি আরও বলেন, জন্মের পর মায়ের ত্বকের সংস্পর্শে নবজাতককে রাখলে নবজাতকের মৃত্যু ২৫ শতাংশ কমানো সম্ভব।
বাংলাদেশ পেরিনেটাল সোসাইটির সভাপতি অধ্যাপক লায়লা আরজুমান বানু বলেন, দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষেত্রে শিশু আকালিক হওয়ার কারণ জানা যায় না। তবে এসব শিশুকে এক সপ্তাহ বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হলে পরবর্তী সময়ে ভালো ফল দেখা যায়।
একাধিক আলোচক বলেন, বাল্যবিবাহ, নারী নির্যাতন, ঘরের ভেতরের বায়ুদূষণ আকালিক ও অপরিণত নবজাতক জন্মের পেছনে কাজ করে। জন্মের পর থেকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে নবজাতকের ঝুঁকি কমে।
বিশিষ্ট শিশুস্বাস্থ্য-বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের সাবেক প্রধান অধ্যাপক আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, প্রসব-পূর্ব, প্রসবকালীন ও প্রসব-পরবর্তী পর্যায়ে সেবা বা করণীয় সম্পর্কে জানা আছে। কিন্তু কাজগুলো ঠিকমতো হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি ও নজরদারি বাড়ানো দরকার। এ ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্তদের জবাবদিহি নিশ্চিত করাও জরুরি।